পর্যালোচনা

সত্য উন্মোচনে দস্তয়েভস্কির 'সাদা রাত' 

'হোয়াইট নাইটস' পড়তে গিয়ে মনে হয়, উপন্যাসটি হৃদয়ের এক গোপন কোণের নরম আলো। সেখানে স্বপ্ন, একাকিত্ব, আর প্রেমের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা একে অপরের সঙ্গে জড়ানো গল্প বুনে দিয়ে যায়। দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের জগৎ মানুষের মনের গভীর দ্বন্দ্ব, তার অস্থিরতা, জীবনের অর্থ খোঁজার অবিরাম যাত্রা।

১৮৪৮ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে লেখা 'হোয়াইট নাইটস' তার প্রাথমিক কাজগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে তিনি তার পরবর্তী মহৎ সৃষ্টি, যেমন 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' বা 'দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ'-এর ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যায়, কেন তাকে মানুষের মনের গভীরতম সংঘাতের দার্শনিক বলা হয়। তার লেখনী শুধুমাত্র গল্প-উপন্যাসের চেয়ে বেশি কিছু, নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে।

আধুনিক উপন্যাস যদি হয় ব্যক্তির ভেতরের জটিলতা আর বাস্তব জীবনের সবচেয়ে সত্য চিত্র, তবে 'হোয়াইট নাইটস' তার একটি নিখুঁত চিত্রাঙ্কন। একাকিত্ব, স্বপ্নময়তা, আর প্রেমের মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প। গল্পটি ১৯ শতকের রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের কোনো এক 'সাদা রাত'র পটভূমিতে লেখা, যখন গ্রীষ্মে সূর্য প্রায় ডোবে না, শহরটি স্বপ্নীল আলোয় মোহময় হয়ে ওঠে। গল্পের প্রেক্ষাপট যেন গল্পের পরিবেশ নয়, নামহীন কথকের মনের অবস্থার প্রতিচ্ছবি। দস্তয়েভস্কি এই পরিবেশকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে পুরো সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটাই হয়ে উঠেছে গল্পের জীবন্ত চরিত্র।

গল্পের কেন্দ্রে এক নামহীন যুবক, যে নিজেকে 'স্বপ্নদ্রষ্টা' বলে ডাকে। সে সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর কল্পনার জগতে ডুবে থাকে। তার জীবন একাকী, বন্ধুহীন, বাস্তবতার সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় নেই। সে শহরের রাস্তা, বাড়ি, এমনকি অপরিচিত মানুষদের নিয়ে কল্পনার কথা বলে আর হেঁটে বেড়ায়। এই স্বপ্নদ্রষ্টার জীবনে হঠাৎ আসে নাস্তেঙ্কা, এক তরুণী, যে তারই সমান্তরালে থাকা কেউ, যে তার মতোই একাকিত্বে ভোগে। কিন্তু নাস্তেঙ্কার একাকিত্ব অন্যরকম, আর পেছনে একটা কারণও আছে। নাস্তেঙ্কার হৃদয় এক বছর আগে চলে যাওয়া এক প্রেমিকের জন্য অপেক্ষায় ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে।

৪ রাতের সংক্ষিপ্ত সময়ে তাদের কথোপকথন, স্বপ্ন, আর আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে দস্তয়েভস্কি মানুষের মনে অপূর্ব ছবি আঁকেন। কথক নাস্তেঙ্কার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে, কিন্তু তার ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পায় না। নাস্তেঙ্কার হৃদয় তার প্রাক্তন প্রেমিকের জন্য অপেক্ষায় থাকে। শেষ পর্যন্ত, যখন সেই প্রেমিক ফিরে আসে, নাস্তেঙ্কা তার কাছেই চলে যায়। কথকের হৃদয় ভেঙে যায়, কিন্তু সে এই বেদনার মধ্যেও এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পায়। তিনি বলেন-- "আমার ঈশ্বর, আমার জীবনের একটি সম্পূর্ণ মুহূর্ত! এটি কি সুখের জন্য যথেষ্ট নয়, একটি সম্পূর্ণ জীবনের জন্য?" 

কথাগুলো তার মনের দ্বন্দ্বকে ধরে, যেখানে বেদনা আর সুখ মিশে যায়। দস্তয়েভস্কির সাহিত্য শুধু গল্প বলে না, মানুষের অস্তিত্বের গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে। এতে তিনি একাকিত্ব, স্বপ্ন, আর প্রেমের মাধ্যমে মানুষের জীবনের অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা দেখান। কথকের একাকিত্ব যেন আমাদের সবার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই শূন্যতার প্রতিফলন। তিনি বলেন-- "আমি কেবল স্বপ্ন দেখি। বাস্তব জীবন সম্পর্কে আমি এত কম জানি যে, এই মুহূর্তগুলো আমি বারবার স্বপ্নের মধ্যে যাপন করি, পুরো জীবনে এমন মুহূর্তগুলো আমি খুব কমই অনুভব করেছি। আমি সারা রাত, সারা সপ্তাহ, সারা বছর তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব।" 

এই কথায় তার স্বপ্নময়তা আর বাস্তবতার সঙ্গে দূরত্ব স্পষ্ট। দস্তয়েভস্কির দর্শনে, একাকিত্ব কোনো অভিশাপ নয় বরং এটি নিজেকে বোঝার একটি পথ। তার মতে, মানুষের জীবন বেদনা আর সুখের মিশ্রণ এবং দুয়ের মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পাই। দস্তয়েভস্কি এতে প্রেমের একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দেন। তার কাছে প্রেম কেবল একটি আবেগ নয়, এটি একটি অস্তিত্বগত অভিজ্ঞতা। প্রেমের মধ্যে দিয়েই জীবনকে যাপন করেন, স্বপ্নে বারবার সেই প্রেমিকের অস্তিত্বের পুনর্জীবন ঘটান। কথকের প্রেম অপূর্ণ থেকে যায়, কিন্তু সেই অপূর্ণতার মধ্যেই সে নিজের অস্তিত্বের একটি নতুন অর্থ খুঁজে পায়। 

এটি দস্তয়েভস্কির জীবনদর্শনের একটি মূল বিষয়—মানুষের জীবনের সৌন্দর্য তার পূর্ণতায় নয়, তার অসম্পূর্ণতায়। নাস্তেঙ্কার চরিত্রের মাধ্যমে তিনি দেখান, প্রেম একটি দ্বিমুখী পথ। এটি মুক্তি দেয়, আবার বন্ধনও তৈরি করে। এই দ্বন্দ্বই দস্তয়েভস্কির সাহিত্যকে এত গভীর আর অনন্য করে তোলে।

দস্তয়েভস্কির ভাষা 'হোয়াইট নাইটস'-এ এতটাই সহজ, সুন্দর, আর প্রাঞ্জল যে, পড়তে পড়তে পাঠক যেন সেন্ট পিটার্সবার্গের সেই স্বপ্নীল রাস্তায় হেঁটে বেড়ান। তার বর্ণনায় একটি কাব্যিক ছন্দ আছে, যা শহরের আলো, নদীতীর, আর রাতের নিস্তব্ধতাকে জীবন্ত করে তোলে। তিনি শুধু দৃশ্য বর্ণনা করেন না, চরিত্রের মনের গভীরতম আবেগকে ধরেন। কথকের একাকিত্ব, নাস্তেঙ্কার অপেক্ষা—সবকিছুই তার ভাষায় এমনভাবে ফুটে ওঠে যে, পাঠক বারবার নিজের জীবনের সঙ্গে সবকিছু অজান্তেই মিলিয়ে ফেলবেন। তার বাক্য সহজ, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি দীর্ঘশ্বাস। যেন নিজের মনের সবচেয়ে গভীরতম কুয়োর ধ্বনি দস্তয়েভস্কির কন্ঠে বলিয়ে নেয়া।

দস্তয়েভস্কির সাহিত্য মান পুরোটাই তার চরিত্র সৃষ্টি আর মনস্তাত্ত্বিক গভীরতায়। কথক আর নাস্তেঙ্কা দুজনেই এমন চরিত্র, যাদের মধ্যে প্রতিমুহূর্তে নিজেদের ছায়া দেখি। কথকের স্বপ্নময়তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরাও কিভাবে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে কল্পনায় আশ্রয় নিই। নাস্তেঙ্কার অপেক্ষা তো আমাদেরই অপেক্ষা। আমরা সবাই কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করি—হয়তো ভালোবাসা, হয়তো স্বপ্নের পূর্ণতা।

২০২৫ সালে এসে 'ডিজিটাল স্পেস'-এ আমাদের জীবনযাপন অনেকটা দস্তয়েভস্কির 'হোয়াইট নাইটস' এর সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে বেঁচে থাকার মতই। আজকের একাকিত্ব কথকের হাজারো মানুষের মাঝেই শহরে একাকীত্বকে আলিঙ্গণের মতো—আমরা শত মানুষের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই একা। সোশ্যাল মিডিয়ার ফিল্টার করা ছবিতে কল্পনার গল্পে হারিয়ে যাই, ঠিক যেমন কথক তার কল্পনার জগতে ডুবে থাকে। প্রেমের ক্ষেত্রেও আমরা নাস্তেঙ্কার মতো অপেক্ষায় থাকি—হয়তো একটি মনেরমত সম্পর্কের জন্য, হয়তো কারও ফিরে আসার জন্য। কিন্তু 'হোয়াইট নাইটস' শেখায় প্রেমের সৌন্দর্য তার ফলাফলে নয়, তার যাত্রায়। আমরাও এই কঠোর সত্য মেনে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাই। কথকের জীবনে নাস্তেঙ্কার আগমন তাকে ব্যথা দিয়েছে, কিন্তু সেই ব্যথার মধ্যেই সে বেঁচে থাকার একটি নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছে। আমাদের জীবনের প্রতিটি সম্পর্ক, এমনকি যেগুলো অপূর্ণ থেকে যায়,কিছু না কিছু শেখায়।

তরুণ প্রজন্ম, যারা ডেটিং অ্যাপস, অনলাইন সম্পর্ক, আর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রেমের জটিলতার মুখোমুখি, তাদের জন্য উপন্যাসটি আয়না স্বরূপ। দেখা যায় নিজের মধ্যে গভীরে প্রবেশ করার একটি সুযোগ পাওয়া।

বইটি একটি অভিজ্ঞতা, যা আপনাকে নিজের একাকিত্ব, স্বপ্ন, আর আকাঙ্ক্ষার মুখোমুখি করবে। দস্তয়েভস্কির লেখনীতে এক অদ্ভুত জাদু আছে, যা পাঠককে গল্পের ভেতর টেনে নিয়ে তাদের নিজের জীবনের প্রশ্নগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি করে। আপনি যদি কখনো একাকিত্বে ভুগে থাকেন, প্রেমে হতাশ হয়ে থাকেন, বা নিজের স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যান, তবে এই বই আপনার জন্য। একটি গল্প শোনাতে গিয়ে বইটি আপনার নিজের গল্প খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।

বাংলায় দস্তয়েভস্কির 'হোয়াইট নাইটস' মূল রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম। তার অনুবাদ সবময়েই প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য হয়ে থাকে। পাঠক নির্দ্বিধায় অবসর প্রকাশনির অনুবাদটি পড়তে পারেন। ২০২৫ সালে আমরা দস্তয়েভস্কির জন্মের ২০৪তম বছর পার করছি। তার সাহিত্য আজও আমাদের মুগ্ধ করে। কারণ তিনি শুধু গল্প বলেননি, মানুষের হৃদয়ের গভীরতম সত্য উন্মোচন করেছেন। 'হোয়াইট নাইটস' পড়ে মনে হয়, এটি কেবল ১৯ শতকের রাশিয়ার গল্প নয়, আমাদের সবার গল্প—যারা স্বপ্ন দেখি, হৃদয়ভঙ্গের মধ্যেও বাঁচতে শিখি।

Comments

The Daily Star  | English

Trump, not Putin, budges

US president shifts stance after Alaska talks fall short of ceasefire

34m ago