এখন যৌবন যার… সময়ই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে: হেলাল হাফিজ

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ। মাত্র ২টি কবিতার বই যে জলে আগুন জ্বলে ও বেদনাকে বলেছি কেঁদো না। প্রথম কাব্যগ্রন্থ যে জলে আগুন জ্বলে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ৩৩টির বেশি মুদ্রণ হয়েছে। বেদনাকে বলেছি কেঁদো না প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে।
হেলাল হাফিজ। ছবি: সংগৃহীত

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ। মাত্র ২টি কবিতার বই যে জলে আগুন জ্বলে ও বেদনাকে বলেছি কেঁদো না। প্রথম কাব্যগ্রন্থ যে জলে আগুন জ্বলে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ৩৩টির বেশি মুদ্রণ হয়েছে। বেদনাকে বলেছি কেঁদো না প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে।

১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই কবি মাকে হারান। বাবা ছিলেন কবি ও খ্যাতিমান শিক্ষক। হোটেলের বাসিন্দা কবি হেলাল হাফিজ। একাকী জীবন। কবি হেলাল হাফিজ সাক্ষাৎকার দিতে বা নিজের সম্পর্কে বলতে মোটেই আগ্রহী নন। তবুও কবিতা ও জীবনবোধ নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

শেষ পর্ব

আপনার মাত্র দুটি বই। দুটিতে একশ কবিতাও হবে না। এত কম লেখার কারণ কী?

হেলাল হাফিজ: আমি হয়ত কম প্রতিভাবান। আলস্য প্রিয় মানুষ। অধিক খাটুনি আমার ভালো লাগে না।

আপনার হোটেল জীবনের তাৎপর্য কী?

হেলাল হাফিজ: আমি হোটেল জীবন এনজয় করি। নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা আমার ভালো লাগে। একাকীত্বের এই বেদনাকে আমি উপভোগ করি।

'আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে

মানুষের কাছে এও তো আমার এক ধরনের ঋণ।

এমনই কপাল আমার

অপরিশোধ্য এই ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।'

হোটেল জীবনের আগে কোথায় ছিলেন?

হেলাল হাফিজ: পুরানা পল্টনে ছিলাম। আমার বন্ধু শফিকুল আজিজ মুকুল 'বাংলার বাণী'তে কাজ করতো। 'বাংলার বাণী' পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিল। মুকুল আর আমি এক বাসায় ৮ বছর ছিলাম। তার আগে বড় ভাইয়ের বাসায়। তার আগে আমেরিকায় ছিলাম। আবার বড় ভাইয়ের বাসায়। তারপর আবার তোপখানা রোডে হোটেলে। আর শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চার বছর হলে ছিলাম। প্রথম কর্ম জীবনের চার বছরও হলে ছিলাম। মোট আট বছর (১৯৬৭-১৯৭৫) হলে ছিলাম। স্বাধীনতার আগে ইকবাল হল, পরে সার্জেন্ট জহুরুল হক। স্যার'রা বলতেন, তুমি থাকো, তুমি থাকো, কই যাবা। এই সুবিধা- 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়'র 'এখন যৌবন যার' কবিতা লেখার কারণে আমার উপরি পাওয়া। সবাই আদর করতেন। তখন এখনকার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈরাজ্য ছিল না।

আমি যখন ছাত্র তখনই চাকরি হয়ে যায় দৈনিক পূর্বদেশ-এ। এক কবিতায় চাকরি হয়ে গেল আমার। কিছুদিন পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। বাকশাল গঠন হলে কেবলমাত্র ৪টি পত্রিকা- 'দৈনিক বাংলা', 'ইত্তেফাক', ইংরেজি কাগজ 'টাইমস' আর 'অবজারভার' থাকে, বাকি সব বন্ধ।

হেলাল হাফিজ। ছবি: সংগৃহীত

বাকশাল বিষয়ে আপনার কোনো পর্যালোচনা আছে?

হেলাল হাফিজ: কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলাপ করতে আগ্রহী নই। এর অর্থ এই না যে, আমি রাজনীতি বিমুখ মানুষ। কিন্তু কথা বলতে চাই না। আমি কখনও ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, না ছাত্রজীবনে, না কর্মজীবনে।

মানুষ তো রাজনীতির বাইরে না।

হেলাল হাফিজ: তা তো অবশ্যই। মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনীতি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। মানুষ চাক বা না চাক।

সাহিত্যেও রাজনীতি আছে। এ জগতে কেউ আপনাকে কোণঠাসা করতে চেয়েছিল কখনও?

হেলাল হাফিজ: না, না কেউ আমার সঙ্গে এমন করেননি। সবাই আদর করতেন। ঘটনা হচ্ছে একটি কবিতা 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' আমার পুরো জীবন পাল্টে দিলো। যা পেয়েছি জীবনে, তার পেছনে এই কবিতার অবদান অনেক। ১৯৬৯ সালে কবিতা লেখার পর ক্যাম্পাসে রাতারাতি আমি তারকা। বিখ্যাত করে দিলো মানে বিখ্যাত বানিয়ে দিলো। আহমদ ছফা ও কবি হুমায়ুন কবির কবিতার প্রথম দুই লাইন একরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে দিলো। তারা দুজন তখন আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের লোক। হুমায়ুন কবিরকে তো পরে গুলি করে মেরেই ফেলল। সিরাজ সিকদার গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে। যাক সেগুলো অন্য কাহিনী।

কবিতাটি এতোটা জনপ্রিয় ছিল, টিএসসির দিকে গেলে মেয়েরা একজন অন্যজনকে বলতো- ওই দেখ দেখ 'এখন যৌবন যার' যায়, যৌবন যার…। বলাবলি করত, ওই যে কবি যায়। আমার নাম হেলাল আর বলতো না, কবিতার কথা বলতো।

যে জাগরণের প্রেক্ষাপটে কবিতাটি লিখেছেন, এখন এমন হলে লিখতে পারতেন?

হেলাল হাফিজ: 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়' কবিতাটি সময়ই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। আর ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনে দেশ কতটা টালমাটাল ছিল এখনকার ছেলে-মেয়েরা তা চিন্তাও করতে পারবে না। আজকাল তো মিছিল-মিটিং হয় টাকা-পয়সা দিয়ে। এ রকম হতো না সেসময়। আদর্শের ব্যাপার ছিল। আমি কিন্তু কখনও কোনো রাজনীতি বা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তবে ভেতরে-ভেতরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বপ্ন-প্রত্যাশার ব্যাপারটি বুঝতাম। তাই লিখতে পেরেছি।

বর্তমানে তরুণদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন? এমন তরুণ চোখে পড়ে?

হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, দেখি। তারা সংখ্যায় কম। কিন্তু আছে। আশাবাদী মানুষ আমি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার অনেক স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছর হলো। এই নিয়ে আপনার মতামত কী?

হেলাল হাফিজ: ভাষা আন্দোলনসহ আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেতনার উন্মেষ কেন্দ্র। যেকোনো গণআন্দোলন গণ-মানুষের দাবিতে সংগঠিত হতে এখানকার ছাত্র-শিক্ষকের অবদান থাকে।

কেন্দ্রে থাকার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক ঘটনার সাক্ষীও বলা যায়। কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মৌলিক কাজ, তা কতটা সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করেন?

হেলাল হাফিজ: তা তো প্রথম থেকেই ঢিলেঢালা। সাহিত্য-সংস্কৃতি-গবেষণা নিয়ে দীর্ঘসময়ের আন্তরিকতা ও সিরিয়াসনেসের অভাব। যা অপ্রত্যাশিত।

এই অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' বলা কি বেমানান?

হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, ঠিক তাই। মানেও নেই, গুণেও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেউ আর বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করেন না। কেবল বড় বড় বিল্ডিং করলেই হবে না। মূল কাজটা ঠিকভাবে করতে হবে।

একইভাবে রাষ্ট্রের ৫০ বছরেও উন্নয়নের জোয়ার। অনেক বড় বড় দালান, রাস্তা, ব্রিজ হচ্ছে। দৃশ্যমান উন্নয়নের শেষ নেই। কিন্তু মূল্যবোধের অভাব রয়েছে।

এই দায় কেবল সরকারের না। জনগণের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদেরও দায় ও দায়িত্ব আছে। দৃশ্যমান উন্নয়নের চেয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। বাংলাদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসার অবস্থা ভয়াবহ। সার্বিক বিষয়ে খেয়াল করলে দেখা যায়, আমাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু দায় আছে। তা-ও নজরে আনতে হবে। আমার একটা কবিতা চার লাইন- 

'কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,

সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ

সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।'

Comments