জীবনশিল্পী ইফফাত আরা

ইফফাত আরা। ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আধুনিক চিন্তার নারী নওয়াব ফয়জুনন্নেসা চৌধুরানীর হাত ধরে বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের আবির্ভাব। তাদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে মানুষের আগ্রহ অসীম। অনেক লড়াই করে তবেই নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিলেন তারা, হয়েছিলেন আপন মহিমায় উজ্জ্বল। অনেক বিষয়ে তাদের কীর্তি এখনো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।

কিন্তু, কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যপত্র দ্বিতীয় চিন্তার সম্পাদক ও সাহিত্যের সংগঠক ইফফাত আরার তেমন কোনো আত্মিক পরিচয় ছিল না তার পূর্বসূরিদের সঙ্গে। পিতা মৌলভী কাজী আবদুল হাকিমের উর্দু ও ফারসি সাহিত্য পড়ার ঐতিহ্য তিনি কিছুটা ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু, তার জীবন ভরপুর হয়ে উঠেছিল কর্মস্পৃহার প্রেরণায়। একটি রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশের সকল ভ্রূকুটি তিনি অতিক্রম করেছিলেন নিঃশব্দে; প্রশিক্ষিত গেরিলার মতো দখল করে নিয়েছিলেন নিজস্ব অবস্থান।

শামসুন নাহার ইফফাত আরা ছিলেন কারো কাছে আপা, কারো কাছে খালাম্মা। গত ১৪ আগস্ট মধ্য রাতে তার মৃত্যু হলে ময়মনসিংহের সাহিত্য মহলে নেমে আসে শোকের ছায়া।

তাকে নিয়ে কবি হেলাল হাফিজের অবিস্মরণীয় একটি বাণী আছে। ১৯৯৪ সালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'ছেলের পাঠানো টাকা দিয়ে গহনা না কিনে একজন মহীয়সী নারী সাহিত্যপত্র প্রকাশ করেন যে শহর থেকে, সে শহরের নাম ময়মনসিংহ।'

লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেছেন, 'ইফফাত আরার জীবনী লোমহর্ষক।' সব মিলে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তার সফলতা বহুমাত্রিক।

১৯৫৫ সালে বিয়ের পর ছয়-ছয়টি প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ও ডিগ্রি অর্জন করেছেন। রান্না করতে করতে পাঠ করেছেন ব্লুমফিল্ডের ভাষাবিজ্ঞানের বই। মুখস্থ করেছেন চর্যাপদের শ্লোক 'উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই শবরী বালী/ মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ শবরী গিবত গুঞ্জরী মাল'। জননেতা মওলানা ভাসানী বাসায় এলে শতশত মানুষের জন্য চা বানিয়ে দিয়েছেন। ১৯৬৯'র আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় বাসায় পুলিশ এলে লুকিয়ে থাকা আন্দোলনকারীদের বাঁচাতে তিনি দরজা থেকে সরকারি বাহিনীকে বিদায় করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি শহরের স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭১ সালে স্কুলের হিন্দু সহশিক্ষিকাকে আশ্রয় দিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে।

১৯৮৬ সালে তিনি নিজ বাসভবনে ছাপাখানা 'দেশ মুদ্রণ' স্থাপন করেছেন। তিনি যখন দেশ মুদ্রণ চালু করেন তখন 'বাংলার দর্পণ' পত্রিকার সম্পাদক হাবিবুর রহমান শেখ হেসে বলেছিলেন, 'আপনি হলেন ময়মনসিংহের প্রথম নারী ব্যবসায়ী।' ছাপাখানা চালুর পর অচিরেই প্রকাশ করেছেন নিয়মিত সাহিত্যপত্র মাসিক 'দ্বিতীয় চিন্তা'।  চালু করেছেন প্রকাশনা সংস্থা দেশ প্রকাশন। দেশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০টির বেশি।

প্রুফ দেখায় তার সকাল-দুপুর গড়িয়ে গেছে। ফাঁকে ফাঁকে কলম তুলে নিয়ে গল্প লিখেছেন। দ্বিতীয় চিন্তা'র জন্য সম্পাদকীয় লিখেছেন। কখনো বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম-ত্রিপুরার বিভিন্ন জেলার কবি-লেখকদের চিঠির জবাব লিখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।

খ.

ইফফাত আরার জন্মগ্রহণ ১৯৩৯ সালে কিশোরগঞ্জে। জীবনের অধিকাংশ সময় বসবাস করেছেন ময়মনসিংহে। কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে তার শিক্ষা জীবন শুরু। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্যে ছোটবেলায় সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে পড়ালেখা বন্ধ করে দেয় পরিবার। ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে তৎকালীন সময়ে মেয়েদের উচ্চশিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করা হতো।

এমন সামাজিক বেড়াজাল টপকে ইফফাত আরা বিদ্যাময়ী গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হন। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ১৯৫৫ সালে আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ আবদুল লতিফ তালুকদারের সঙ্গে বিয়ে হয়। সংসার সামলিয়ে স্বামীর আন্তরিক সহযোগিতায় বিবাহিত জীবনের দশ বছর পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসেন এবং সিএড, স্নাতক ও বি.এড করেন। আনন্দমোহন কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেন ১৯৭৯ সালে।

১৯৬৬ সালে তিনি অল পাকিস্তানে উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনস'র সদস্যপদ পাওয়ার পর থেকে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় হন। কিছু দিন পর ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার পদ থেকে অবসর নেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সাপ্তাহিক বাংলার দর্পণ-এর নারী পাতার সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে একই প্রকাশনা যখন মাসিক চন্দ্রাকাশ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন তাকে প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১৯৭২ সালের শুরুতে তিনি সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে জাতীয় মহিলা সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেন। তার সহযাত্রী ছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক হেলেনা খান, রাজনীতিবিদ মরিয়ম হাসিমুদ্দিন, সমাজকর্মী সুফিয়া করিম প্রমুখ। তার হাত ধরেই জাতীয় মহিলা সংস্থা-এর ময়মনসিংহ অধ্যায়ের সূচনা। কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক ছাড়াও তাকে নারী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান রূপকার বলা হয়।

নারী স্বাধীনতার একজন আদর্শ ইফফাত আরা। সেই সঙ্গে সমাজকে এগিয়ে নিতে গবেষণা করেছেন পারিবারিক মনস্তত্ব নিয়ে।  যাপিত জীবনের পাঠ পেয়েছেন পারিবারিক মণ্ডলে। সময়টা অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও আলো ধরার একাগ্রতা ছিলো মনে প্রাণে। ১৯৬০ থেকে ২০০০ সাল অবধি প্রকাশিত নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধে তার সমাজভাবনা ও নারীপ্রগতির কথা উঠে এসেছে। এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, 'নারীস্বাধীনতা শব্দটি আমি প্রয়োগ করে আসছি ষাটের দশক থেকে। কিন্তু মাঝেমাঝে মনে হয় এ শব্দটি যথাযথ নয়। কারণ এ শব্দের উল্টো পিঠে আছে নারীকে বেঁধে রাখার চিত্রকল্প যা বাস্তবানুগ নয়। নারীকে কেউ বেঁধে রাখেনি। আমাদের নারীপ্রগতির কথা বলা উচিত।'

জীবনানন্দ দাশের 'কল্যাণী' সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে ইফফাত আরা লিখেছেন, 'অনেক আগে লেখা হলেও এটি একটি নারীবাদী উপন্যাস।' স্মরণ করা যেতে পারে জীবনানন্দ দাশ এ উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন ১৯৩৪ সালে। ভিন্ন একটি প্রবন্ধে নারীবাদের সমস্যা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'নারীবাদীরা অনেকসময় নারীমুক্তির নামে স্বেচ্ছাচারিতা অবলম্বন করে সমাজে নারীপ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা ডেকে আনে।' নারী প্রগতি বিষয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার  অনেক প্রবন্ধ।

ইফফাত আরার সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত পঞ্চাশের দশকে ছোটগল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে। প্রথম গল্প ছাপা হয়েছিল  মাসিক আজাদ পত্রিকায়। তারা চেনা জীবনই তার গল্পের উপজীব্য। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, যে সমাজে তিনি বাস করেছেন সেই সমাজের অসঙ্গতির কথা, মানুষের দারিদ্র, ব্যর্থতা ও অসহায় পরিণতির গল্প, এবং প্রেম ও বিচ্ছেদে দীর্ণ মানুষের মনস্তত্ব তার লেখনীর মধ্য দিয়ে আখ্যায়িত হয়েছে।

উপন্যাস ও শিশু সাহিত্যসহ এগারোটি বই প্রকাশ হয়েছে তার।  সম্পাদনা করেছেন 'বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবিতা' নামে একটি কাব্য সংকলন, যা ছিল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিয়ে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বাঙালি কবিদের বাছাই করা কবিতার সংকলন। ভূমিকায় লিখেছেন, 'বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবিতার দ্বিতীয় খণ্ড বেরুলো। তবে আলাদাভাবে নয়, প্রথম খণ্ডের সঙ্গে একত্রে। প্রথম খণ্ড বেরিয়েছিল ১৯৮৯'র বিজয় দিবসে। একত্রিত দু' খণ্ড বেরুলো নব্বুইয়ের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও আমরা জনপ্রিয় কবিতার কাজ ও সংকলন সম্পর্কে পাঠক মহলে আশাপ্রদ উৎসাহ লক্ষ করেছি।'— একসঙ্গে দুই খণ্ড 'বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবিতা' সংকলন দেশের বোদ্ধা মহলে তাকে পরিচিতি এনে দেয়।

তার সাহিত্য সম্পাদকের জীবন শুরু হয় ১৯৮৮ সালে 'চিন্তা' নামে পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। নাম জটিলতার কারণে পরিবর্তন করে 'দ্বিতীয় চিন্তা' করা হয়। আর 'দ্বিতীয় চিন্তা'র সম্পাকীয় দপ্তর 'ইফফাত ম্যানসন' ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও শেরপুরের সাহিত্যচর্চার তীর্থস্থান। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার সাহিত্যামোদীদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন একটি পরিচিত নাম।

উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে 'দ্বিতীয় চিন্তা' বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করলে তা ব্যাপক সাড়া ফেলে। ছোটকাগজেরে ইতিহাসে দ্বিতীয় চিন্তা ও সম্পাদিকা ইফফাত আরা অবিস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবে।

দীর্ঘদিন দ্বিতীয় চিন্তায় বাংলাদেশে তো বটেই ওপার বাংলারও সৃষ্টিশীল অসংখ্য তরুণ মেধাবী কবি- সাহিত্যিকদের  আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ভারতের 'চিরঞ্জীব' পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাতকারে ইফফাত আরা বলেন, 'একটা মফস্বল শহর থেকে আমার মত একজন মহিলার পক্ষে সাহিত্য পত্রিকা বের করা সহজ ব্যাপার নয়। আর্থিক দুরবস্থা তবু কাটিয়ে ওঠা যায়, কিন্তু ভালো লেখা জোগাড় করা যে কি কঠিন কাজ তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।' নারী সম্পাদিত পত্রিকা বলেই হয়তো নামীদামী লেখকরা 'দ্বিতীয় চিন্তা'কে সযতনে এড়িয়ে চলতে চাইতেন। অথচ একজন নারীর একক প্রচেষ্টায় প্রায় বিজ্ঞাপনহীন একটি সাহিত্য পত্রিকা নিয়মিত বের করা যে কী রকম দুরূহ কাজ অনুমান করা কঠিন নয়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে 'দ্বিতীয় চিন্তা' সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। দেশবিদেশে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

দীর্ঘ সময় পর ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় চিন্তা'র অন্তিম সংখ্যা। অন্তিম কথাটি লেখায় অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া করেছিলেন। কিন্তু, বয়সের ভারে তার পক্ষে প্রকাশনা অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল না। ২০১০ সালে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন। তা শেষ করার উদ্যমও শরীরে অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু, তার মতো একজন জীবনশিল্পীর অভাব অনুভব করবে অনেকে।

Comments

The Daily Star  | English

The Daily Star, HSBC honour high achievers in O- and A-Level exams

To commemorate the victims of the July Uprising, the programme began with a one-minute silence, followed by the rendition of the national anthem

3h ago