লুডমিলা পেত্রুশেভাস্কায়া: বাস্তবতার ক্যানভাসে রূপকথার ছবি আঁকেন যিনি

বর্তমান সময়ে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক হচ্ছেন লুডমিলা পেত্রুশেভাস্কায়া। তিনি ১৯৩৮ সালে মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। লুডমিলা গায়িকা হতে চেয়েছিলেন। তা হতে পারেননি। কিন্তু ছাত্রাবস্থায় কবিতা লিখতেন, লিখতেন চিত্রনাট্য। কিন্তু একসময় পুরোদস্তুর লেখক হয়ে উঠবেন- এমনটি ভাবেননি তিনি।
লুডমিলা পেত্রুশেভাস্কায়া। ছবি : সংগৃহীত

বর্তমান সময়ে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক হচ্ছেন লুডমিলা পেত্রুশেভাস্কায়া। তিনি ১৯৩৮ সালে মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। লুডমিলা গায়িকা হতে চেয়েছিলেন। তা হতে পারেননি। কিন্তু ছাত্রাবস্থায় কবিতা লিখতেন, লিখতেন চিত্রনাট্য। কিন্তু একসময় পুরোদস্তুর লেখক হয়ে উঠবেন- এমনটি ভাবেননি তিনি।

অথচ আজ তাকে নিয়ে চারদিকে আলোচনা চলছে। এই অবস্থায় আসতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এখন তিনি নিয়মিত রূপকথার গল্প ও কবিতা লেখেন, আঁকেন কার্টুন। তার নাটক ও গদ্য বিশ্বের ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

লেখক-চিত্রনাট্যকার লুডমিলা পেত্রুশেভাস্কায়ার সাহিত্যে উঠে এসেছে জীবনের কুৎসিত রূপ ও অস্বস্তিকর অধ্যায়। একসময় সোভিয়েত সরকার তার লেখালেখির ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ চাপিয়ে দিয়েছিল। এর থেকে তিনি মুক্তি পেতে শুরু করেন গত শতকের আশির দশকে। এই দশকেই তার 'শ্বাশত ভালোবাসা' বইটি প্রকাশ হয়। তার রচিত 'সময় : রাত' নামের উপন্যাসটি ১৯৯২ সালে রাশিয়ান বুকার পুরস্কারের চূড়ান্ত ধাপ পর্যন্ত লড়াই করে। তার একটি গল্প সংকলনের ইংরেজি অনুবাদ ২০০৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের খেতাব জিতেছিল। 

লুডমিলা লেখালেখি শুরু করেন গত শতকের ষাটের দশকে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যকার সময়ে তার প্রায় কোন লেখাই নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকাশ পায়নি। এটা সেই সময়ের কথা যখন, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সাহিত্যে কেবল শুভ্র-সুন্দর ও সরল রুশ জীবনের প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লুডমিলার তার সাহিত্যে তুলে আনেন বিষাদগ্রস্ত বাস্তবতা।

যে কারণে সরকারের রোষানলে পড়ে যান লুডমিলা। নজরদারি, ফোনে আড়ি পাতা, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে তার জীবন কঠিন হয়ে উঠলেও তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। নিজের দর্শন, সাহিত্য-ভাবনার প্রশ্নে কোন আপস করেননি। 

শুধু তাই না- প্রকাশকরা তার একের পর পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিলেও, তিনি ক্রমাগত লিখে যেতে থাকেন। জাতীয় থিয়েটারগুলোতে যখন তার নাটকের মঞ্চায়ন বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন তিনি ঠিকই গোপনে তার নাটকের মঞ্চায়ন করে ছাড়েন। 

১৯৭৯ সালে অনেক পুরস্কার জেতা অ্যানিমেটেড ফিল্ম 'টেইল অফ টেইলসে'র যুগ্ম লেখক হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেন। রাশিয়া তখন থেকে তার কাজগুলোর স্বীকৃতি দিতে শুরু করে এবং তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৯১ সালে জিতে নেন পুশকিন পুরস্কার, ২০১০ সালে জেতেন 'ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড'।

রুশ জনজীবনকে সাহিত্যে উপস্থাপন করতে গিয়ে লুডমিলা বরাবর নিজের সম্মুখ অভিজ্ঞতা ও মানুষের ব্যাপারে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের দ্বারস্থ হয়েছেন। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, নিজেকে তিনি একজন ডকুমেন্টারি লেখক হিসাবে বিবেচনা করেন।

তার গল্পে তিনি রুশ জীবনকে তীব্র নিরাশার ভেতর আবিষ্কার করেন। কিন্তু সেই আবিষ্কার ও নিরাশার মধ্যেও থাকে আশ্চর্যরকম মুগ্ধতা জাগানিয়া সূক্ষ্ম ও বিশদ বর্ণনা। একইসঙ্গে, লুডমিলা জীবনের বাঁকে বাঁকে শুনতে পাওয়া মানুষের কণ্ঠকেও নিজের সাহিত্যে জায়গা করে দেন।  

লুডমিলা পেত্রুশেভাস্কায়ার গল্প বলার ধরন অনন্য। তার গল্পের চরিত্রদের সাদামাটা, উচ্ছ্বাসহীন জীবনকে ঘোর আঁধার জাপটে ধরলেও, সেসব জীবন দিয়ে তিনি অশুভ, বিপজ্জনক রূপকথার সুতা বোনেন। নিষ্ঠুর হাস্যরস সৃষ্টি কিংবা গল্পের বিষাদগ্রস্ত নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের ক্ষণিক স্বস্তির জন্য তিনি রূপকথার মমতাময়ী চরিত্রের আগমন ঘটান। 

তার গল্পের চরিত্রদের প্রায়শ দেখা যায় রূপকথার জাদু-ক্ষমতার অধিকারী হতে। যেই ক্ষমতা দিয়ে তারা দৈত্য বধ করে অমূল্য কিছু ছিনিয়ে আনতে পারে না। সর্বোচ্চ সেই ক্ষমতা তারা ব্যবহার করেন নিজেদের নিত্যকার সংগ্রামের জন্য। এই সংগ্রামের কোন বিশেষ লক্ষ্য থাকে না। থাকে কেবল কোনোভাবে টিকে থাকার তাড়না।

লুডমিলারের 'দ্য স্টোরি অফ অ্যা পেইন্টার' গল্পের চরিত্রদের মধ্যে এমন টিকে থাকার নিরন্তর চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। গল্পে ক্রমাগত প্রবঞ্চনার শিকার হওয়া একজন চিত্রকর, অকেজো-পায়ের তরুণী ও বিরল প্রকৃতির এক ঠগবাজের দেখা মেলে। তারা সবাই জীবনটাকে বয়ে বেড়ানোর জন্য কিংবা কেবল টিকে থাকার জন্য নিজস্ব জাদুশক্তি, প্রবঞ্চনা, শিল্পসত্তা ও আবেগের ব্যবহার করেন। অদ্ভুত এক লোকালয়ে বাস করলেও সেই লোকালয় কখনো তাদের নিজেদের হয় না। তারা পরদেশীই রয়ে যান। স্বপ্নে কিংবা জাগরণে ক্রমাগত প্রবঞ্চনার শিকার হওয়া গল্পের সেই চিত্রকর লোকালয়ের পথকে জাদুময় ক্যানভাস বানিয়ে তাতে ছবি আঁকেন।

'দ্য স্টোরি অফ অ্যা পেইন্টার' গল্পটি পড়তে গিয়ে পাঠক রূপকথা নাকি বাস্তবতায় ডুবে ছিলেন, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না। পাঠকের কাছে মনে হয়, গল্পে হয়তো চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বই মুখ্য। আর জীবনই প্রধান, বেঁচে থাকাই সার্থকতা। 

লুডমিলা যখন ছোট ছিলেন, তখন তার মা তাকে একটি অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেন। তার ভাষ্য,  অনাথ আশ্রমে থাকার সময় তিনি মগজে অজস্র গল্পের জন্ম দিতেন। যেই চর্চা তাকে পরবর্তী সময়ে সাহিত্যচর্চায় ভীষণভাবে সাহায্য করেছে।

সবমিলিয়ে সাহিত্য সমালোচকরা লুডমিলা পেত্রুশেভাস্কায়াকে আধুনিক রূপকথার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করেন। অনেকে মনে করেন, সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাও আছে লুডমিলারের।

Comments