মুক্তিযুদ্ধ

৪ নভেম্বর ১৯৭১: হোয়াইট হাউজে নিক্সন-ইন্দিরা বৈঠক

১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক বাসভবন হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

এই বৈঠকে তাদের মধ্যে পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থী সমস্যা, আঞ্চলিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, পূর্ব বাংলায় চলমান সামরিক পদক্ষেপ, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দলের প্রস্তাবসহ নানা বিষয় উঠে আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে যে অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে তা দিনশেষে ব্যবহার হচ্ছে পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষের উপরেই। এই সহায়তা বন্ধ না করলে এই সমস্যার সমাধান আশা করা যায় না।'

একই সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী রিচার্ড নিক্সনকে পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, শরণার্থী সমস্যার সমাধান হোক পাকিস্তান এটি চায় না। নয়তো এতদিন এই সমস্যা জিইয়ে রাখতো না। পাকিস্তানের কারণেই আজ প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের নিয়ে আমরা সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে আছি। এই সমস্যা পাকিস্তানের ভুল নীতিরই প্রয়োগ। অথচ পাকিস্তান বারবার ভারতের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।' 

বৈঠকে রিচার্ড নিক্সন বলেন, মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে যে এখনো অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে তাতে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কেননা এই অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ খুবই সামান্য। তাছাড়া সরবরাহ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আমরা যথাসম্ভব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছি। আমরা পাকিস্তানকে পরিষ্কার অর্থে বলেছি শেখ মুজিবুর রহমানকে যেন কোনোভাবেই মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে আমরা এও বলেছি বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে।' মার্কিন সরকার সবসময়ই শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী।'

ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে আরও বলেন, 'ভারত অসহায় শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে মানবিকতার খাতিরে। অন্য কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অভিলাষে নয়। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভারতের রাজ্যগুলোতে নিরাপত্তা থেকে অর্থনৈতিক পরিবেশ সবই তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু তবুও ভারত শরণার্থীদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে না। তাই ভারত বলেছে পূর্ব বাংলায় শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তবেই ভারত শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে সায় দিবে। জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে মার্কিন সরকার সবসময়ই আশাবাদী। আমরা এজন্যই সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর প্রস্তাব উঠিয়েছিলাম। যেন তারা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।'

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকের পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা একটি বৈঠকে যোগ দেন। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মী কান্ত ঝা, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউল এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার।

ভারতে এদিন

৪ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী পাকিস্তান দূতাবাসে আটক বাঙালি গোয়েন্দা কর্মকর্তা হোসেন আলী ও তার পরিবারের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আন্তর্জাতিক কূটনীতিক মহল, জেনেভার আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সভাপতি ও জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে আবেদন জানান। পরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বলেন, 'আমরা এই আবেদনের কী প্রতিক্রিয়া হয় তার জন্য অপেক্ষা করছি। যদি আমরা দেখি জাতিসংঘ, কূটনীতিক মহলে এই আলোচনা নিষ্ফল হয়েছে তবে আমরা আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কঠোর পদক্ষেপ ও প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হবো। আমরা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব না। ইতিমধ্যে আমাদের বেঁধে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যেই যা যা করবো তার পরিকল্পনা করেছি। আর এজন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী থাকবে ঘৃণ্য পাপী ইয়াহিয়ার নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সাজ্জাদ হায়দার।'

৪ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ ঘাঁটিতে বিমানবাহিনীর এক কুচকাওয়াজে ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল বলেন, 'ভারতের বিমানবাহিনী পাকিস্তানসহ যে কোনো বহিঃআক্রমণের জন্য মোকাবিলা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। পাকিস্তান যদি আমাদের উপর আক্রমণের দুঃসাহস দেখায় তবে আমরা তার সমুচিত জবাব দেবো।'

৪ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুষ্টিয়ার প্রাগপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে ভারতের নদীয়ার বানপুর ও শিকারপুরে মর্টার ও গোলাবর্ষণ করে। তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ও বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং ১৫ হানাদার সেনা নিহত হয়।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন 

৪ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, গত সপ্তাহে মার্কিন সিনেট ২৯০ কোটি ডলারের যে বৈদেশিক সাহায্য বাতিল করেছে তার অংশ ছাড়া মার্কিন সরকার শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের আর কোনো সাহায্য করতে পারবে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একই সঙ্গে এও বলে, 'আমাদের সাহায্য কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হলে তাদের সাহায্য করার মতো অর্থ আমাদের নেই। অর্থ সরবরাহ না থাকার কারণে আমাদের ১৯৭২ সালের কর্মসূচিগুলো ছাঁটাই করতে হবে। এবং মার্কিন কংগ্রেসের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাও ১৫ নভেম্বর বন্ধ হয়ে যাবে।' এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্স মার্কিন সরকারের বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিকে রাজি করাতে পারেননি। তখন সিনেট মার্কিন সরকারের বৈদেশিক সাহায্য বিলটি বাতিল করে দিয়েছিল এবং সাহায্য কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।

৪ নভেম্বর অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এক প্রতিবেদনে বলে, 'পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে দুটি পাকিস্তানি জাহাজ চীন ও রোমানিয়ায় গেছে। ধারণা করা হচ্ছে পূর্ববঙ্গে গেরিলাদের ভয়াবহ তৎপরতায় পাকিস্তান সামলে উঠতে না পেরে ভারতে অবস্থানরত গেরিলা প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে হামলা চালাতে নতুন অত্যাধুনিক অস্ত্র আনছে। মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের গোপন সূত্রে জানা গেছে গত সপ্তাহের শেষদিকে একটি মালবাহী জাহাজ ভারী অস্ত্র আনার জন্য চীনে পাড়ি জমিয়েছে। যেখানে ট্যাংক, কামান, আর্টিলারির সরঞ্জামাদিসহ নানা ভারী সরঞ্জামাদি থাকবে। অন্যদিকে রোমানিয়া যাওয়া জাহাজটি দিয়ে হালকা ও ভারী মেশিনগান, রকেট লঞ্চার পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করবে।'

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

ধুনট গণহত্যা

৪ নভেম্বর বগুড়ার ধুনটে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধরে আনা মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের চরম পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় শহীদ হন ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। এর আগে ৩ নভেম্বর রাতে রাজাকার ও হানাদার বাহিনীর চরেরা ধুনটের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে হানাদারদের কাছে তথ্য সরবরাহ করে। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর কয়েকটি দল ধুনট থানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ২৯ জন মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের আটক করে। এর মধ্যে একজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। 

বাকিদের ধুনট থানা ক্যাম্পে এনে তাদের উপর চালানো হয় চরম পৈশাচিক নির্যাতন। পরে হানাদার বাহিনী ধুনট থানার পাশে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েই দুটি গণকবর খুঁড়ে। পরে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে সেই গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

৪নভেম্বর বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর একটি দল উত্তর প্রান্তের দৈবজ্ঞহাটি বাজারের কাছে বিশ্বাস বাড়িতে থাকা একটি শক্তিশালী রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় রাজাকার ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সারা রাত ধরে চলা দুই পক্ষের মধ্যে এই যুদ্ধে বহু রাজাকার নিহত হয়।

৪ নভেম্বর নেত্রকোণায় মুক্তিবাহিনীর বড় একটি দল বারহাট্টা পুলিশ স্টেশনে ও তানতার এলাকায় পাকিস্তানি পুলিশের উপর ত্রিমুখী অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় তারা পুলিশ স্টেশন দখল করে পুলিশ স্টেশনে থাকা ১০৫ রাজাকারকে আটক করে। পরে মুক্তিবাহিনীর দলটি থানা থেকে প্রায় ৮০টি রাইফেল, একটি এলএমজিসহ বহু গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেয়।

৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোদের অপারেশনে বন্দরের কিছু অংশ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ ও ৬ নভেম্বর ১৯৭১ 

টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৫ নভেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক যুগান্তর, ৫ ও ৬ নভেম্বর ১৯৭১ 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

UN Security Council to meet Sunday over US strikes on Iran

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

11h ago