সোহরাওয়ার্দীর সার্বভৌমত্ববোধ ও বাংলার মুক্তি

বাংলার নবজাগরণের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন। আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নবজাগরণ ছিল অপরিহার্য। মূলত জাগরণের শুরু করেন রাজা রামমোহন রায় এবং শেষ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়। যদিও এরপর অনেক জ্ঞানীগুণী ও শিক্ষাবিদ নবজাগরণের ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনি একজন। যিনি অত্যন্ত দক্ষ রাজনীতিবিদ হলেও আপাদমস্তক সামাজিক মুক্তির চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। মাটি মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।
সমাজ, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার তাকে ভাবিয়েছে আমৃত্যু। প্রসঙ্গত প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখেন, একালে অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নেই, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারাই এটি প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে তখনকার প্রধান বিরোধীদল বাঙালি জাতীয়তাবাদী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার সঙ্গে ছিলেন বাম-প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর নেতারা।
যেমন- ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট যে (আবুল মনসুর আহমদ প্রণিত) ২১ দফা অঙ্গীকার করে তার ১৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, 'যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।' (বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা)
খ.
সোহরাওয়ার্দী রাষ্ট্রনায়কোচিত মানসিকতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রখ্যাত বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দীর কনিষ্ঠ পুত্র। তার জীবনের অন্যতম ঘটনা বাংলার দেশভাগ ও স্বাধীনতা। সে সময়কালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান না হলে বংলাদেশের অভ্যুদয় হতো না।
(দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তি নিয়ে নানা মত আছে, সেদিকে না যাই)।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বিষয় প্রায় চূড়ান্ত রূপ পায়। এসময় জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রস্তাব করান। কিন্তু বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সোহরাওয়ার্দী উপলব্ধি করেন- বাংলার হিন্দু মুসলমানের সমস্যা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো না, কিছুটা স্বতন্ত্র। নিজের অভিজ্ঞতা, মহৎ পরিকল্পনার সহযোগী দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশিমের অনুপ্রেরণায় সিদ্ধান্ত নেন ভারতের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে আলাদা সার্বভৌম বাংলা গঠনের।
এই বিষয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, 'বাংলা ও ভারতের সমস্যার মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান, কারণ বাঙালি একটি জাতি, একই ভাষাভাষী, বহু দিক, বহু বিষয়ে তাহাদের মধ্যে মিল রহিয়াছে, তাহারা পরস্পর পরস্পরকে অনুধাবন করিতে সমর্থ।' (আমার জীবনস্মৃতি: মাহমুদ নুরুল হুদা)
৪৬' এর দাঙ্গার শুরুর পরের দিন কলকাতায় খেলাফত কমিটি ও মুসলিম লীগের নেতারা জান মোহাম্মদের নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীর বাসায় বৈঠকে বসেন। তারা তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'আপনার বেয়ারা শিবুকে এই মুহূর্ত্বে সরিয়ে দিন এবং হিন্দু নাপিত জগদীশকে শেভ করাতে বাসায় আসতে বারণ করুন। সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক সচিব মাহমুদ নুরুল হুদা বলেন, সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবে রাজি না হয়ে বলেন এটা করলে নিজেকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচয় করাবো। আর তা করে কোন যুক্তিতে হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য প্রচারকার্য চালাবো? তার এই অবস্থানে সবাই অবাক হন। এ ঘটনায় তার চিন্তা ও জীবন দর্শন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
রক্ষণশীল হিন্দু নেতৃত্বের একটি অংশ তাকে ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত করার অপচেষ্টা চালায়। তবে গান্ধীজী এই অভিযোগ গ্রহণ করেননি, কারণ তিনি সত্যটা অনুভব ও জানতেন। শুধু অবিভক্ত বঙ্গের প্রিমিয়ার নয়, কলকাতার মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে কলকাতার অলিতে-গলিতে দাঙ্গাবিরোধী মিশন নিয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন। এই সাহসিকতায় বিমুগ্ধ হয়ে মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গাকবলিত নোয়াখালীতে তাকে সফরসঙ্গী করেন।
প্রসঙ্গত সোহরাওয়ার্দীর অভিমান আবুল মনসুর আহমদ তার আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইয়ে উল্লেখ্য করেন: ৪৭' সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব নিলেন না। কায়েদে-আযম ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খাঁর অনুরোধের জবাবে তিনি (সোহরাওয়ার্দী) জানাইলেন: ভারতীয় মুসলমানদের একটা হিল্লা না করিয়া তিনি ভারত ছাড়িতে পারেন না। তিনি এ ব্যাপারে কায়েদে-আযমের কাছে যেসব তার ও চিঠি দিয়াছিলেন, আমি তা দেখিয়াছিলাম। তাতে তিনি বলিয়াছিলেন: 'আপনার সুদক্ষ পরিচালনায় পাকিস্তানের হেফাযত করিবার যোগ্য লোকের অভাব নাই। কারণ মুসলিম লীগের প্রায় সব নেতাই পাকিস্তানে চলিয়া গিয়াছেন। কিন্ত পিছনে-ফেলিয়া-যাওয়া বেচারা ভারতীয় মুসলমানদের হেফাযত করিবার কেউ নাই। আমাকে এদের সেবা করিতে দিন।' কথাটা খুবই মহৎ ও অতুলনীয়।
একবার নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রিসভায় সিভিল সাপ্লাই দপ্তরের মন্ত্রিত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী সে সময়ের জটিল একটি দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছিলেন। দেশকে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটেছেন। অসংখ্যা নোঙ্গর খানার ব্যবস্থা করেছিলেন। মাড়োয়ারি ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মজুদকৃত মালামাল রিকুইজিশন করে সাধারণের মধ্যে দিনরাত পরিশ্রম করে বিতরণ করেছেন। এসব গঠনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক সচিব মাহমুদ নুরুল হুদা।
সোহরাওয়ার্দীর কর্মশক্তি সম্পর্কে রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান বলেন, সোহরাওয়ার্দীর কর্মক্ষমতা দেশে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কী রাজনীতি ক্ষেত্রে, কী ওকালতি ব্যবসায় তিনি দিনরাত খাটতে পারতেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তফ্রন্টের কাজ তিনি যেভাবে সম্পন্ন করেছেন, তা জীবনে ভুলবার নয়।
শিশুর মতো মানুষটি ঘড়ির কাটা ধরে ঘুমাতে পারতেন। পারতেন উঠতেও। একবার রাজনৈতিক মিটিং শেষে ফেনী থেকে চাটগাঁ রওনা হই। স্টেশনে পৌঁছতে তখনও কুড়ি মিনিটের মতো বাকি। বললেন, বারো মিনিট ঘুমিয়ে নেই, তার আট মিনিট পর রেডি হয়ে যাবেন। তিনি করলেনও তাই। সময়কে তিনি গোলাম বানিয়েছেন। (দৈনিক ইত্তেফাক: ৫ ডিসেম্বর, ১৯৮৮)
গ.
কীর্তিমান মানুষের দোষ গুণ থাকবে- থাকবে সম-আলোচনা। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি। গবেষক মিজানুর রহমান খান বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল বইতে লেখেন, ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করেন বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৫১ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার মার্কিন কনসাল চার্লস ডি উইদার্স তাঁর পূর্ব পাকিস্তান সফর সম্পর্কে একটি বার্তা পাঠান। সোহরাওয়ার্দী এ সময় জনসভাগুলোতে বাংলা ও উর্দু মিশিয়ে বক্তৃতা করেন। উইদার্স লিখেছেন, 'আমরা অবহিত হয়েছি যে সোহরাওয়ার্দী কার্যত জনতাকে তাঁর হাতের তালুতে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কখনো উর্দু, কখনো বাংলায় কথা বলেন। তিনি সমবেত জনতার সকল অংশকে সন্তুষ্ট করতে সফল হয়েছিলেন। সন্দেহাতীতভাবে সোহরাওয়ার্দী একজন চালাক মানুষ। দুটি বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা তাঁর উদ্ভাবনপটুতার উদাহরণ তৈরি করে''।
ইতিহাস নিদারুণ। যত সময় যায় তত কচুরি সরিয়ে জল দেখায়। তবে সোহরাওয়ার্দী চিন্তা-চেতনায় ও মননশীলতায় মানবিক জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এবং সাধারণ মানুষের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধ ছিল তার হৃদয়জুড়ে।
আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং নির্বাচনে তাদের অবিস্মরণীয় বিজয়। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে 'গণতন্ত্রের মানসপুত্র' বলে আখ্যায়িত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এদেশের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। অবিভক্ত ভারতে শিক্ষা-সংস্কৃতি-প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সোহরাওয়ার্দীর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
নূরে আলম সিদ্দিকীর এক স্মৃতিকথায় জানা যায়- একবার কারাগারে মুজিব ভাইয়ের মুখে শুনেছি আইয়ুব খান তার স্যারকে বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট পদটি ছাড়া আপনি যে পদটি চাইবেন সেখানেই আপনাকে অধিষ্ঠিত করা হবে। স্মিতহাস্যে সোহরাওয়ার্দীর জবাব ছিল- আপনার স্বঘোষিত ৬২-এর শাসনতন্ত্র প্রত্যাহার করে ৫৬-এর শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন প্রদান করুন; এ ছাড়া আমার আর কোনো চাওয়া নেই। আইয়ুব খানও সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতেন অকুতোভয় ও নির্লোভ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জনমত গঠন করে তাকে উৎখাত করতে পারেন। তাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এক আদেশে রাজনীতি তার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
সোহরাওয়ার্দী শুধু আওয়ামী লীগেরই স্রষ্টা নন, তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পুরোধা। বৈরুতে চিকিৎসা করতে যাবেন তখন আতাউর রহমান খান, সালাম খান, জহিরউদ্দিন সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ, খাজা খয়রাত হোসেনসহ সবাই নেতাকে প্রশ্ন করলেন- স্যার, আমাদের জন্য কী রেখে যাচ্ছেন? তিনি বললেন- একটি কলম আর একটি মাঠ। অর্থাৎ- মানিক ও মুজিবকে তোমাদের কাছে রেখে গেলাম।
আসলে তার যোগ্য উত্তরসূরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব পাকিস্তান সরকারের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ত্যাগে আসে স্বাধীনতা। কিন্তু তার আশার সামাজিক মুক্তি আসেনি।
Comments