মুক্তিযুদ্ধ

১০ অক্টোবর ১৯৭১: 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি সমর্থন আছে'

১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর লন্ডন থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, 'যখন আমরা জেনেছি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে।

১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর লন্ডন থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, 'যখন আমরা জেনেছি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে।

নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে, অত্যাচারের ভয়াল নিদর্শন সৃষ্টি করেছে তখনই আমরা বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। এই অসহায় মানুষের গণদাবীর প্রতি আমার সমর্থন সবসময়ই থাকবে। গত ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ নিপীড়িত হয়েছে। দিনের পর দিন নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত হওয়ার ফলে যখন তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে ঠিক তখনই তারা অস্ত্র কাঁধে নিয়েছে। তারা মনেপ্রাণে চেয়েছিল পাকিস্তানের সাথে থাকতে কিন্তু আমাদের স্বৈরশাসকেরা ও ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদেরা কেবলই তাদের ব্যবহার করেছে। আমি অবশ্যই একসময় বাংলাদেশে যাব। এই বাংলাদেশের নিপীড়িত ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের প্রতি আমার সমর্থন আছে।' 

ঢাকায় এদিন

১০ অক্টোবর পাকিস্তান পিপলস পার্টির একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে আসেন। পিপিপির এই সফরকারী দলের নেতৃত্ব দেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা মিয়াঁ মাহমুদ আলী কাসুরী। এদিন কাসুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব জোরদার করার জন্যই তিনি ঢাকা এসেছেন। এই প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানবাসীর উদ্দেশ্যে বাণী পাঠিয়েছেন।

ভারতে এদিন

১০ অক্টোবর দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'বিশ্ব জনমত এখন বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু শরণার্থীদের জন্য বিদেশি সাহায্য তো আর বাংলাদেশ সংকটের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান দেবে না। বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ হবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান। আমরা আশা করছি শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১০ অক্টোবর ভ্যাটিকেনে ধর্মগুরু পোপ জন পলের আহ্বানে রোমের বিভিন্ন গির্জায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। একই সঙ্গে এই প্রার্থনাসভায় শরণার্থীদের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন

১০ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবাদপত্র 'প্রাভদা' এক প্রতিবেদনে বলে, 'পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা দেখছি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচার নামের প্রহসন। যেখানে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান জরুরি সেখানে পাকিস্তান সরকার অহেতুক দেরি করছে। গত ৮ অক্টোবর মস্কোতে সোভিয়েত ছাত্র ও শিক্ষকেরা এক প্রতিবাদ সমাবেশে চার দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। এগুলো হলো বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের দাবি, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সোভিয়েত সরকারের সমর্থন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১০ অক্টোবর ভোরে সিলেটের কলাচারা রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। এই হামলায় ৫ জন রাজাকারকে আটক করে গেরিলারা। একই সঙ্গে রাজাকারদের কাছ থেকে ১টি ৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী।

১০ অক্টোবর টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনী চারাবাড়ি ও পোড়াবাড়ি ঘাট মুক্ত করার জন্য পোড়াবাড়ির একমাত্র পাকা সড়কের বড় সেতু ও পাশের আর একটি সেতু বিস্ফোরকের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়। সন্তোষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর বাড়ি সংলগ্ন এই সেতুটি এবং কিছু দূরের বেলতা সেতু ধ্বংস করে দেয়ার পর ওই এলাকা হানাদার মুক্ত হয়।

১০ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত হয়। একই সঙ্গে ২ রাজাকারদের আটক করে মুক্তিবাহিনী। 

১০ অক্টোবর চট্টগ্রামের বারোবাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়।

এদিন ৮ নম্বর সেক্টরের গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর মাধবকাঠি ঘাঁটির ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে হ্যানাদার বাহিনীর ৩০ জন সৈন্য নিহত ও ২০ জন আহত হয়। অন্যদিকে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

 ১০ অক্টোবর ৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ রেললাইনে মাইন পেতে রাখলে হানাদার সৈন্যবাহী একটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ কয়েকটি বগি ধ্বংস হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

১০ অক্টোবর রাজশাহীর ইসলামপুরে অবস্থানরত হানাদারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এই হামলায় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

১০ অক্টোবর ৮ নম্বর সেক্টরের বায়রা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্যের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় ৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ২ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও চতুর্দশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান, ১১ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১১ অক্টোবর ১৯৭১ 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

21h ago