আমি বেঁচে নেই, জীবিত আছি: যতীন সরকার

সময়ের অগ্রজ চিন্তাবিদ যতীন সরকার। তার প্রকাশিত ৩৫টি বইয়ের মধ্যে 'সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা', 'পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু-দর্শন', 'বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য', 'প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন' উল্লেখযোগ্য। পেশাগত জীবনে সাহিত্যের কীর্তিমান অধ্যাপক। সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতির পরিসরে তার লেখার উপস্থিতি বলিষ্ঠ। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার।

যতীন সরকার সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টার'র সঙ্গে কথা বলেন।
আপনি কোথায় আছেন?
যতীন সরকার: ২০০৫ সাল থেকে আমি নেত্রকোনায় আছি। পৈতৃক বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। সে বাড়ি এখন বিক্রি করে দিয়েছি। ময়মনসিংহে আমি প্রায় ৪২ বছর কাটিয়েছি। গত ৫/৭ বছর ধরে নেত্রকোনায় শহরতলীতে। এখানে বাড়ি করে আমরা ২ ভাই থাকছি।
আপনি কেমন আছেন?
যতীন সরকার: একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছিলেন 'রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন বেঁচে ছিলেন'। বেঁচে থাকা আর জীবিত থাকা এক কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর বেঁচে মারা গেছেন কিন্তু, তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। মানে সক্রিয় ছিলেন, সৃষ্টিশীল ছিলেন। আর আমার ৮৬ বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে আমি বেঁচে নেই জীবিত আছি মাত্র।
শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ আছেন নিশ্চয়ই?
যতীন সরকার: আমার কোনো রোগ নেই। বয়সের জটিলতা। মূল কারণ আমার মাথায় এখন আর কিছু ধরে না, মনে থাকে না। বলা যায় সব দিক থেকেই অচল হয়ে গেছি। আর আমার একটা ব্যাধি আছে বুকজ্বালা। এর কোনো চিকিৎসা পাচ্ছি না। একজনের পরামর্শে এখন ইউনানির একটা ওষুধ খেয়ে মোটামুটি সহনীয় অবস্থায় আছি।
সময় কাটছে কিভাবে?
যতীন সরকার: আমার ঘুম খুব কম। এর জন্য রাতে খুব কষ্ট হয়। কিছুটা ঘুমাই, কিছুটা জেগে থাকি। ঘুম থেকে সকাল ৬টায় উঠি। সকালে আমার ওষুধ খেতে হয়। তারপর আবার শুয়ে থাকি। বিশ্রাম নিই। তারপর নাস্তা খাই। এরপর, পত্রিকা আসে। পুরোটা পড়তে পারি না। বসে পত্রিকাটা কোনো রকমে চোখ বুলিয়ে যাই।
চেষ্টা করি বই-টই পড়তে কিন্তু, পারি না। দুপুরে গোসল-খাওয়া-দাওয়ার পর একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি।
অনেকের বয়স হলে ডায়াবেটিস বা প্রেশার নিয়ে ঝামেলায় থাকেন।
যতীন সরকার: আমার ঐ সব কিছু নেই। আমি প্রান্তের মানুষ, সাধারণ মানুষ, দরিদ্র মানুষ। ওসব রোগ নেই বলে আমি জীবিত আছি। এই জীবিত থাকাটা আমার জন্যে এখন কষ্টকর।
আপনার সর্বশেষ বই কবে বেরিয়েছিল?
যতীন সরকার: আমার সর্বশেষ বই বেরিয়েছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কথাপ্রকাশ থেকে 'প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা' শিরোনামে।
নতুন কিছু লিখেছেন?
যতীন সরকার: ২০১৮ সালের পর থেকে আর কিছুই লিখতে পারিনি। গত ৩ বছর একটা শব্দও লিখিনি। আমি অনেক চেষ্টা করেও লিখতে পারছি না। তবে ঘরে বসে টক-শো করি। মানে গলাবাজিটা এখনও করতে পারি। যদিও আমার দাঁত নেই, ওপরের পাটির একটাও না। নিচের পাটির কয়েকটা দাঁত ভাঙা তবুও কথা বলতে অসুবিধে হয় না, হাসতেও না।
'পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন' আপনার লেখা বহুল পঠিত বই। এটি আপনার স্মৃতিকথা হলেও স্মৃতির আড়ালে রয়েছে ইতিহাস।
যতীন সরকার: আমি তো এখন পড়াশোনা করতে পারি না। নিজের বইগুলো উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখি। পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন আবার একটু একটু দেখছি। আমার মনে হচ্ছে এই বইটা সেসময় যে কিভাবে লিখেছিলাম তা এখন ভাবি। আমার মোটামুটি একটা কথাও বই থেকে আলাদা করার নেই। সেই দর্শন থেকে সরে আসারও সুযোগ নেই।
এরপরের বই পাকিস্তানের ভূত দর্শন তা কলেবরে অনেক ছোট। এটি অনেক জনপ্রিয় না হলেও এর মধ্যে পাকিস্তান কিভাবে 'ভূত' হয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসলো বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তা ব্যাখ্যা করেছি। এটা যারা পড়েছেন তারা খুব পছন্দ করেছেন। পাকিস্তানের 'জন্মমৃত্যু-দর্শন' আর 'ভূত দর্শন' নিয়েই আমার পাকিস্তানকে দেখা এবং আমার নিজের দেখা থেকেই লেখা।
রাজধানী ছেড়ে প্রান্তিক জায়গায় আছেন। আপনি কি মনে করেন একজন বুদ্ধিজীবীর প্রান্তিক জায়গায় কিংবা কেন্দ্রে থাকায় কোনো পার্থক্য তৈরি করে?
যতীন সরকার: আমি জানি যারা কেন্দ্রে থাকেন তারা নিজেকে অনেক বড় মনে করেন। অনেক সুযোগ-সুবিধে পান। আমি সেগুলো পাই না। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি প্রান্তিক অবস্থানে থাকি। আমি গাঁয়ের মানুষ। আমি নিজেকে 'গাঁইয়া' বলি এবং অনেকে আমাকে 'গাঁইয়া' বলেন। তবে আমি গ্রাম্য না। গ্রাম্যতা দোষে (দুষ্ট) না। আমি গাঁয়ের মানুষ হিসেবে যা দেখেছি এই পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন কিংবা আমি যা দেখেছি তা যদি আমি ঢাকায় থাকতাম তাহলে এগুলো লিখতে পারতাম না। আমি প্রান্তে থেকে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি। ভালো আছি।
আপনার লেখায় অনেক ঐতিহাসিক সত্য ওঠে আসে।
যতীন সরকার: আমি লেখক হয়েছি জেলখানায় গিয়ে। ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ আমি অ্যারেস্ট হই। জেলখানায় ১৮ মাস থাকি। সেখানে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বর্তমান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পাশাপাশি বেডে আমি ছিলাম। তোফায়েল আহমেদসহ আরও অনেকে ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনও ছিলেন। সেখানে সবাই মিলে আড্ডা হতো। আড্ডা না, বলা যায় আলোচনা-সভা হতো। সে আলোচনায় আমি আমার বোধের কথা বলতাম।
তখন সবাই আমাকে বলল, আপনি দারুণ কথা বলেন। আপনি লিখেন না কেন? বলতে গেলে সে সময় তারাই আমাকে জোর করে লেখক বানালেন। আমি জেলখানা থেকে লেখক হয়ে এসেছি এবং আমার ৫০ বছর বয়সে আমার প্রথম বই বেরিয়েছে। এর আগে আমার কোনো বই বের হয়নি। লেখাও তেমন ছাপা হয়নি।
যেহেতু পঞ্চাশের কথা বললেন, তাহলে রাষ্ট্রের ৫০ বছর হলো। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর আমরা কতটা এগিয়েছি বলে মনে করেন?
যতীন সরকার: এগিয়ে যে যাই নাই তা সত্য নয়। এগিয়ে গেছি অনেক কিন্তু যতখানি এগিয়েছে তার থেকে পিছিয়েছি বেশি। অর্থাৎ পাকিস্তানায়ন আমার পাকিস্তানের ভূত দর্শন'র মধ্যে এই বিষয়গুলো বলেছি। অল্প কথায় পুরো বিষয়টা বোঝানো যাবে না। আমার পাকিস্তানের ভূত দর্শন-এ ব্যাপারটা আছে।
বিশেষ করে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে আমার 'স্টুপিড' তৈরির শিক্ষা মনে হয়। তারা হয়তো জানে না— পৃথিবীতে কোনো র্যাডিক্যাল চিন্তার উদ্ভব বা বিস্তারই পাঠশালা থেকে হয়নি, হয়েছে পাঠচক্র থেকে।
আপনি বলছেন আমরা যতটা এগিয়েছি তার চেয়ে পিছিয়েছি বেশি। আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন তো হয়েছে।
যতীন সরকার: অবকাঠামোগত উন্নয়ন ওপর দিক দিয়ে হয়েছে, ভেতরে পাকিস্তানের ভাবধারা নতুনভাবে এসে গেছে। আজকে যে ধর্মীয় মৌলবাদ ধর্মতন্ত্রী এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, তাতে আমাদের যে স্বাধীনতার ৪টি মূলনীতি ছিল, তা পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে। ৪ মূলনীতির সঙ্গে এখন আমাদের সম্পর্ক কী আছে? ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এই সব কথা আর কত বলা যায়?
এগুলো নিয়ে আপনার দুঃখ হয়, বেদনা হয়? সমাজের সার্বিক অবস্থা ভাবায়?
যতীন সরকার: এ নিয়ে তো বেদনা হয়। তবে বিষয়টাকে আমি ঐতিহাসিকভাবে তথা বস্তুতান্ত্রিকভাবে বিশ্লেষণ করি। সেই বিশ্লেষণের ধারায় বলি— এ ধরনের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। এটা ঘটতে বাধ্য হয় নানা কারণে।
কাজেই আমি কখনো নৈরাশ্য নিয়ে ভাবি না। আমি আশাবাদী, নিষ্ক্রিয় আশাবাদী নই। আমি সক্রিয় আশাবাদী এবং বিশ্বাস করি মানুষই এই অব্যবস্থাটা দূর করবে এবং মানুষের হাতেই সত্যিকার অর্থে আমরা যা চেয়েছিলাম স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে সেটি পেয়ে যাব। সাধারণ মানুষের প্রতি বিশ্বাস আছে।
আপনার আশাবাদের জায়গায় কাদের দেখতে পান? শিক্ষা-সংস্কৃতি সাহিত্যিকদের মধ্যে, না রাজনীতিবিদের মধ্যে?
যতীন সরকার: না, না! সাধারণ মানুষদের নিয়ে। আসলে বাংলাদেশ তৈরি করেছে কারা? সাধারণ মানুষ। বাকিরা পালিয়েছে। সেই সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা জাগরণ এখনো ঘটেনি। ফলে নানা জায়গায় যে সব প্রতিবাদী সংগঠন গড়ে ওঠছে, প্রতিবাদ হচ্ছে সেগুলো ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অবস্থানে আছে। বিচ্ছিন্ন অবস্থানে আছে। এগুলো একদিন একত্রিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে এখন তো বললামই আমার বয়স হয়ে গেছে কিন্তু আমার সক্রিয় আশাবাদ এটা। আমি এসব অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করে থাকি।
আপনি অন্ধকারেও আলো খুঁজেন। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। আপনি কী মনে করেন?
যতীন সরকার: সবকিছু দেখে-শুনে হুমায়ুন আজাদের মনে হয়েছে সবকিছু নষ্টদের অধিকারে গেছে। হ্যাঁ, সবকিছু যে নষ্টদের অধিকারে যায় তা মিথ্যা নয়।
আমি মার্কসীয় ডায়লেকটিক্সে বিশ্বাস করি। আমি মনে করি, প্রত্যেক বিষয়েরই অনেকগুলো ডাইমেনশন আছে। সেই ডাইমেনশনগুলো ধরতে হবে। মার্কস বলেছিলেন, দুনিয়াকে এ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে কেবল। আসল কাজ হচ্ছে দুনিয়াকে বদলানো। কারণ, দুনিয়াকে বদলানো বলতে একেবারে সবকিছু বদলানোকে বোঝায়। বদলানোর জন্য যা প্রয়োজন তা করতে হবে। সেই কাজ করতে গিয়েই আমাকে ও আমাদেরকে সক্রিয় আশাবাদে থাকতে হবে।
রবীন্দ্রনাথকে কল্পজগতের স্রষ্টা বলা হয়। আপনি 'আমার রবীন্দ্র অবলোকন' বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন।
যতীন সরকার: আমার পর্যবেক্ষণ— রবীন্দ্রনাথ ভাববাদী কবি হয়েও 'ভাবোন্মাদ' ছিলেন না, বরং ছিলেন অনেক বস্তুবাদীর চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব দৃষ্টির অধিকারী।… ভাববাদী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও রবীন্দ্রনাথ হাঁটতে হাঁটতে যে পথে চলে গিয়েছেন সে পথ মোটেই ভাববাদের নয়। শেষ পর্যন্ত বস্তুবাদের ভূমিতেই নিজেকে হাজির করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর বেঁচে ছিলেন। বয়সে আপনি রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ।
যতীন সরকার: রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন বেঁচে ছিলেন। আমি বেঁচে নেই, জীবিত আছি মাত্র। এটা অনেক সময় বলি, আমি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড়।
'বেঁচে নেই' মানে মারা গেলেন কবে?
যতীন সরকার: ২০১৮ সালের দিকেই মারা গেছি। এখন জীবিত আছি, বেঁচে নেই।
Comments