মন্বন্তরের চার্চিলের সত্য মিথ্যা
বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র চার্চিল। পুরো নাম উইনস্টন চার্চিল। ব্রিটিশদের কাছে পরম পূজনীয়। 'সর্বকালের সেরা ব্রিটিশ' বলে বিবেচিত। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির বিজয়ের মহান কারিগররূপে সর্বজনমান্য। ব্রিটিশদের দুঃসময়ের পরীক্ষিত বন্ধু ও জনতুষ্টি অর্জন করা এক রাষ্ট্রনায়ক। পাশাপাশি পাঠক চিত্তে মুগ্ধতা ছড়ানো ও আলোড়ন তৈরিতে সক্ষম একজন লেখক।
এছাড়াও চার্চিলের রয়েছে আরও অনেক পরিচয়। গুরুত্বপূর্ণ সেই পরিচয়গুলো জানাও জরুরি। কিন্তু সেগুলোকে রাখা রয়েছে আড়ালে। ধামাচাপা দিয়ে। আর তা করা হয়েছে সচেতনভাবেই। ভূগোল-জনপদ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-ইতিহাস-বাণিজ্য দখল করা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ শক্তি মানুষের জ্ঞানের রাজ্য দখলেও পারঙ্গম। দৃশ্যত তারা উপনিবেশের পাততাড়ি গুটিয়ে নিলেও জ্ঞান কাঠামোয় ঔপনিবেশিক আধিপত্য ধরে রেখেছে প্রবলভাবে। জ্ঞান কাঠামোয় ঔপনিবেশিকতার দাপট থাকার অর্থ হলো নানা ভাবে, নানা অর্থে, সর্বত্র ও সবরকমভাবেই থাকা। শুধু জনপদ ও ভূগোলে নেই উপস্থিতি, এই সময়ে সেটা থাকা না থাকায় কোনোকিছু বাধাগ্রস্ত করে না মোটেই।
চার্চিলকে ব্রিটিশ কিংবা ইউরোপ যেভাবে পাঠ করা হয়, মানা হয়, জ্ঞান করা হয়, আমরাও সেভাবে পাঠ করি, প্রভাবিত হই। অথচ এ দুইয়ের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার পরম্পরা এক নয়। ব্রিটিশ কিংবা ইউরোপের চার্চিল চর্চা আর এশিয়ার মধ্যে ভারতের বিশেষ করে বাংলার চার্চিলের চর্চা-পর্যবেক্ষণ-মূল্যায়ন ও বিবেচনা সংগত ও যৌক্তিক কারণেই ভিন্ন। এ কারণে এর সতর্ক পাঠ আবশ্যক। চার্চিল গবেষণায় এ-পিঠ উন্মোচিত হলেও বি-পিঠ অজ্ঞাত থেকে গেছে কেবল উদার গবেষণা ও প্রকৃত সত্য ইতিহাস অন্বেষণের অভাবে।
ব্রিটিশ খেদানোর ৭৫তম বর্ষে এসেও আমাদের জ্ঞান চর্চাজুড়ে ওদের প্রেতাত্মা বিরাজমান। এখানেই ঔপনিবেশিক আধিপত্যের মাজেজা। চলে গেলেও আছর থাকা। এ এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার কারণেই উন্মোচিত হয় না চার্চিলের সত্য-মিথ্যা। পাঠ করা হয় না চার্চিলের ভয়ঙ্কররূপ, কার্যাবলী, ভারত বিদ্বেষ, বাংলার প্রতি নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতার দানবীয় বাস্তবতা ও বর্ণবাদী মানসিকতা। প্রচলিত এই বাস্তবতায় মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা Churchill's Secret War চার্চিলের বি-পিঠ জানার আকর গ্রন্থ হিসেবে এসেছে আমাদের মাঝে। বাংলায় বইটির ভাষান্তর করা হয়েছে, 'পঞ্চাশের মন্বন্তরে চার্চিলের ষড়যন্ত্র' নামে। পরিশ্রমলব্ধ এই কাজটি করেছেন নিখিল সুর ও অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দেশগুলোতো চার্চিলের পরিচয় ব্রিটিশদের মান্য করা চার্চিলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একটা দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ অন্যদের কাছে ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতে বাংলার মানুষের কাছে তিনি ভয়ঙ্কর একজন। যাকে ইতিহাসের কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই ক্ষমা করা যায় না। তাকে ক্ষমা করলে পুরো জাতির সঙ্গে বিশ্বসঘাতকতা করা হয়। পূর্বপুরুষের প্রতি জানানো হয় অবমাননা। জ্ঞাপন করা হয় অমার্জনীয় এক অশ্রদ্ধা।
প্রশ্ন হলো, বাংলায় কীরূপে মূল্যায়িত হবেন চার্চিল? কিংবা এটা কেমন হওয়া উচিত? চার্চিল কি একই সঙ্গে নায়ক এবং খলনায়ক? নাকি এসবের কোনোটিই নন?
চার্চিল এক ভয়ঙ্কর মানুষ। যে মানুষের কাছে নিজের স্বার্থ ও নিজস্ব বিচার-বিবেচনার কাছে কোনো কিছুই বিবেচনার নয়। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুও তার কাছে কেবলই পরিসংখ্যান। চার্চিলের কারণেই বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরে কমপক্ষে ত্রিশ লাখ মানুষ নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছে। কারও কারও মতে এই সংখ্যা চল্লিশ লাখ। এটা কোনো গালগল্প নয়। অতীতচারিতার আলটপকা বয়ানও নয়। এটা চার্চিলের কারণে, চার্চিলের দ্বারা সংঘটিত নির্মম, নিষ্ঠুর এক সত্য। যে সত্য এতদিন সুপ্ত ছিল ইতিহাসের মহাফেজখানায়। যার সুলুক সন্ধান করেছেন গবেষক মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়।
বাঙালির কাছে নানা অর্থে গুরুত্ববহ এই গবেষণা গ্রন্থটির সূচিতে নজর বোলালেই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুমিত হবে। সূচির ধারাক্রম ঠিক এ রকম- ১. যুদ্ধরত সাম্রাজ্য, ২. ঔপেনিবেশিক লুট, ৩. পোড়ামাটি নীতি, ৪. যে-কোনো মূল্যে, ৫. হাজার যন্ত্রণার মৃত্যু, ৬. এক বিজিত ও ক্ষুধাপীড়িত দেশ, ৭. গ্রামের ভিতর, ৮. পথের ওপর, ৯. ছোটো, খরগোশ ছোটো, ১০. মৃত্যুর পরের জীবন, ১১. বিভাজন এবং প্রস্থান, ১২. বোঝাপড়া, ১৩. পরিশিষ্ট।'
এছাড়াও আছে প্রস্তাবনা, সূত্রনির্দেশ ও গ্রন্থপঞ্জি শিরোনামে তিনটি অধ্যায়। শিরোনাম থেকে বইটির উপজীব্য বিষয় এবং আধার ও আধেয় সম্পর্কে একটা ধারণা আঁচ করা যায়।
প্রস্তাবনায় গবেষক উল্লেখ করেছেন, '১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল, ইংল্যাল্ডের মানুষ উইনস্টোন চার্চিলকে চাইল নেতৃত্ব দিতে, কারণ তিনি ব্রিটিশ সিংহের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন প্রতিকূল অবস্থায় অদম্য থাকার গুণে। চার্চিল আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলেছিলেন, "আমাদের কর্তব্যে আমরা নিজেদের বেঁধে ফেলি এবং সেজন্য আমরা এমন আচরণ করি, যাতে যদি ব্রিটিশ কমনওয়েলথ এবং সাম্রাজ্য হাজার বছর স্থায়ী হয়, মানুষ বলতে পারে, এটাই ছিল তাদের সুন্দরতম মুহূর্ত।" প্রধানমন্ত্রীর প্রচন্ড দৃঢ় সংকল্প ব্রিটনদের আশায় উজ্জীবিত করেছিল এবং তাদেরও চরম দুর্দশার মুখে সাহস জুগিয়েছিল। ঐতিহাসিক রবার্ট বোড্স জেমস স্মরণ করেছেন, "চার্চিলের সংক্রমণশীল মনোবল মানুষকে প্রভাবিত করে ভাবতে শিখিয়েছিল, বেঁচে থাকার এটাই গুরুত্বপূর্ণ সময়। নিয়তি আমাদের আশ্চর্যজনকভাবে অনুগ্রহ করেছে। এই দিনগুলিতে বেঁচে থাকা রোমাঞ্চকর।"'
উপর্যুক্ত অংশ যদি আমরা একটু নিবিড়ভাবে পাঠ করি, খতিয়ে দেখার চেষ্টা করি তাহলে বোঝা যাবে, মানুষ চার্চিলের মনোবাঞ্ছা কী। তিনি চান হাজার বছর সাম্রাজ্য টিকে থাকুক। তিনি চান সাম্রাজ্যের মানুষরাও সুখে থাকুক। শেষের চাওয়া মূলত একজন বাগপটু রাজনীতিবিদের চাওয়া। ক্ষমতা গ্রহণের সময়ের চার্চিল আর ক্ষমতা আরোহণের পরের চার্চিলের মধ্যে অনেক ব্যবধান। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল পুরোমাত্রায় এবং যুদ্ধের একপর্যায়ে জাপান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্রক্ষ্মদেশ অর্থাৎ আজকের মিয়ানমার দখল করে নিলো, তখন চার্চিল অন্যরকম এক রাজশক্তি রূপে আবির্ভূত হলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে মাঝামাঝি সময়ে বাংলাজুড়ে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। যার শুরুটা হয়েছিল প্রাকৃতিক কারণ।, কিন্তু তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল পুরোটাই মনুষ্যসৃষ্ট কারণে। আর এই মনুষ্যসৃষ্ট কারণের পুরো কলকাঠি নাড়িয়েছেন যে মানুষটি তিনি আর কেউ নন, চার্চিল। মধুশ্রী মুখোপাধ্যায় ইতিহাসের মহাফেজখানা ঘেঁটে এ সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল-দস্তাবেজ, তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে হাজির করেছেন চরমতম সেই সত্যকে।
দুর্ভিক্ষ চলাকালে খাদ্য সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা তো করাই হয়নি, উপরন্তু বাংলা ও বিহার অঞ্চল থেকে খাদ্য সরিয়ে নেওয়া হয়। এর পেছনে চার্চিলের যুক্তি ছিল, কোনো কারণে জাপানী সৈন্যরা যদি ব্রক্ষ্মদেশের পর বাংলা ও বিহার দখল করে, তাহলে তারা যেন খাদ্যদ্রব্য লুট করার সুযোগ না পায়, আর খাদ্যের অভাবেই যেন তাদের মৃত্যু ঘটে। চার্চিলের নির্দেশ অনুযায়ী এসব এলাকার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে অন্যত্র গুদামজাত করা হয়। যাতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সৈন্যদের কোনো প্রকার খাদ্য সংকট না হয়। এমনকি চার্চিল ইউরোপের জন্যও খাদ্য গুদামজাত করেছিলেন। অথচ তখন বাংলাজুড়ে চলছে চরমতম দুর্ভিক্ষাবস্থা। এবং সেটা কতোটা ভয়ঙ্কর রকমের ছিলো তার সাক্ষ্য লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর স্মৃতিচারণে, গবেষকের মাঠ জরিপে উঠে এসেছে এভাবে, 'কয়েকবছর পর লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী একটা কাজের মেয়েকে রেখেছিলেন। নাম ছিল হিরণ। মেয়েটা অনেকটা সময় কান্নাকাটি করে কাটাত। কারণ দুর্ভিক্ষের সময় সে তার মেয়েকে ফুটপাতে রেখে খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল। ফিরে এসে মেয়েকে আর দেখতে পায়নি। মহাশ্বেতা দেবী স্মৃতিচারণ করেছেন, প্রায় দৈনিকই দেখা যেত মৃতদেহগুলো সরকারি ট্রাকে তুলে নেওয়া হচ্ছে, কাঠের গুঁড়ির মতো সেগুলো এদিক ওদিক করছে। থাকে থাকে সেগুলি কাঠের মতো নিচে নামানো হত। আমি শুনেছিলাম সেগুলো পোড়ানো হত কারখানার চুল্লিতে। যা যুদ্ধে জ্বালানির কাজ করতো।'
এই বাস্তবতা চার্চিল ভালো করেই জানতেন, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেননি। ঐতিহাসিক সত্য হলো, দুর্ভিক্ষের বছরগুলোতে ফসল উৎপাদন যে একেবারেই হয়নি এমন নয়। বরং অন্যান্য বছরের তুলনায় বিশেষ করে গমের উৎপাদন অনেক বেশিই হয়েছিল। কিন্তু সেই গমও অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। এই সময় বার্মা থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খুঁজে নেওয়া হয়নি বিকল্প কোনো উৎস। চার্চিলের কাছে চাল আমদানি ও খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক করার জন্য একাধিক আবেদন করা হলেও তিনি এসব ব্যাপারে কিছুই বলেননি। নানা কারণ দেখিয়ে সেসব ঝুলিয়ে রাখেন। এসবই যে চার্চিলের পোড়োমাটি নীতি বাস্তবায়ন করার কৌশল পরবর্তীতে সেই সত্যই প্রকাশিত হয়েছে। আর এই গবেষণা সুযোগ করে দিয়েছে চার্চিলের অচেনা স্বরূপকে বোঝার।
পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে গবেষণা করেছেন অমর্ত্য সেন। যেখানে তিনিও উপস্থিত হয়েছেন তাঁর যুক্তি নিয়ে। পরিশিষ্ট অধ্যায়ে সেই প্রসঙ্গ এসেছে সবিস্তারে। অমর্ত্য সেনের মত ও মধুশ্রীর দ্বিমত উভয়ই হাজির এখানে। যেমন: 'তেতাল্লিশের (অথবা পঞ্চাশের) মন্বন্তরের মূল কারণ হচ্ছে একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ বাজার থেকে খাবার সংগ্রহের ক্ষমতাটাই (এনটাইটেলমেন্ট) হারিয়ে ফেলেছিল। সেই থেকে তার বৃহত্তর (এবং সুবিখ্যাত) তত্ত্ব যে, সমস্ত দুর্ভিক্ষেরই একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য এই এনটাইটেলমেন্ট সংকট। সেই বছর অনেকটা কম খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল একথা বললে কিন্তু এই বক্তব্যের কোন ব্যত্যয় হয় না।'
মধুশ্রী আরও যুক্তির যোগান দিয়েছেন এভাবে, 'অমর্ত্য সেনের মূল অন্তর্দৃষ্টি- অর্থাৎ এনটাইটেলমেন্ট সংকট তত্ত্ব দুর্ভিক্ষের কারণ তথা এর চরিত্র গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে। যা আজও আগের মতই সত্য এবং নির্ভুল। আমি কেবল দেখাতে চেষ্টা করেছি যে, সেই সময় ব্রিটিশ নাগরিকরা ভারতীয় প্রজাদের থেকে অনেকটা বেশি এনটাইটেলমেন্ট উপভোগ করত। চার্চিলের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। যেমন ধরা যাক, ১৯৪৩ এর জানুয়ারিতে চেরওয়েলের পরামর্শমত চার্চিল ভারত মহাসাগর থেকে ৬০ শতাংশের মতো মার্চেন্ট শিপ তুলে নিয়ে তাদের ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যেও খাদ্য এবং অন্যান্য কাঁচামালের সরবরাহ সুস্থিত রাখার কাজে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা খাবার ভারতে পৌঁছোবার কোন উপায় রইল না; হয়ত সেখানেই পঞ্চাশের মন্বন্তরের সূত্রপাত।'
চার্চিল কতোটা ভয়ঙ্কর তার একটা আরশি এই গবেষণা। চার্চিলের এই মানসিকতার পেছনে মুখ্য কারণ হয়তো এই যে, তাকে প্রধানমন্ত্রী করা না করায় ভারতীয়দের কোনো হাত ছিল না। বাংলার মানুষের তাকে ভোট দেয়ার অধিকারও ছিল না। ফলে, বাংলার মানুষের মৃত্যুতে তার কিছুই যায় আসেনি। এই মানুষটার কারণে আমাদের পূর্বপুরুষদের না খেয়ে মরতে হয়েছে। মনে রাখতে হবে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কোনো রেকর্ড নেই। দু-দুটো দুর্ভিক্ষ হয়েছে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতে। সুতরাং প্রাকৃতিক কারণে হলে বাংলাকে, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মানুষকে আরও অনেকবার দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে হতো।
নিষ্ঠুরতম সত্য ও চরমতম বেদনার হলো, ছিয়াত্তরের এবং পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে আমাদের তেমন কোনো গবেষণা নেই। এমনকি আমাদের বাংলাপিডিয়ায় পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে যে বয়ান রয়েছে সেখানেও এই মন্বন্তর যে মুনষ্যসৃষ্ট. তার কোনো উল্লেখ নেই। বলা হয়নি যে এই দুর্ভিক্ষ মূলত চার্চিলের ষড়যন্ত্রের কারণেই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এবং কমপক্ষে ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এখানেই স্পষ্ট যে, আমাদের জ্ঞানকাঠামোয় এখনও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার আছর সর্বাংশে বিদ্যমান। এখনও আমরা ইতিহাসের সত্যকে অন্বেষণ করে উঠতে পারিনি। এখনও আমরা ঔপনিবেশিকতার আয়নায় নিজেদেরকে দেখি। এ বড়ো লজ্জার, এ বড়ো বেদনার। কেবল স্বাধীন হলেই হবে না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, নিজেদের জ্ঞান কাঠামো নির্মাণের করণকৌশলও জানতে হবে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে চার্চিলের ষড়যন্ত্র বইটি আমাদের উদ্দিষ্ট পথের দিশা দেয়। আমাদেরকে ইতিহাসমুখী করে। ইতিহাসের সত্যকে জানতে আগ্রহী করে তোলে। আমরা বুঝতে পারি আমাদের চিন্তার স্বকীয়তা কেমন হওয়া উচিৎ। এবং গ্রন্থটি এও বুঝতে শেখায়, যা কিছু বলা হয় তার সবটাই সত্যি নয়। এসব শেখানো বুলির মাঝেও রয়ে গেছে সুক্ষ্ম ঔপনিকেবেশিক কৌশল ও আধিপত্যবাদের নিষ্ঠুর খেলা। যে খেলায় চার্চিল কারও কারও কাছে নায়ক হলেও সবার কাছে নয়।
ড. কাজল রশীদ শাহীন: লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক
Comments