শ্রদ্ধা

ছেলেবেলার সঙ্গী লীলা মজুমদার

সাহিত্য সংস্কৃতি প্রিয় বাঙালির ছেলেবেলাকে যিনি রাঙিয়ে দিয়েছেন তিনি লীলা মজুমদার। তিনি তার সাহিত্য জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে নিয়েছেন চিরায়ত বাংলাকে। ফলত বাংলা শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক যারা, তাদের পাশাপাশি লীলা মজুমদারের নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে। 

তার বহুল পঠিত লেখা 'পদিপিসির বর্মিবাক্স', 'টংলিং', 'হলদে পাখির পালক', 'সব ভুতুড়ে', 'মেঘের শাড়ি ধরতে নারী' 'গুপীর গুপ্তখাতা', 'মাকু', 'ছোটদের তাল বেতাল' আজও ভুলতে পারে না অনেকে। ক্লাসের বাইরে আনন্দ পাঠে প্রয়োগে স্মরণ করে তাকে।  বাংলা সাহিত্যে শতায়ু লাভ করেছেন যে দু-একজন সাহিত্যিক তাদের মধ্যে লীলা মজুমদার একজন।

পারিবারিকভাবেই লেখালেখির পরিবেশে বড় হয়েছেন। ভারতের বিখ্যাত রায় পরিবারে তার জন্ম। রায় পরিবারের প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর সন্তান লীলা মজুমদার। সম্পর্কে লেখক সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন ও বিখ্যাত ভারতীয় পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পিসি তিনি। 

ছোটবেলা কেটেছে শিলঙের মেঘ-পাহাড়ে। লেখালেখির শুরুটাও করেন পাহাড়ি শহর শিলঙে। ফলে খুব ছোট থেকেই চার পাশে গল্পরা ঘুরে বেড়াত। উঁকি দিতো বিভিন্ন চরিত্র। কথা বলতো চুপিচুপি। জানা যায়, স্কুলের 'প্রসূন' পত্রিকায় হাত পাকানোর পালা শুরু হয়েছিল। বাড়িতে বানিয়ে বানিয়ে এমন করে ঘটনার বর্ণনা দিতেন, মনে হতো বুঝি সত্যিই ঘটেছে। দেখা জীবন থেকে লিখেছে এমন বর্ণনা। বাড়ির সবাই অবাক হয়ে যেতো। এর জন্য কখনো কখনো মায়ের বকুনিও খেয়েছেন লীলা।

প্রসঙ্গত তিনি লিখেন 'শিলং পাহাড়ে থাকতাম, সরল বনের মধ্যে হাওয়া দিলে সোঁ সোঁ শব্দ হত। ঠিক যেন লুকনো কথা বলে দিচ্ছে। দুটো পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইলে গোঁ গোঁ শব্দ হত। মনে হত ওইখানে কোনও গোপন জায়গায় শেকল দিয়ে দৈত্য বাঁধা আছে, ছাড়াবার চেষ্টা করছে। পাহাড়ি আয়ারাও গল্প বলত। সে সব দুঃখের গল্প, হারানোর গল্প, না পাওয়ার গল্প, কষ্টের গল্প। শুনে কান্না পেত।'

লীলা মজুমদার বিশ্বভারতীতে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপরে আশুতোষ কলেজে যোগ দেন। এখান থেকেও  চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। দুই দশক এভাবে কাটিয়ে আকাশবাণীতে যোগ দেন প্রযোজক হিসেবে। ৭-৮ বছর পর ফের চাকরি ছেড়ে শুরু করেন সাহিত্য চর্চা। পাশাপাশি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের সন্দেশ পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। এই সময়ে তার স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য অবসর নেন। 

১৯৫৬ থেকে সাহিত্যবাসর ও কথিকা বিভাগের (প্রযোজক) দায়িত্বে ছিলেন লীলা মজুমদার। ছবি সংগ্রহীত

সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর তাগিদে প্রথম বড়দের গল্প 'সোনালি রুপালি' প্রকাশিত হয় 'বৈশাখী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদও করেন। এর মধ্যে কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় একদিন লীলা মজুমদারের কাছে এলেন তাঁর 'রংমশাল' পত্রিকার জন্য একটি কিশোর উপন্যাস লেখার অনুরোধে। লীলার মনে হল তখন, 'এ আবার কেমন কথা? উপন্যাস লিখেছি নাকি কখনো? চাইলি কি আর লেখা যায়,  তবু রাতে সেই কথা ভাবতে ভাবতে ঝপ করে একটা গল্প জন্মাল। সে রাতেই লেখা হয়েছিল বিখ্যাত 'পদিপিসির বর্মিবাক্স। 

অন্যদিকে সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি লীলা মজুমদার অনুবাদ করেছেন। প্রায় আট দশকের বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবনে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য বাংলা গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস। বিশেষ করে তার বিচরণ ছিল সবচেয়ে বেশি শিশু সাহিত্যে। শিশুদের আনন্দ দিতেই একের পর এক রচনা করেছেন শিশুতোষ গ্রন্থ। ভাষার দখলও ছিলও অসামান্য। জ্ঞান ও অনুভূতির মেলবন্ধনে তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্যা।

প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মূল্যায়ন করে বলেন "লীলা মজুমদার একটি বিশেষ সমাজের বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত বর্ষিয়সী নারী গোষ্ঠীর মনের চিত্র আঁকিয়া উপন্যাস ক্ষেত্রে কিছুটা নূতনত্বের প্রবর্তন করিয়াছেন। ইহার ঔপন্যাসিক মূল্য ছাড়াও একটি সমাজ পরিচয় গত মূল্য আছে।"

এক কথায় শিশুমনের উপযোগী সরস গল্প ও অ্যাডভেঞ্চারের গল্প তাকে জনপ্রিয় এবং শক্তিমান লেখিকার স্বীকৃতি দান করেছে। যেমন এক গল্পে তিনি লিখেন, যেদিন কাদা চিংড়ির ছ্যাচড়া মুখে রুচবে না, আর বাংলা ভাষা কানে মিষ্টি ঠেকবে না, সেদিন কিন্তু ঘোর দুর্দিন। উন্নতি হইতে সাবধান‌। শেষটা না পা পিছলে আলুর দম হয়।"

এভাবে, হাসি আর সুক্ষ্ম রসবোধে তুচ্ছ জিনিসও উপস্থাপনার গুণে হয়ে ওঠে অনন্য। চিত্রে বিত্তে ভালো লাগায়। সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে শৈশব যখন সৃষ্টিশীল কল্পনার প্রতি বিমুখ, আনন্দের উপকরণের হাতছানিতে দিশেহারা, তখন লীলা মজুমদার হয়ে উঠতে পারে শিশু মনকে যুক্তিবাদী, সজীব, সতেজ করার প্রাসঙ্গিক মহৌষধি।

এই ছাড়া রায়চৌধুরী পরিবারের নানা মজার ঘটনাবলী ও বাংলা সাহিত্যের মালঞ্চে তার দীর্ঘ পরিভ্রমণের কথা বর্ণিত হয়েছে। তার প্রথম আত্মজীবনী 'আর কোনখানে'-এর জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান।

সারাজীবনের সাহিত্য কীর্তির স্বীকৃতি পেয়েছেন ভারত সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার। দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করার পরে ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল আজকের দিনে কলকাতায় মারা যান। 

Comments

The Daily Star  | English

Govt officials, law enforcers, politicos involved

Finds probe body; ACC preliminary report names 42 perpetrators

1h ago