গ্রন্থাগারিক সংকটে পাঠাগার, দিনদিন কমছে পাঠক
বইকে ঘিরে সারা দেশে রয়েছে অসংখ্য পাঠাগার, তবে কমছে পাঠক। কারণ হিসেবে উঠে আসছে— বেসরকারি বেশিরভাগ পাঠাগারে নেই গ্রন্থাগারিক, পাঠকের চাহিদা মতো বইয়েরও সংকট। ব্যক্তিগত উদ্যাগে গড়ে উঠা পাঠাগারে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও খুব কম। পাঠাগারগুলোর হয়নি আধুনিকায়ন। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ পাঠাগারও থাকে বন্ধ।
সারা দেশে সরকারি গ্রন্থাগার আছে ৭১টি। এর বাইরে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত ১ হাজার ৫৩২টি গ্রন্থাগার সরকারিভাবে নিবন্ধিত। বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতির প্রকাশনা থেকে পাওয়া যায় বেসরকারি গ্রন্থাগার আছে ১ হাজার ৩৭৬টি। পাঠাগার আন্দোলন বাংলাদেশ নামক সংগঠন দাবি করছে, কেবলমাত্র ৪৭টি জেলায় ২ হাজার ৫০০টি পাঠাগার আছে। তবে দেশে গ্রন্থাগার বা পাঠাগার কতটি, সে হিসাব সরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই।
গণগ্রন্থাগার সমিতি দেশের সব গণগ্রন্থাগারের তথ্যসংবলিত গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও নতুন করে নির্দেশিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারি ৭১টি গ্রন্থাগারকে দেখভালের দায়িত্বে আছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। বেসরকারি গ্রন্থাগারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। দুটো প্রতিষ্ঠানই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে সরকার বার্ষিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এর মধ্যে অর্ধেক টাকা চেকের মাধ্যমে এবং অর্ধেক টাকার বই গ্রন্থকেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা হয়। গত বছর দেশের ১ হাজার ১০টি বেসরকারি পাঠাগারকে ক, খ, গ—৩টি শ্রেণিতে ভাগ করে অনুদান দেওয়া হয়। গত অর্থবছরে ক শ্রেণির একেকটি পাঠাগার বছরে ৫৬ হাজার টাকা, খ শ্রেণির পাঠাগার ৪০ হাজার টাকা এবং গ শ্রেণির পাঠাগার ৩৫ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে। মোট বাজেট ছিলো ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের গ্রন্থাগারিক মো. ফরিদউদ্দিন সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ৫৮৭টি পাঠাগারকে তালিকাভুক্ত করেছে। এই তালিকাভুক্তি সনদ কেবলমাত্র সরকারি অনুদান প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এ ছাড়া পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক একবার প্রশিক্ষণ করতে পারেন। অনুদান না পেলে বই উপহার পেতে পারেন।'
অন্যদিকে পাঠাগার উদ্যোক্তরা দীর্ঘদিন ধরেই অনুদান বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা বলেন, পাঠাগারের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্রন্থাগারিকের বেতনসহ ঢাকায় একটি পাঠাগার পরিচালনার ব্যয় মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ঢাকার বাইরে জেলা বা উপজেলা সদরে তা ১০ হাজার টাকার কম নয়। কিন্তু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা একটি পাঠাগারের ২ মাসের খরচও হয় না। বেসরকারি পাঠাগারগুলোর উদ্যোক্তারা অন্তত একজন গ্রন্থাগারিকের বেতনটা সরকারিভাবে দেওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছে না।
বেসরকারি উদ্যোগে ১০ বছর আগে চালু হয়েছিল কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামে মজুমদার লাইব্রেরি। প্রথম দিকে ভালোই চলছিল। তবে সেই পাঠাগারে নেই স্থায়ী গ্রন্থাগারিক, নেই বরাদ্দও। ফলে, তালা পড়েছে পাঠাগারে। প্রায় ২ হাজার বইয়ের লাইব্রেরি আজ বন্ধ। এক সময় শিক্ষার্থীরা এসে বই দেওয়া-নেওয়া করতো। পছন্দ মতো বই ও স্থায়ী গ্রন্থাগারিক না থাকায় বন্ধ থাকে প্রায়। পাঠাগার খোলা রাখার সময়ও কমেছে। এমন চিত্র দেশের প্রায় সব বেসরকারি পাঠাগারের।
২ বছর আগে পাঠাগার আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি মো. ইমাম হোসাইন ২০ দফা দাবি তুলে ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। তার মধ্যে অন্যতম ২টি দাবি ছিল—গণগ্রন্থাগারগুলো সার্বক্ষণিক পাঠক সেবা ও অন্যান্য সেবা প্রদান করার জন্য একজন লাইব্রেরিয়ানের সম্মানী সরকারিভাবে প্রদান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'–এর স্বপ্নপূরণে এবং প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিটি গ্রন্থাগারে সরকারিভাবে 'ইন্টারনেট কর্নার' নির্মাণ।
বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগারের সভাপতি এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদের কাছে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি আমরা বেসরকারি গ্রন্থাগার এমপিওভুক্তির দাবি তুলে ধরি। এমপিও না হলেও অন্তত গ্রন্থাগারিকের জন্য ভাতা চালু করা যায় কি না, ভেবে দেখার আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে দাবি জানিয়ে আসছি, অনুদান কমিটিতে পাঠাগারের যেন প্রতিনিধি থাকে। কিন্তু ফল পাইনি।'
শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগারের সম্পাদক আনিসুল হোসেন (তারেক) বলেন, 'পল্লীমা সংসদের প্রথম অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাকী স্মৃতি পাঠাগারের যাত্রা ৫০ বছর আগে। পাঠাগারে ২ জন লাইব্রেরিয়ান আছে। আমরা অনুদান যা পাই তাতে চলে না। আমাদের অনেক কাজ, আমাদের অনেক ব্যয়। ঘাটতির টাকা পল্লীমা সংসদ থেকে আসে। যারা ভালো কাজ করে, বাজেট সামনে রেখে নির্বাচিত পাঠাগার নিয়ে সরকারকে বিশেষ বিবেচনার জন্য অনুরোধ করব।'
দনিয়া পাঠাগারের সভাপতি মো. শাহনেওয়াজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় দৈনিক পাঠাগার পরিচালনা, খোলা, বন্ধ করা স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে লাইব্রেরিয়ানের কাজ করানো যেতো, এখন আর পাওয়া যায় না। সেই রকম পাঠক কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এই জন্য চাই সংস্কৃতিতে অন্তত বাজেটের ১ শতাংশ বরাদ্দ। আর্থিক সাহায্য পেলে পাঠাগার পরিচালনায় সহজ হবে। তার জন্য আমি মনে করি বছরে একেকটি পাঠাগারকে ১ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া উচিৎ।'
এ বিষয়ে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেসরকারি পাঠাগারের আবেদনের ভিত্তিকে আমরা কেবল তালিকাভুক্ত করি। বাকি কাজ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র করে থাকে। আমরা এই পর্যন্ত ৯৪৫টি পাঠাগারকে তালিকাভুক্তি সনদ দিয়েছি।'
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সব সময় বেসরকারি পাঠাগারকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে। গত বছর ৩টি ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ১০টি পাঠাগারকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার পাঠাগারে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্নার করা হয়েছে। যারা অনুদান পায়নি এমন ৩ শতাধিক পাঠাগারে বই উপহার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর ৩০০ ও চলতি বছর ১১০ পাঠাগারের গ্রন্থাগারিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আরও কীভাবে কাজ করা যায়, নির্বাচিত পাঠাগারগুলোকে ডিজিটাল করার পরিকল্পনা চলছে।'
সক্রিয় পাঠাগারগুলোরও অনেক সংকট। অনুদান যথেষ্ট নয়, তাদের ক্ষেত্রে কী পরিকল্পনা? কেন পাঠক কমছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'বেসরকারি পাঠাগারের সকল খরচ আমাদের দেওয়ার সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কী ভাবছে আমার জানা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসা উচিৎ বলে আমি মনে করি।'
আর পাঠক কমছে সত্য। কারণ এখন আর কেউ বই পড়তে বলে না। পরিবার থেকে সৃজনশীল পড়ার কথা বলে না, স্কুলে কলেজের শিক্ষকরাও বই পড়ে না, শিক্ষার্থীদেরও বই পড়তে উৎসাহিত করে না। ফলে বইপড়ুয়া সমাজ গড়ে উঠছে না। '
অভিযোগ আছে যে, পাঠাগারগুলো তাদের চাহিদা মত বই পায় না। এই বিষয়ে মিনার মনসুর বলেন, 'বছরে আমরা ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই কিনি। সেখান থেকে গ্রন্থাগারিকরা দেখে বই নিতে পারেন। নির্দিষ্ট কারো চাহিদা মত বই দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে কেউ লিখিতভাবে চাহিদা জানালে বই কেনার সময় বিবেচনায় রাখি আমরা।'
কেমন পাঠক কেন্দ্রে এসে বই পড়ে? এ নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিয়ান সাদিয়া আফরোজ নিশাত বলেন, করোনার আগে প্রতিদিন ৭০-৮০জন আসতো, এখন সেটা ৪০-৫০জনে নেমে এসেছে। কেন্দ্রে পাঠক কমার কারণ হিসেবে দেখি, অনেকে এখন পিডিএফ পড়তে অভ্যস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ার দক্ষতা ও পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রুম টু রিড কাজ করছেন দীর্ঘ সময়। এই বিষয় রুম টু রিড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর রাখী সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'বইয়ের কার্যক্রম নিয়ে আমরা একটা পরিকল্পনায় কাজ করি। তাই আমাদের উদ্যাগে শিক্ষার্থীদের ধীরে ধীরে পাঠ অভ্যাস গড়ে উঠছে। তাছাড়া আমরা একেবারে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে কথা বলি। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপযোগী বই নিয়ে 'বুক ক্যাপ্টেন' এর মাধ্যমে কাজ করি। সেই সঙ্গে আগ্রহ ও ক্লাস বিবেচনায় আমরা নিজেরা বই প্রকাশ করি। ঢাকাসহ দেশের ৪টি জেলায় ২০০৯ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের বইপাঠ নিয়ে কার্যক্রম চলছে।'
বাংলা একাডেমি এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক, গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞ ফজলে রাব্বি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গণতন্ত্র, গণশিক্ষা ও গণগ্রন্থগার কোনোটিইতো আমার দেশে সফল ও সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। গণতন্ত্র ও গণশিক্ষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা কিছু করতে পারি না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কিছু কাজ করতে পারি একমাত্র গণগ্রন্থগার উন্নয়ন নিয়ে। এ ক্ষেত্রেও যদি সরকার আন্তরিকতা না দেখায়, সহযোগিতা না করে তাহলে আগামী অন্ধকার।'
কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালনা পরিষদের সদস্য সেলিনা হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাঠাগার নিয়ে সরকারের বাজেট বাড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। তা না হলে সমাজে অন্ধকার নেমে আসবে। গণ মানুষের প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চা আর কত নিজের থেকে করবে? বেসরকারি পাঠাগারের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিৎ।'
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবাই বলছে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কোন দিকে? মনে রাখতে হবে উন্নয়নের বিরাট একটা অংশ সংস্কৃতি, সংস্কৃতির অংশ পাঠাগার। পাঠাগার মানুষকে নানান বিষয় জানতে বুঝতে ভূমিকা রাখে। আধুনিক যুগে মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া কোনো উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আর মানসিক স্বাস্থ্য সুন্দর রাখতে গভীরভাবে কাজ করে বই ও পাঠাগার, তথা সংস্কৃতির অবিরাম চর্চা।'
তিনি আরও বলেন, 'ব্যক্তিগত উদ্যাগে গড়ে ওঠা পাঠাগারগুলোর দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে, বরাদ্ধ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে গ্রন্থাগারিকদের বারবার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর পাঠাগারগুলো টিকিয়ে রাখতে সমাজের অন্যদেরও এগিয়ে আসতে হবে।'
এসব বিষয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের বেসরকারি পাঠাগারগুলো সক্রিয় রাখার জন্য আপাতত একজন গ্রন্থাগারিকের বেতন দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে আমরা অনুদান ছাড়াও কিছু এককালীন অনুদান দিয়ে থাকি, তা থেকে বেতন দিতে পারেন তারা। যদিও সেটা কাগজে লেখা থাকে না কিন্তু সেদিক বিবেচনা করেই অনুদানটা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে অনুদানে আর্থিক পরিমান বাড়ানোর চিন্তা আছে আমাদের।'
Comments