সাহিত্যের পুরস্কার যখন তিরস্কার 

রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেয়া হল বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ঠিক সেই দিনই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে তথ্য গোপনের অভিযোগে বাংলাদেশে বিভাগীয় মামলার মুখে পড়েছেন উপসচিব মো. আছাদুজ্জামান, তিনি ২০২২ সালের সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বাবা আমির হামজার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এই ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করা হয়। পুরস্কার নিয়ে দুটো ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলে সংঘটিত হলেও কেনো একই দিনে ঘটলো,  এটা কি কেবলই কাকতাল, নাকি কোথাও কোনো ইশারা লুকিয়ে রয়েছে আমরা জানি না। 
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেয়া হল বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ঠিক সেই দিনই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে তথ্য গোপনের অভিযোগে বাংলাদেশে বিভাগীয় মামলার মুখে পড়েছেন উপসচিব মো. আছাদুজ্জামান, তিনি ২০২২ সালের সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বাবা আমির হামজার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এই ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল হয়। পুরস্কারের দুটো ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলে সংঘটিত হলেও কেনো একই দিনে ঘটলো, এটা কি কেবলই কাকতাল, নাকি কোথাও কোনো ইশারা লুকিয়ে রয়েছে আমরা জানি না!

উল্লেখ্য এদেশে পুরস্কার প্রদান করার পর পুরস্কার প্রত্যাহার করার কোনো নজির না থাকলেও, পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করার পর পুরস্কার বাতিল করার নজির আমির হামজার ক্ষেত্রেই প্রথম নয়। ২০২০ সালেও সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য রইছ উদ্দিন আহমদের নাম ঘোষণা করেও সমালোচনার মুখে তার পদকও বাতিল করা হয়। যদিও রইছ উদ্দিনের ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা কিংবা কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কিন্তু আমির হামজার বেলায় মামলার মুখে পড়লেন পুত্র। যিনি বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে গিয়ে নিজের বিপদ যেমন ডেকে এনেছেন তেমনি বাবার সম্মানহানিও করেছেন। সুতরাং, পুরস্কারের সত্য রক্ষিত না হলে তা যে কখনো কখনো বিপদও ডেকে আনতে পারে আমির হামজার ঘটনা তার প্রমাণ।

পুরস্কারের সত্য-মিথ্যা যাই-ই থাকুক না কেনো তা বিতর্কের জন্মও দিতে পারে। হিংসুটে বাঙ্গালির ক্ষেত্রে একথা শতভাগ প্রযোজ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে তর্ক জমে উঠেছে বেশ। পক্ষাবলম্বনকারীরা সকল যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে দিচ্ছেন 'হিংসুটে'দের কাজ বলে, কিন্তু আদতে কি তাই? 

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে যে তর্ক হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে। মমতার বাংলা একাডেমি পুরস্কারের বিতর্কেও কি সেই আবীর মেলে, নাকি মেলানো যায়? রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পর খোদ কলকাতায় সভা করে সেই সময়ের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বলেছিলেন, নোবেল পুরস্কারের মান কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পাওয়ার মধ্য দিয়ে সেটা বুঝতে আর বাকী থাকে না।

মমতার সাহিত্য পুরস্কারকে যথার্থ ও মাহাত্ম্য দিতে সুবোধ সরকার অবশ্য উইনস্টাইন চার্চিলের নোবেল পাওয়ার ঘটনাকে টেনে এনেছেন। অনাদি রঞ্চন বিশ্বাসের প্রতিবাদের জবাবে বাজপেয়ী, চার্চিলকে সাক্ষী মেনে কবি মমতার সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তিকে মান্যতা দেয়ার চেষ্টা জারি রেখেছেন। অন্যদিকে, ফেসবুকে চলছে গুঞ্জন, 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পুরস্কার দিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়'। এতেই বোঝা যায়, পুরস্কার কেবলই মহিমা-মর্যাদা আর স্বস্তি দেয় না, একটু উনিশ বিশ হলেই অস্বস্তির জন্ম দেয়, পদে পদে হ্যাপা কাকে বলে ও কতো প্রকারের তাও বুঝিয়ে দেয়, যেমন বুঝতে যাচ্ছে আমির হামজার উপসচিব পুত্র।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা সাহিত্য পুরস্কার দেয়া নিয়ে চলছে তুলকালাম কাণ্ড। তৈরি হয়েছে পক্ষ-বিপক্ষ। জারি রয়েছে নানা যুক্তি-ভিন্ন ভিন্নমত ও মতান্তর এবং প্রতিবাদ ও প্রত্যাখ্যানের পালা। পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই পুরস্কার নিয়ে এই তুলকালাম কাণ্ডের ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়েছে! 

প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের এখানেও কেন পশ্চিমবঙ্গের ঘটনায় তরঙ্গাভিঘাত তৈরি হবে? বিশ্বায়নের যুগে আর ইন্টারনেটের বদৌলতে কোনো ঘটনায় নির্দিষ্ট একক স্থানে-বৃত্তে বা পরিধিতে আটকে থাকে না। সুতরাং এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক-না হওয়াটাই খাপছাড়া-অযৌক্তিক।

পুরস্কার দেয়ার প্রেক্ষিতে তুলকালাম ঘটনাটা ঘটেছে প্রতিবেশী রাজ্যে। কাঁটাতারের বেড়া দুই ভূগোলকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করলেও অনেক বিষয়েই আমরা এখনও অভিন্ন আত্মার অংশরূপে বিরাজমান-মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল প্রমুখ কীর্তিমানে সম অধিকারের অংশভাগ। একই আবেগ-ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের ভাষা-সংস্কৃতিতে আমাদের সর্বক্ষণের বসবাস। একারণে যে কোনো ঘটনায় একে-অপরের আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয় প্রবলভাবে।

'হুজুগে বাঙালি' বলে পুরনো এক প্রবাদ লেপ্টে রয়েছে দুই বঙ্গবাসীর ললাটেই। আমরা যতোটা অনুসরণ প্রিয় তার চেয়ে অধিক অনুকরণে অভ্যস্ত। একারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পুরস্কার দেয়ায় এই ভেবে কেউ কেউ আঁতকে উঠেছেন যে, মমতাকে পুরস্কার দেয়ার মধ্য দিয়ে যে পথ দেখাল পশ্চিমবঙ্গ। এই নজির  এদেশেও একটা খারাপ প্রবণতাকে শিগগিরই উস্কে দেবে।

প্রশ্ন হলো, এই ঘটনার আমরা কেন একটা পিঠ দেখছি? যে কোনো ঘটনার দুটি পিঠ দেখাইতো যুক্তিযুক্ত, শুধু দুটি পিঠ নয়, দেখতে হবে দুই পিঠের মাঝে থাকা ধুসর স্তরও। যে কোনো বিষয়ে যা বলা হচ্ছে তা যেমন যৌক্তিক তার চেয়েও অধিক যৌক্তিক হলো  ওইখানটায় দেখা, সাদা চোখে যেখানটা দেখা যাচ্ছে না। মমতা ব্যানার্জিকে পুরস্কার দেয়ার ঘটনায় আমরা কেনো একটা দিকই দেখছি-এই দূর্বলতায় কেনইবা আচ্ছন্ন হচ্ছি? কবে আমরা তাদের সৌন্দর্যটাও দেখতে শিখব? এই লেখা সেই সৌন্দর্য তালাশের লক্ষ্যে। তার আগে জেনে নিই কী পুরস্কার দেয়া হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা একাডেমি  প্রথম বারের মতো এই পুরস্কার ঘোষণা করেছে। প্রতি তিন বছর পরপর এই পুরস্কার দেয়া হবে। প্রথমবার পুরস্কার পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ব্রাত্য বসু পুরস্কার ঘোষণায় বলেছেন, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করার পরও যারা অক্লান্তভাবে সাহিত্যসেবা করছেন তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার প্রদান করা হবে। কবিতা সংকলন 'কবিতা বিতান'-এর জন্য এবার পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকিয়ে ও কবি পরিচয় সকলেরই জানা। কারণ, এই পরিচয় তিনিই আওড়ে থাকেন, বলেও বেড়ান। তা না হলে মানুষ জানে কীভাবে যে তিনি 'সাঁটাসাট' কবিতা লিখতে পারেন। তিনিই আওয়াজ দেন ভরণ-পোষণ করেন ছবি বিক্রির টাকায়। এ যাবৎ বই বেরিয়েছে ১১৩টা। কলকাতা বই মেলায় ঘটা করে তাঁর বই প্রকাশ এখন ফি বাৎসরিক রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তাঁর কবিতার সঙ্গে কমবেশি সবারই পরিচয় রয়েছে। কয়েকটি কবিতার অংশবিশেষ এরকম:

এক. গণতন্ত্রের ঠিকানা?/ চেনা যাচ্ছে না/ দেশের ইতিহাস/ বোঝা যাচ্ছে না/ সংবাদ জগত কথা বলছে না/ কাক কা-কা ডাকছে না…?

দুই. মাথাটা যেন একটু বেশি হাঁটে/ পায়ের থেকে।/ পা-তো হাঁটে,/ তবে মাথা বেশি হাঁটে।

তিন. কেমন আছো? থ্যাঙ্ক ইউ/ অভিনন্দন – থ্যাঙ্ক ইউ/ মা কোথায় – ঘেউ ঘেউ/ মানেটা কী? সাথে ফেউ।

এই হচ্ছে মমতার কবিতার জগৎ ও তাঁকে দেয়া পুরস্কারের ব্যাপারস্যাপার। ভাল কিংবা মন্দ যাই-ই সংঘটিত হোক। নৈতিক কিংবা অনৈতিক যেটাই ঘটুক। বিষয়টা আর দশটা ঘটনার মতোই ছিল। কিন্তু তেমনটা আর থাকলো কই? বরং পুরো ঘটনা তুলকালাম এক কাণ্ডে পরিণত হয়ে তার ডালপালা মেলেই চলেছে, না জানি সেটা পল্লবে পল্লবে কতদূর ছড়াবে আর কতোই না সাহিত্যিক ও সাহিত্যসেবীদের প্রতি অবিমিশ্র ক্ষোভের জন্ম দেবে।

সাহিত্য পুরস্কার দেয়ায় সাহিত্য একাডেমির বাংলা ভাষা বিষয়ক উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য অনাদি রঞ্জন বিশ্বাস পদত্যাগ করেছেন। জানা গেছে, কলকাতায় সমকালীন বাংলা সাহিত্য জগতে পক্ষপাতিত্ব, যথেচ্ছাচারের রাজত্ব দেখে তিনি সাহিত্য একাডেমির কলকাতা অফিসের সংস্রব ছাড়তে চেয়েছেন। তিনি, লিখেছেন, 'রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কলকাতায় বাংলা কবিতা আক্রান্ত'। লোক-সংস্কৃতি গবেষক ও গল্পকার রত্না রশিদ বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমির তাঁকে দেয়া 'অন্নদাশঙ্কর রায় স্মারক সম্মান' ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পুরস্কার বাবদ দেয়া ১০ হাজার টাকাও তিনি ফেরত দেবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর বরাতে গণমাধ্যম জানাচ্ছে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, 'তোল্লাই দেওয়ার একটা সীমা থাকা দরকার। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) ভাল প্রশাসক হতে পারেন, কিন্তু এই সম্মানের যোগ্য নন। এই সম্মান তাঁর নেওয়া উচিৎ হয়নি। রত্না রশিদের এই অবস্থানকে কবি সুবোধ সরকার 'ওঁর অভিরুচি' বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এই পুরস্কার দেয়ার পক্ষে যাদের অবস্থান, তাঁরা অন্যদের মতামতকে হিংসুটেদের পক্ষাবলম্বন বলে মনে করছেন। এই অবস্থান বাংলা একাডেমির সভাপতি ব্রাত্য বসু যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন কবি সুবোধ সরকারের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ কবিও। তাঁরা এই প্রসঙ্গে অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে শুরু করে উইনস্টাইন চার্চিলকেও টেনে এনেছেন। এরা পুরস্কার পেলে-নোবেল পেলে কোনো দোষ হয় না, দোষ হয় কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। তাঁরা অবশ্য এসব বলার মধ্য দিয়ে নিজেদের পক্ষে যে সব যুক্তি হাজির করেছেন-তার মধ্যেও একটা 'প্রশ্ন' রয়ে গেছে। যেমন:

এক. তাঁরা বলছেন মুখ্যমন্ত্রীর এই স্বীকৃতি শুধু কবিতার জন্য নয়। যদি তাই-ই না হয় তাহলে সাহিত্য পুরস্কার কেন তাঁকে দিতে হবে?

দুই. শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মতামত নিয়ে মমতাকে দেয়া হয়েছে এই পুরস্কার। কিন্তু এই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কারা  সেটা যেমন জানা যায়নি, তেমনি জানা যায়নি তারা নিজেদের চেয়েও মমতাকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করছেন মহত্তম ঔদার্যে, নাকি ক্ষমতার রোশনাইয়ে নিজেদের মেলে ধরবার অভিপ্রায়ে।

বাংলাদেশে এস এম রইজউদ্দিন আহমেদ ও আমির হামজাকে পুরস্কার দেওয়ার বিষয়  ব্যাপক সমালোচনার মুখে দুজনের পদকই বাতিল করা হয়। তখন একটা অদ্ভুত বিষয় সবাই নিশ্চয় খেয়াল করেছেন। সব প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া ছিল শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এছাড়া যেন প্রতিবাদের আর কোন উপায় নেই-নজির থাকতে পারে না। কিন্তু প্রতিবাদ কেমন হয়-হতে পারে তা যেন দেখিয়ে দিলেন অনাদি রঞ্জন বিশ্বাস ও রত্না রশিদ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের এখানে পদক দেয়ার পর না নেয়ার ইতিহাস বা নজির বেশ আগে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে নেই। বিশেষ করে ৯০ পরবর্তী বাংলাদেশে যখন দলদাস হওয়ায় বেশিরভাগ লেখক-কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন সেটা হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারে না। পারে কেবল ফেসবুকে তুবড়ি ছোটাতে। জসীম উদ্দীন, হুমায়ুন আজাদ, মামুনুর রশীদ-এর মতো  কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পদক বা পুরস্কার না নিয়ে কীভাবে প্রতিবাদের ভাষা জারি রাখতে হয়, শিল্পের সাধনা করতে হয়। বলা যায় ঝাঁকের কৈ না হয়ে ওইরকম প্রতিবাদ ও সাধনার মধ্যেই নিহিত থাকে যথার্থ মহত্ব ও একজন প্রকৃত শিল্পীর অভিপ্রায়- অভিলক্ষ্যসমূহ।

স্বাধীনতার আগে একটা পুরস্কার গ্রহণ নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। যে উপন্যাসের জন্য ওই লেখককে পুরস্কার দেয়া হয় এবং যাকে উপজীব্য করে প্রতীকী উপস্থাপনে রচিত হয় উপন্যাসটি-ঔপন্যাসিক তাঁর কাছে থেকেই পুরস্কার গ্রহণ করেন।

এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক দেয়ায় অনেক বেশি ব্যথিত হয়েছিলেন বাংলা একাডেমির সাবেক এক মহাপরিচালক। ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে তিনি উগড়ে ছিলেন সমুদয় দুঃখ-কষ্ট। অথচ তিনিই  পুরস্কার প্রাপক নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এবং সকল প্রকার প্রকার নিয়ম-কানুনকে থোড়াই কেয়ার করে নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু পরিচালনা করেছেন। যে প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রধান ছিলেন সেখানে তার সময় কোনো একটা নিয়োগ নিয়মের মধ্যে থেকে হওয়ার কোনো নজির নেই । সুতরাং যে নিয়মকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেছেন। প্রতিষ্ঠানকে-তাও আবার সরকারী প্রতিষ্ঠানকে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার খেলনায় পরিণত করেছেন। তিনি যখন নিয়মের কথা বলেন কিংবা তার অন্যায়-অনিয়মের দৌলতে যারা সুবিধাবাদের আখের নিশ্চিত করেছেন, সেইসব বশংবদ সুবিধাবাদীরা যখন নিয়মের জন্য মায়াকান্না করেন, তখন ঈশ্বর মুচকি হাসেন, আর আমরা কেবলই অসহায় বোধ করি, নির্লজ্জদের মুখপানে চেয়ে নিজেরা লজ্জিত হই।

আমাদের কবিরা কায়দা করে স্বাধীনতা পদক আদায় করে নেন। সুযোগ বুঝে পাঠ্যবই নিজেদের কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেন, পদ ও পদবির মোহে হয়ে উঠেন একএকজন ক্রেও কেরাডাংয়ের চেয়েও প্রমাণ সাইজের দলদাস সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কবিরা যে কোন কিছুতেই নিজেদের যা বলার সেটা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না-পদ ও পদবির দিকে লক্ষ্য রাখেন না। সাহস করে সত্য বলাই যেমন বুদ্ধিজীবীর ধর্ম-ওদেরও তাই-অবশ্য সবার নয় কারও কারও। তাইতো শঙ্খ দাসের কবিতায় মেলে দ্ব্যার্থহীন এক উচ্চারণ: 'দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাস্তা জুড়ে খড়গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন'। 

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে পুরস্কার দেয়ার পরও যে সমালোচনা হচ্ছে সেটাই হচ্ছে ওদের সংস্কৃতির সৌন্দর্য। শত ফুল ফুটতে দেওয়ার যুতসই ও যথার্থ মনোবৃত্তি, সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি ও সাহস। আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা কি সেই শক্তি ও সাহসের জায়গাটা কর্ষণ করার চেষ্টা করছি? একটা সমাজে- সংস্কৃতিতে একজন অনাদি রঞ্জন বিশ্বাস, একজন রত্না রশিদ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা গত বছর প্রয়াত একজন শঙ্খ ঘোষ থাকা কতোটা জরুরি-অপরিহার্য, সেটা কি আমরা বোঝার চেষ্টা করি? মমতাকে সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ায় হুজুগে বাঙালির স্বভাবজ বৈশিষ্ট্যে আমরা যে দিকটায় শঙ্কিত ও ভূতগ্রস্ত। তেমনটা না ভেবে আমরা কি উল্টো করেও ভাবতে পারি না? 

Comments

The Daily Star  | English
Inner ring road development in Bangladesh

RHD to expand 2 major roads around Dhaka

The Roads and Highways Department (RHD) is going to expand two major roads around Dhaka as part of developing the long-awaited inner ring road, aiming to reduce traffic congestion in the capital.

17h ago