আধুনিক কবি আল মাহমুদ

কবি আল মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্র উত্তর আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায়, বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী, তিনি কবি আল মাহমুদ।

যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়ত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কালের কলসের পরে ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুকদের মাঝেও। এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়। এতে প্রতিটি কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে তিনি নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় অন্যতম কবি। আর এমন কবিই উচ্চারণ করেন:

আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।

উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোন দিনই বিহ্বল করতে পারেনি।

আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,

আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।

পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!

উপরে উল্লেখিত সৃষ্টিতে বিশ্বাসীদের অনুভূতিকে কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয়, শঙ্কা।

এইভাবে আমরা দেখি আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে আল মাহমুদ গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে আশ্চর্য শক্তিময় শব্দ বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, ‘সমকালীন যে দুজন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুনের মতে, ‘তিনি চল্লিশের পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি, নতুন কবি।’

পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ গ্রামে ফিরলেন এবং গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে রচনা করলেন:

এখন কোথায় যাওয়া যায়?

শহীদ এখন টেলিভিশনে।

শামসুর রাহমান সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন।

হাসানের বঙ্গ জননীর নীলাম্বরী বোনা

আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান।

অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, কেননা:

আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে।  (আমার সমস্ত গন্তব্যে)

আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন। তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান। আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন:

আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষির বিষয়

চাষির বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর

কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন

সীমাহীন মাঠ।

চাষির বিষয় নারী।

উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা।

পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।  (কবির বিষয়)

স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন’ সনেট গুচ্ছকে করেছে অন্যান্য।

সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী

যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি

আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি

আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;

ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।

আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রিয়জনকে দিতে কোনো অর্থবিত্ত বা দেনমোহর গুরুত্ব বহন করে না, ভালোবাসা ছাড়া। তাই কবির এইসব পঙক্তিতে বিনয়ের উদার বটপাতায় ভেসে উঠেছে ভালোবাসার চিত্র। ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছ কবি উপমা রূপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষাণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙ্ক্ষার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র। এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীণ প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে:

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল

পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না

তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা  (সোনালী কাবিন)

কবি অতীত গৌরব, সাম্য মানসিকতা, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য, কাম থেকে প্রেম এবং কামকলার অভূতপূর্ব চিত্রায়নের সঙ্গে ধর্মের মিথলজিক্যালের ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজনিষ্ঠ।

তিনি নারী নিসর্গ প্রেম ভালবাসায় নির্মাণ করেছেন নিজস্ব সৌধ। যেখানে তার উপমার তার সঙ্গে চলে। আলোচকরা কবির কাব্য বিশ্লেষণে বের আনেন যে, মার্ক্সিস্ট থেকে ইসলামের বিশ্বাসী হয়েছেন আল মাহমুদ। কিন্তু তারপরও তার কবিতায় দেখছি মাংসের গোলাপ, মিথুনরত কবুতর, ত্রিকোণ কর্দম। কারণ তিনি প্রথমত কবি, শেষত ওই কবিই। ষাটের মান্নান সৈয়দকে আমরা দেখেছি নারী নগ্নতার মধ্য দিয়ে পরাবাস্তবতা ও আধ্যাত্মার কথা বলতে। একই দশকের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের কাম বিষয়ক কবিতার সমগ্রও পাঠকের নজরে এসেছে।

নর-নারীর যুথজীবন যাত্রায় নগ্নতা, রম্যতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা অতি বাস্তব। এই বাস্তবতাকে উপমা চিত্রকল্পে যথার্থ করা, শব্দের এবং চিত্রের অর্থময়তা ও আনন্দময়তা যে কবি যতবেশি দান করতে পারেন নব নব শিল্প চিত্রণে সে তত বড় কবি, তত আধুনিক মানুষ।

Comments

The Daily Star  | English

Abdul Hamid returns home after treatment in Thailand

Two police officials were withdrawn and two others suspended for negligence in duty regarding the former president's departure from the country

7h ago