সংস্কৃতির ব্যাপারটা কতটা জরুরি
আমাদের দেশে ২টি বড় ট্রাজেডি ঘটেছে। প্রথমটি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ, দ্বিতীয়টি ১৯৪৭ সালে দেশভাগে। সেই দেশভাগ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এমনকি প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ভাগ করে যে ক্ষতি করেছে তা পূরণ হওয়ার নয়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতাটা মনে আছে? শিশুটি তেলের একটি শিশি ভেঙে ফেলেছে। কবি বলছেন, 'তেলের শিশি ভাঙলো বলে শিশুর উপর রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো তার বেলা?' বুড়ো খোকারা ভারত ভেঙে ভাগ করেছে, ইংরেজ প্ররোচনা দিয়েছে। কেমন করে সাংস্কৃতিকভাবে এই ভাঙা-ভাঙির ব্যাপারটা কাজ করেছে তার নানান দৃষ্টান্ত আমরা নানান জায়গায় পাব।
কদিন আগে ঢাকা সম্পর্কে লেখা অলকনন্দা প্যাটেলের একটা বই পড়ছিলাম। তার শৈশব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অধ্যাপক পিতার সঙ্গে কেটেছে। পিতা ড. অমিয় কুমার দাশগুপ্ত বড় মাপের অর্থনীতিবিদ। তার সহকর্মী ছিলেন অধ্যাপক ড. আশুতোষ সেন। তিনি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক, অমর্ত্য সেনের পিতা। আশুতোষ সেন তার তরুণ বন্ধু ও সহযোগী অমিয় দাশগুপ্তককে চিঠিতে লিখেছেন, নির্বাচন তো আসছে এখন তাদের কর্তব্যটা কি? সেটি ১৯৪৬-এর নির্বাচন, যে নির্বাচনে পাকিস্তান হিন্দুস্থান ভাগাভাগি হয়েছে। সেই নির্বাচনে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটি আসন ছিল। সেখানে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, যিনি অন্য কোথাও জিততে পারতেন না, তিনি জিতছেন। সেবারও তিনি দাঁড়িয়েছেন এবং জয়ী হয়েছেন, অন্যসব আসনে যদিও তাদের প্রার্থীর জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হচ্ছে। এখান থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। আসনটি সংরক্ষিত ছিল মুসলমানদের জন্য, প্রার্থী ২ জন। একজন ফজলুর রহমান। তাকে আমরা চিনি। এই ভদ্রলোক পরে পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন, আরবি হরফে বাংলা লেখার কথা বলেছিলেন, ওই লক্ষ্যে গবেষণার জন্য টাকা দিয়েছিলেন, বাংলা ভাষার বিরোধী ছিলেন। আরেক জন নুরুল হুদা। তিনি বোধ হয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। আশুতোষ সেনের মতো বিদগ্ধ মানুষ অমিয় দাশগুপ্তকে বলছেন, এ নির্বাচনে আমরা ফজলুর রহমানকেই ভোট দেব। ফজলুর রহমান কট্টর মুসলিম লীগপন্থী, অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, নবাব বাড়ির লোক। তাকেই ভোট দেবেন বলছেন। কেন? ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ফজলুর রহমান জিতলে হিন্দুদের সুবিধা হবে। হিন্দুদের সুবিধা মানে বড়লোক হিন্দুদের সুবিধা। কাজেই তিনি তার তরুণ বন্ধুকে বলছেন, তুমি কেবল নিজের ভোটটিই দেবে না, অন্যদেরও বলবে ফজলুর রহমানকেই ভোট দিতে। এখানে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? একদিকে কট্টর মহাসভাপন্থীরা কাজ করছিলেন, অন্যদিকে কট্টর মুসলিম লীগাররা কাজ করছিলেন এবং এই আপাত শত্রুরা একসঙ্গে মিলেছেন নিজেদের স্বার্থে, হিন্দু ব্রাহ্মণরা তাদের স্বার্থে, মুসলমান ব্রাহ্মণরা তাদের স্বার্থে দেশকে ভাগ করছেন। এই রাজনীতি তখন ছিল, এই রাজনীতি এখনও আছে। বর্তমান অবস্থাটা আজকের অনুষ্ঠানে গাওয়া ৪টি গানে ধরা পড়েছে। এখানে একটা বিশেষ কথা আছে, কৃষকের দুঃখের কথা। কৃষক দুঃখে আছে, তার বিশেষ দুশ্চিন্তা কন্যাকে নিয়ে সে কী করবে? কন্যাকে কীভাবে বিয়ে দেবে? আমরা দেখি, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে চালু আছে। তার প্রধান কারণ কন্যাশিশুকে নিয়ে পিতা-মাতার দুশ্চিন্তা। তারা মনে করেন, কোনোমতে মেয়েটাকে পার করতে পারলেই বাঁচা গেল, দায় মুক্ত হলো, কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো।
কিন্তু বাংলাদেশে তো মানুষের নিরাপত্তা নেই। বিশেষ ভাবে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নেই। ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি, পাকিস্তানি হানাদারেরা গণধর্ষণ করেছে। সেই রকম গণধর্ষণ আজ বাংলাদেশে চলছে। কাজটা বাঙালিরাই করছে, এখন পাঞ্জাবী হানাদার নেই। বাঙালি যুবকরা নারীদের ধর্ষণ করছে, গণধর্ষণ করছে। বাসে করে যাচ্ছিল উচ্চশিক্ষার্থী রূপা। বাসে একা পেয়ে ৫ জন মিলে তাকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে। শেষে তাকে সেভাবে হত্যা করা হয়েছে যেভাবে মুরগিকে জবাই করে গৃহস্থ। রূপাকে বাসের জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে জঙ্গলে, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। মেয়েটির সঙ্গে মোবাইল ছিল, টাকা ছিল ৫ হাজার—সেগুলো হাতিয়ে নিয়েছে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এমন খবর অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ রকম ঘটনা তো বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। এ রকম ঘটনা ঘটবে বলে তো আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করিনি। এ রকম ঘটনা ঘটবে বলে এই দেশে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দেয়নি, ২ লাখ নারী তাদের সম্ভ্রম হারায়নি। কিন্তু এটা এখন বাংলাদেশের বাস্তবতা। কেবলই রূপা নয়, শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং তারপর গলা টিপে মেরে ফেলা হচ্ছে। তার লিভার ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে নেওয়া হচ্ছে। এই বীভৎসতা কেন? যে যুবকরা গণধর্ষণ করছে তারাও দরিদ্র, তারাও সুখে-শান্তিতে নেই, তাদেরও বাড়িতে মা-বোন আছে। কিন্তু তারা এমন কাজ করছে কেন? করছে এবং করতে পারছে কারণ তারা পুঁজিবাদের আদর্শে দীক্ষিত। তারা মুনাফায় বিশ্বাস করে। এই মুনাফা হচ্ছে ভোগের মুনাফা। এতে কোনো বিনিয়োগ নেই। যত বেশি ভোগ করা যায় তত বেশি সুখ। তাদের আচরণ এবং একাত্তরে গণহত্যা ও গণধর্ষণ করা হানাদারদের আচরণে কোনো পার্থক্য নেই। বরং এদের আচরণ হানাদারের চেয়েও খারাপ। হানাদারেরা ছিল বিদেশি, এরা স্বদেশি। আসলে দুর্বৃত্তদের চেহারাটাই কেবল আলাদা, আসে একই জায়গা থেকে। সেই জায়গাটা হলো পুঁজিবাদ। বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বর্বরতাটা গণধর্ষণ ও শিশুধর্ষণের মধ্য দিয়ে সর্বাধিক উন্মোচিত হয়।
পুঁজিবাদের এই মনুষ্যত্ববিরোধী তৎপরতার জন্যই প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব। এর জন্য দীর্ঘকাল আমরা সংগ্রাম করেছি, অপেক্ষা করেছি। যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মালিকানার প্রশ্নের মীমাংসা হবে, সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুনাফার জায়গায় মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। আমরা ১৯৭১ সালে সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আশা করেছিলাম বিপ্লব ঘটবে, কিন্তু ঘটেনি। কারণ পুঁজিবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। পেটিবুর্জোয়ারা বুর্জোয়া হয়ে গেছে এবং যারা বুর্জোয়া হতে পারেনি তারা বুর্জোয়া মানসিকতা, মুনাফার মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে অবাধে নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ করছে।
প্রায় ৩০০ বছর আগে ১৭২৯ সালে লেখক জনাথন সুইফট একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডের শিশুদের দুর্দশা দেখে। তিনি বলেছিলেন, 'শিশুদেরকে আমরা খাওয়াবো, মোটা তাজা করব। ১ বছর ধরে তাদের কাপড়-চোপড় দেব। তারপর তাদেরকে কসাইখানায় বিক্রি করে দেব। এবং কসাইরা তাদের কেটে মাংস হিসেবে বিক্রি করবে বড়লোকদের কাছে। বড়লোকেরা তা সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে খাবে।' এটা তিনি চরম ক্রোধ ও প্রচণ্ড হতাশা থেকে বলেছিলেন। আজকের বাংলাদেশের শিশুরা কিন্তু ভীষণ দুর্দশায় রয়েছে। জনাথন সুইফট পথের সন্ধান পাননি। আমরা কিন্তু পথের সন্ধান জানি, বিপ্লবের পথ জানি। আমরা ফরাসী বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা প্যারি কমিউন থেকে শিক্ষা নিয়েছি, আমরা রুশ বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়েছি।
এটাও আমরা জানি, এই বিপ্লবে সংস্কৃতির কী অসামান্য ভূমিকা। রুশ দেশে বিপ্লব কখনোই হতো না যদি সেই দেশের সাংস্কৃতিক মান অত উঁচু না হতো। তলস্তয়, দস্তয়ভস্কির লেখায় বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বুদ্ধিজীবীরা গবেষণা করেছেন, তর্ক করেছেন এবং প্লেখানভ-লেনিন এমনকি ট্রটস্কিরও যে অসামান্য বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান তার তুলনা হয় না। লেনিনের মতো দ্বিতীয় মানুষ তার সময়ে পুরো ইউরোপে ছিলেন না। যেমন মার্কসের মতো সমান জ্ঞানী ও বিপ্লবী মানুষ আর তার সময়ে কেউ ছিলেন না। বিজ্ঞানে হয়তো ছিলেন, কিন্তু সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে তার দ্বিতীয়টি ছিলেন না। এই উচ্চতায় থেকে মার্কসবাদকে লেনিন নিজের দেশে নিয়ে এসে প্রয়োগ করলেন। মার্কসবাদকে যদি লেনিন তার দেশে প্রয়োগ করতে না পারতেন, তাহলে মার্কসবাদ একটা তত্ত্ব হয়ে থাকতো, একটা স্বপ্ন হয়ে থাকতো। স্বর্গীয় কল্পনা বলে লোকে তাকে উপহাস করত। বলতো এই ধরনের কল্পনার খবর আমরা আগেও পেয়েছি। ইউটোপিয়ার অনেক কাহিনী আছে। যেটা লেনিন করেছেন সেটা হচ্ছে, মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করে তাদের মধ্যকার শক্তির জোরে বিপ্লব সংগঠিত করিয়েছেন। আমাদের যেটা স্মরণ করতে হবে তা হলো রুশ দেশে তখন সোভিয়েত ছিল। বলশেভিক পার্টি যদি কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিত তাহলে বিপ্লব সফল হতো না। সোভিয়েত ছিল। সোভিয়েত মানে পরিষদ, পরিষদ ছিল শ্রমিকের, কৃষকের, সৈনিকের। স্থানীয় পরিষদ। এগুলো গঠিত হয় ১৯০৫ সালের জারবিরোধী অভ্যুত্থানের পরে, যার ফলে এরা ছিল জারবিরোধী চরিত্রের। লেনিনের আওয়াজ ছিল ক্ষমতা আমাদের পার্টির কাছে দেওয়ার দরকার নাই, ক্ষমতা যাবে সোভিয়েতের কাছে।
বাংলাদেশে আমাদেরকেও ওই রকম কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক কেন্দ্র এখনই না হোক, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চাই। চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যে কাজগুলো করছে এমন অসংখ্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে, পাঠাগার তৈরি করতে হবে, দেশের আনাচে-কানাচে পাঠাগারকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতির চর্চা হবে, বিতর্ক হবে, প্রতিযোগিতা হবে, লেখা চলবে, আলোচনা হবে এবং মানুষ জেগে উঠবে। ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার যে সংগ্রাম তা জয়যুক্ত হবে। কেবল জয়যুক্ত না, বিপ্লব ঘটলে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ধরে রাখার, তার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটানোর যে প্রয়োজন তা মেটানো সম্ভব হবে। সেজন্যই সাংস্কৃতিক কাজটা এতো গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের সে সময় সংস্কৃতিচর্চাতে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল তারই পরিণতিতে বিপ্লব ঘটেছে। সেই উন্নতি সমাজবিপ্লবীরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছে অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে, জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে। আমরা চীনে দেখেছি, মাও সে তুং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। কেন করেছিলেন এটা নিয়ে অনেক কথা আছে। এমনও বলা হয়, এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপার ছিল। তিনি দেখেছিলেন, পুঁজিবাদ ফেরত আসছে, ব্যক্তি মালিকানা চলে আসতে চাইছে। তিনি দেখেছিলেন, মুনাফা মনুষ্যত্বের ওপর আধিপত্য করতে উদ্যত হয়েছে। তখন তার অনেক বয়স। সেই বয়সে তিনি বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। এ বিপ্লব যে কত প্রয়োজন ছিল, সাংস্কৃতিক বিপ্লব যে কত আবশ্যক ছিল সেটা এখন চীনের পুঁজিবাদী আচরণ দেখে, সেখানে মি. হাইডের তৎপরতা দেখে আমরা বুঝতে পারি।
বুঝতে পারি সংস্কৃতি কত জরুরি, সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি কত জরুরি। আমরা বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করছি। এই বিপ্লবে কেবল ক্ষমতা হস্তান্তর হবে না। আগে যে বিপ্লবগুলো হয়েছে, দাস ব্যবস্থা থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে সামন্ত ব্যবস্থার কাছে, সামন্ত ব্যবস্থার থেকে পুঁজিবাদের কাছে, এ বিপ্লব সে রকমের হবে না। ওই বিপ্লব ক্ষমতা হস্তান্তরের নয়, হবে ক্ষমতা কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের। এ বিপ্লব মীমাংসা করবে সামাজিক মালিকানার প্রশ্নের। এ বিপ্লব মুনাফাকে পরাজিত করে মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
সারাবিশ্বে এই সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রাম আমাদেরও এবং এই সংগ্রামের বিশ্বজনীন উত্তরাধিকার অক্টোবর বিপ্লব আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ওই উত্তরাধিকারকে বিকশিত করা, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সাংস্কৃতিক কাজটাকে রাজনৈতিক কাজের কেবল পরিপূরকই নয়, রাজনৈতিক কাজের প্রস্তুতি হিসেবে আমাদেরকে নিতে হবে। কাজেই চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যে কাজ তা খুবই জরুরি এবং এ কাজ অত্যন্ত ব্যাপকভাবে করা দরকার।
যারা সমাজে বিপ্লব চান তারা জ্ঞানের চর্চা করবেন। এটা অত্যন্ত সত্য কথা, মারাত্মক সত্য কথা যে আমাদের দেশে জ্ঞানের চর্চা নীচে নেমে গেছে। আমরা যেখান থেকে বক্তৃতা করছি, আলোচনা করছি, সেখানে তো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। এইখানেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব এখানেই বক্তৃতা করেছেন, এইখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে। এই সব ঘটনার পরিণতিতে পরবর্তীতে যে কাজটা—নতুন সমাজ গড়া, মানবিক সমাজ গড়া, সেটা আমরা করতে পারিনি। সেটা করতে না পারার কারণে আজ আমাদের কন্যাশিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, আমাদের বোনদের ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং হত্যা করা হচ্ছে। মিয়ানমারে পুঁজিবাদী শাসকরা যে ফ্যাসিস্ট আচরণ করছে, সেই কাজ আমাদের দেশে হচ্ছে। মুক্তির যে সংগ্রাম সেটা আন্তর্জাতিক বৈপ্লবিক সংগ্রাম। এই বিপ্লবের আরও বড় তাৎপর্য হলো অন্য বিপ্লবগুলো ছিল স্থানীয় বিপ্লব। ফরাসী বিপ্লব ফরাসী দেশের বিপ্লব, কিন্তু ১৯১৭ সালের সোভিয়েত বিপ্লব হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিপ্লব। সারা বিশ্বে সে বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে এবং বিশ্বময় পুঁজিবাদকে পরাস্ত সমাজতান্ত্রিক যে সমাজ গড়বার আকাঙ্ক্ষা এবং দৃষ্টান্ত দুটোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Comments