আপসহীন বদরুদ্দীন উমর

নব্বইতম জন্মদিন অতিক্রম করছেন বদরুদ্দীন উমর। ১৯৩১ সালে ২০ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গাছের ডালপালার মতোই সবুজ আর বিস্তৃত তার পরিবার।

পিতা আবুল হাশিম ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। একজন সাম্যবাদী হিসেবে— পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধী ছিলেন, তবুও পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ১৯৫০ সাল থেকে। তার আগে বর্ধমান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর করেন উমর। উচ্চতর ডিগ্রি নেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে।

এর মধ্যে দেখা যায়, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই ৩ পর্বের জীবনে বিভ্রান্তির শেষ ছিলো না তার। সাতচল্লিশের আগে ও পরে স্থান, কালের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বহু মানুষের জীবন সংগ্রাম দেখেছিলেন। ঠেকেছেন পদে পদে, শিখেছেন বাঁকে বাঁকে।

বাবা আবুল হাশিম ছিলেন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। পণ্ডিত পিতার সাহচর্য পেয়েছেন বদরুদ্দীন উমর। সেই সঙ্গে বংশের সবাই কমবেশি বিভিন্ন দলের রাজনীতি করতেন। বিশেষত, কমিউনিস্ট পার্টিতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও ছিল অনেক। এইভাবে জ্ঞানে গুণে সুবিস্তৃত ছিলো তার পরিবার। মেধা মনন,  প্রজ্ঞার সঙ্গে তৈরি হয় উন্নত রুচিবোধ।

ফলে বহুমুখী প্রশংসার দেশে বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ যখন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন, তখন বদরুদ্দীন উমর স্রোতের বিপরীতেই থেকেছেন। কাটিয়েছেন বাংলা ও বাঙালি সমাজ চিন্তা নিয়ে। এমন নিজস্ব জায়গায় থাকতে ভূমিকা রেখেছে তার সংগ্রামী জীবনের মূল্যবোধ। শুধু তাই নয়, সমৃদ্ধ পরিবার ও দীর্ঘ পঠন-পাঠন থেকে ধীরে ধীরে তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সক্রিয়তাবাদী, ইতিহাসবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং বাংলাদেশের একজন শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হয়ে ওঠেন।

বদরুদ্দীন উমরকে বলা যায় বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম দীক্ষাগুরু। উল্লেখিত চিত্র পাওয়া যায় তার বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির দুইরূপ; বাঙলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিসহ আরও অনেক গ্রন্থে।

একবার এক সাক্ষাৎকার তাকে প্রশ্ন করা হয় 'এখন বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অবস্থা সম্পর্কে' তখন তিনি জবাবে বলেন-  আজকের বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির দুরবস্থা রাতারাতি হয়নি। এর ঐতিহাসিক কারণ আছে। আমাকে শহীদুল্লা কায়সার বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে এখানে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিলো ১২ হাজার। তারপর যখন রণদীভের থিসিসের পরে সন্ত্রাস, নির্যাতন ইত্যাদি হ'লো, কমিউনিস্টদের অনেকে দেশত্যাগ করে চলে গেলেন। এসবের ফলে ১৯৫০-এর পরে এখানে কমিউনিস্টদের সংখ্যা ১২ হাজার থেকে কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ২০০। তার মধ্যেও যারা নেতৃস্থানীয় লোক ছিলেন, তাঁরা এখান থেকে চলে গেলেন। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যের অভাবও এখানে দেখা দিল। আমি ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই, আমি তো আমার পার্টির নেতৃত্বে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুব সামর্থ্যবান কোনো নেতা পাইনি।'

এ রকম বহু সত্য তিনি অকপটে বলেছেন। যা আজকের জন্য ও অনাগত সময়ের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন।

খ.

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন , রাজনীতি ও অর্থনীতি তিন বিষয়ে পড়ে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা।

শিক্ষকতার পাশাপাশি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে 'সংস্কৃতি' নামে একটি রাজনৈতিক সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজ-চিন্তা।  তিন খণ্ডে রচনা করেন পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, যে কাজ তাকে এনে কালজয়ীর খেতাব। বিবেচনা করা হয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় পথিকৃৎ হিসেবে ।

ষাটের দশকে প্রকাশিত হয় 'সাম্প্রদায়িকতা', 'সংস্কৃতির সংকট' ও 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা' নামে তিনটি বই। এইভাবে অবিরত মঞ্চে আলোচনায় ও লেখালেখিতে জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । এ সময় পাকিস্তান সরকারের সাথে তাঁর বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং নিজেই ১৯৬৮ সালে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। রচনা করেন একে একে অসামান্য গ্রন্থ।

তাকে বলা হয় একালের একজন অগ্রগণ্য মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ এবং শীর্ষস্থানীয় চিন্তক। কেবল তাই নয় তার সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতা আজও  প্রবহমান। একই সঙ্গে নানামুখী চিন্তার প্রকাশে রাজনীতি এবং মানুষের সমাজ চিন্তা দুই-ই পরস্পরিক—অবিচ্ছেদ্য।

বদরুদ্দীন উমরের এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় শতাধিক। বাংলা এবং ইংরেজি দু'ভাষাতেই অক্লান্তভাবে লিখেছেন এবং লিখছেন। দু'ভাষাতেই অসামান্য দক্ষতা। উল্লেখযোগ্য তার বইয়ের মধ্যে রয়েছে, 'ইমার্জেন্সি অব বাংলাদেশ', যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ, পশ্চাৎপদ দেশে গণতন্ত্রের সমস্যা, বাঙলাদেশে গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র; বাঙলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি; বাঙলাদেশে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য, সাম্রাজ্যবাদের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা; জনগণের হাতে ক্ষমতা-নির্বাচন না অভ্যুত্থান?; আমাদের সময়কার জীবন ।

রচনাগুলোতে দেখা যাবে সামাজিক দায়ের সাথে ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব। পাওয়া যাবে সাংস্কৃতিক ও সমকালীনতার গুরুত্ব। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় ও মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় প্রয়োজনীয়তা অনেক দিন থাকবে।

বিশেষ করে বদরুদ্দীন উমর মানুষের চিন্তার সঙ্গে সমাজের রাজনৈতিক চরিত্র বিচার করেছেন দীর্ঘকাল। আলোচনা করা বলেন 'উমরের সমস্ত চিন্তাভাবনার গোড়ায় রয়েছে এক মৌলনীতি। চিন্তাক্ষেত্রে তিনি ইতিহাসের সমস্ত ঘটনার মধ্যে রাজনীতির শক্তিকে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। দর্শনগত এই মৌলনীতি তাঁর চিন্তাভাবনার প্রধান কথা।'

তাছাড়া সততা, নিষ্ঠা, আপোষহীনতা, দৃঢ়তা—বিশেষ করে এই ৪টি শব্দের সৌরভে এগিয়ে নিয়েছেন দীর্ঘ জীবন।  জীবন যাপনে চেয়েছেন মানুষের মুক্তি। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও সৃজন ভাবনায়  অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ছিলো মা মাটি মানুষ। সরাসরি অনেক কাজ করেছেন কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গেও । দেশপ্রেমে ও মূল্যবোধের কারণে বদরুদ্দীন উমর সত্য কথাটা নির্ভয়ে এবং পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করতে পারেন। যা  প্রশংসার যুগে দুর্লভ।

প্রসঙ্গত আগামী দিনে বাংলাদেশে কী ধরনের বিপ্লব হওয়া সম্ভব' এমন প্রশ্ন করলে জবাব তিনি বলেন, কখনো বাংলাদেশের বিপ্লব হলে বাংলাদেশের মতো করেই হবে। সেটা করতে হ'লে যারা বিপ্লব করবে, তাদেরকে প্রথমেই চিন্তা-ভাবনায় সাবালক হতে হবে। নাবালকের মতো বাইরে থেকে যা বলছে, সেইভাবে বললে হবে না। আমার দেশের অবস্থা লেনিন-মাও সে-তুংয়ের চেয়ে আমার বেশী বোঝা দরকার। সেটা যদি আমি না বুঝি, তাহ'লে আমি বিপ্লব করতে পারব না।'

এই রকম জটিল বিষয় নিয়েও তার পরিষ্কার চিন্তা ভাবিয়ে তুলে আমাদের। তারুণ্যের কাছে এই জন্য তার প্রাসঙ্গিকতা থাকবে আগামীকাল। আজ নব্বইতম জন্মদিনে আপসহীন বদরুদ্দীন উমরের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

7h ago