২২ অক্টোবর ১৯৭১: `স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়াই একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২২ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মুজিবনগরে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির ৩ দিনের বৈঠক সমাপ্ত হয়। শেষ দিনের বৈঠকে সভাপতি ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বৈঠকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সব মন্ত্রী ও কমিটির ৪২ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। 

বৈঠক শেষে এক প্রস্তাবনায় বলা হয়, 'স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়াই একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান। এ ছাড়া, আমরা কোনো ধরনের আলোচনায় আসতে পারি না। পাকিস্তানকে মেনে নিতে হবে, এখন বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ। পাকিস্তান যদি আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়, তবেই আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারি। অন্যথায় তাদের সঙ্গে আমরা কোনো আলোচনায় বসতে পারি না।'   

ঢাকায় এদিন

২২ অক্টোবর তেজগাঁওয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের একটি দল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি নৌকায় অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর নৌকাটি ধ্বংস হলে নৌকায় থাকা ৫ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ৬ সেনা আহত হয়।

ভারতে এদিন

২২ অক্টোবর বাংলাদেশের ৪০ জন ছাত্রের একটি দল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জনমত তৈরির উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতন যান। এর  আগে ১৪ অক্টোবর  মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে পদব্রজে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা করেন তারা। শান্তিনিকেতনে পৌঁছালে  বিশ্বভারতীর উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত তাদের স্বাগত জানান।

২২ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন  সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন। এ সময় দুজনের মধ্যে শরণার্থী সমস্যা, আঞ্চলিক শান্তি ফিরিয়ে আনার আন্তরিক প্রচেষ্টাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। 

২২ অক্টোবর লোকসভার ১১ সংসদ সদস্য মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেসের সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানের ওপর রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা ও গণহত্যা বন্ধে প্রচেষ্টা চালানোর অনুরোধ করেন।

পাকিস্তানে এদিন

২২ অক্টোবর করাচীতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'জনগণ চায় পিপলস পার্টির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। আওয়ামী লীগ বেআইনী ঘোষিত হবার পর পিপিপি এখন কেবল পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক  দলই নয়, জাতীয় পরিষদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২২ অক্টোবর দামেস্ক থেকে প্রকাশিত সিরিয়ার প্রভাবশালী সংবাদপত্র আল সারায় 'পূর্ব বাংলা: সামরিক সমাধানের ব্যর্থতা' শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।

এই নিবন্ধে বলা হয়, 'পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অনড় অবস্থান ও গণহত্যার কারণে ইতোমধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে  যুদ্ধের তীব্র  সম্ভাবনা  দেখা দিয়েছে। পূর্ব বাংলা ট্র্যাকে শরণার্থী স্রোত বন্ধ না হলে এই সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। এজন্য বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকে পাকিস্তানের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এখন সেখানে অমানবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যা কারো জন্যই সুখকর নয়। শরণার্থীদের রক্ষায় যথেষ্ট ত্রাণ সরবরাহের প্রয়োজন। এজন্য জাতিসংঘ ও ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।'

দেশব্যাপী এদিন

২২ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের এক সভায় প্রাদেশিক শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী এ এস এম সোলায়মান বলেন, 'পাকিস্তানের আদর্শ সম্পর্কে অজ্ঞতাই বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে দায়ী। মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি কেন হয়েছিল- আজকের তরুণ সমাজের মধ্যে সে ব্যাপারে প্রকৃত উপলব্ধি নেই। তরুণ সমাজের মধ্যে এ বোধ জাগ্রত করতে হবে '

২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় এক সভায়  প্রাদেশিক  স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওবায়দুল্লাহ মজুমদার বলেন, 'আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা পাকিস্তানের সহজ সরল জনগণের সঙ্গে বেইমানী করেছে। বাংলাদেশ শ্লোগান তুলে তারা পাকিস্তানের আদর্শের মূলে আঘাত করেছে। আমরা তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে পারি না। কোনো দেশদ্রোহীর ঠিকানা এই দেশ হতে পারে না।'  

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২২ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনীর ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা কসবার হানাদারদের  ঘাঁটির উপর  অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনী  প্রায় ১০ মিনিট তীব্র কামানের গোলাবর্ষণ করার পর, উত্তর দিক থেকে লেফটেন্যান্ট  আজিজ এবং সুবেদার মেজর শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর  ওপর হামলা চালান। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ২৬ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ১৮ জন আহত হয়। এ ছাড়া, ৪ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ১৫ মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে ১১টি এলএমজি, ১টি পিস্তল সিগন্যাল, ৪০টি এইচ-৩৬ গ্রেনেড, ৩টি ৯৪ এনার্গা, ৪৪টি প্লাস্টিক মাইন ও ১টি ম্যাপ নিজেদের দখলে নেয়।

২২ অক্টোবর ৮নং সেক্টরের নাইকালিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা একত্রিত হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনীও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৩ সেনা নিহত হয় এবং ১৫ রাজাকার হতাহত হয়।

২২ অক্টোবর  ২নং সেক্টরের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ৫ মাইল উত্তরে হরি সর্দার বাজারে মেজর ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রায় ১২ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী মর্টার, মেশিনগান ও আরআরের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৩৫ সেনা নিহত হয়।  

২২ অক্টোবর খাগড়াছড়ির রামগড়ের পার্শ্ববর্তী বড়পানুয়াতে ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ধরতে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে এ সময় হানাদার বাহিনীর ৩ সেনা গুরুতর আহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়ে নেন।  

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ ও চতুর্দশ খণ্ড। 

দৈনিক পাকিস্তান, ২৩ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৩ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর,  ২৩ ও ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

 

Comments

The Daily Star  | English
US attack on Iran nuclear sites

UN Security Council to meet Sunday over US strikes on Iran

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

11h ago