শান্তিনিকেতনের দুই অমিতা সেন

অমিতা সেন ও অমিতা সেন খুকু।

শান্তিনিকেতনে ছিলেন দুই জন অমিতা সেন। রবীন্দ্রনাথ একজনকে ডাকতেন শ্রাবণী বলে, অন্যজনকে খুকু। প্রথমজনকে শান্তিনিকেতনের সবাই ডাকতেন 'আশ্রমকন্যা' বলে।  বাংলা 'শ্রাবণ' মাসে জন্ম বলে রবীন্দ্রনাথ ডাকতেন শ্রাবণী বলে। এই শ্রাবণী বা অমিতা সেনের ছেলে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।

আচার্য শাস্ত্রী ক্ষিতিমোহন সেনের মেয়ে অমিতা সেন। রবীন্দ্রনাথের হরিহর আত্মাদের একজন ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। সংস্কৃতে এমএ পরীক্ষায় অবিশ্বাস্য ফলাফলের জন্য তাকে দেওয়া হয়েছিল শাস্ত্রী উপাধি। ক্ষিতিমোহন সেন তখন চাম্বারাজ এস্টেটের শিক্ষাসচিব। রবীন্দ্রনাথই ক্ষিতিমোহন সেনকে শান্তিনিকেতনে ডেকে এনে শান্তিনিকেতন আশ্রমের অধ্যক্ষের দায়িত্ব তুলে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী হিসেবে ১৯২৪ সালে চীন সফরও করেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন।

পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। অমিতা সেনের যখন জন্ম তখন ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রমের অধ্যক্ষ। বলে রাখা ভালো অমিতা সেনদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।

ক্ষিতিমোহন সেন অমিতা রাখলেও শ্রাবণ মাসে জন্ম বলে রবীন্দ্রনাথ নাম রেখেছিলেন 'শ্রাবণী।  রবীন্দ্রনাথের 'নটীর পূজা' নাটকে প্রথম অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল শ্রাবণীর। 'নটীর পূজা' নাটকে মল্লিকা চরিত্রে তার অভিনয়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এছাড়া শাপমোচন নাটকে রাণী চরিত্রে অমিতা সেনের অভিনয় তো কিংবদন্তীতুল্য। শান্তিনিকেতনে ঋতুভিত্তিক সব উৎসব আয়োজনে অমিতা সেন ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঋতুনাট্যে তার উপস্থিতি ছিল অগ্রগণ্য। অভিনয় তো বটেই সংগীতেও  শ্রাবণী ছিলেন বিশেষ পারদর্শিনী। সংগীতে তার গুরু ছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ। অভিনয় ও সংগীতের পাশাপাশি জাপানি মার্শাল আর্ট জুজুৎসুও শিখেছিলেন অমিতা সেন। শান্তিনিকেতনের জুজুৎসুর প্রশিক্ষক ছিলেন তাগাকাকির। তাগাকাকির সুনাম তখন শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কলকাতা থেকে অনেকে কেবল জুজুৎসু শেখার জন্য তাগাকাকির কাছে আসতেন। অমিতা সেনের দ্রুত আয়ত্বের মেধায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তাগাকাকিও।

শান্তিনিকেতনের পথে একসঙ্গে দুই খুকু। মাঝে অমিতা সেন খুকু ও বাম পাশে আশ্রম কন্যা অমিতা সেন। দুজনের পাশে সর্বডানে খুকুর বোন ললিতা সেন।

২০ বছর বয়সে অমিতার বিয়ে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশুতোষ সেনের সঙ্গে। আশুতোষ সেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে পূর্ণাঙ্গ বিভাগ হিসেবে গড়ে উঠেছিল মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ। বিয়ের ১ বছরের মাথায় অমিতা সেনের কোলজুড়ে আসে অমর্ত্য। এরপর ঢাকাতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন অমিতা সেন। দেশভাগের পর স্বামীসহ ভারতে চলে যান অমিতা। আশুতোষ সেনের কাজের সুবাদে প্রথমে দিল্লি এবং পরবর্তীতে ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন তিনি।

আশুতোষ সেন যখন কলকাতায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান তখন শান্তিনিকেতনেই থাকতেন অমিতা সেন। শান্তিনিকেতন থেকে তার সম্পাদনাতেই বের হতো 'শ্রেয়সী' পত্রিকা। শান্তিনিকেতনেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণী।

অমিতা সেনকে নিয়ে যশোধরা বাগচী 'শতবর্ষের আলোতে 'খুকু-অমিতা'তে লিখেছিলেন, 'আমরা যখন বড়ো হয়ে উঠছি, তখন শুনতাম, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে সেই সময় দুই 'অমিতা সেনে'র রমরমা- একজন নাচে ও একজন গানে। নাচতেন কিরণবালা ও ক্ষিতিমোহন সেনের ছোট কন্যা- আমার অমিতা পিসি।'

শান্তিনিকেতনের খুকু। আরেক অমিতা সেন। বয়সের পরিধি ছিল তার মাত্র ২৬ বছর। এই ২৬ বছর বয়সেই অবিশ্বাস্য এক সংগীত জীবনের অধিকারিণী  ছিলেন অমিতা সেন। 'খুকু' নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অমিতা সেন 'খুকু'র ছিল পিতৃকন্যাসম সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ অমিতা সেন খুকুকে নিয়েই লিখেছিলেন 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে' গানটি।

রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারী দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ছাত্রী ছিলেন অমিতা সেন। রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি গানকে প্যারোডি আকৃতি দিয়ে অমিতা সেনকে নিয়ে নিশিকান্ত রায়চৌধুরী লিখেছিলেন "কালনাগিনী আমি তারে বলি/ কালো তারে বলে পাড়ার লোক/ শুনেছিলাম বই গুদামের ঘরে/ কালো মেয়ের কালো মুখের ফোঁস।"

রবীন্দ্রনাথের গানকে অনন্যভাবে ধারণ করতেন খুকু। ১৯৩৫ এর জুলাই মাসে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হলে রবীন্দ্রনাথ গানের জন্য নির্ভর হয়ে পড়েন অমিতা সেন খুকুর উপর।

দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ খুকুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'তোর চিঠি পড়ে মনে পড়ে গেল দিনু তার সকল ছাত্রের মধ্যে তোকেই সকলের চেয়ে স্নেহ করত। সেই স্নেহের দান তুই অজস্র পেয়েছিলি। তোর জীবনে তার সঞ্চয় ফুরোবে না। যা পেয়েছিস তা রক্ষা করার ভার এখন তোদেরই পরে রইল।'

রবীন্দ্রনাথ অঝোর প্রশংসা করলেও একটা সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অমিতা সেন খুকুর সম্পর্ক চূড়ান্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন খুকু গানের পাশাপাশি নাচ এবং অভিনয়ও করুক। কিন্তু খুকু কেবলই গান নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।

একসময় খুকু কলকাতায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর চাকরি নিলেন কলকাতার বীণাপাণি স্কুলে সামান্য বেতনে। রবীন্দ্রনাথ তখন তাকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছিলেন, 'তোর শক্তি আছে, অনুরাগ আছে এবং কণ্ঠ আছে। সেইজন্যে আমার এই কাজে তোকে পেতে অনেক দিন থেকে ইচ্ছা করেছি। ভয় ছিল তোর দুরাশা হয়তো অন্য কোনও পথে ধাবিত। যদি তা না হয় এবং যদি আমার প্রতি থাকে তোর ভক্তি এবং আশ্রমের প্রতি নিষ্ঠা, তবে অন্য কর্মজাল থেকে নিষ্কৃতি নিয়ে এখানে চলে আয়।'

কিন্তু সে যাত্রায় এক অদ্ভুত শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন খুকু। চেয়েছিলেন তার ভালোবাসার সঙ্গী শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায় কোথাও স্থায়ী হোক। শম্ভুনাথের যক্ষ্মা হলে নিজেই দেখভাল করতেন তিনি। শম্ভুনাথের চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের সোনার গয়না থেকে অসামান্য ফলাফলের জন্য পাওয়া স্বর্ণের মেডেলগুলোও।  শর্তে খুকু বলেছিলেন যদি শম্ভুনাথকে বিশ্বভারতীতে একটি চাকরি দেয়া হয় তবেই শান্তিনিকেতনে যাবেন তিনি। প্রস্তাবটা মোটামুটি পাস হওয়ায় শেষপর্যন্ত খুকু শান্তিনিকেতনে ফিরেছিলেনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আর দরকার পড়লো না। একদিন শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা এসে শম্ভুনাথকে দেখতে গিয়ে খুকু দেখলেন কোন এক অধ্যাপকের মেয়ের সঙ্গে পাহাড়ে চলে গেছে শম্ভু। বাড়িওয়ালা কেবল বললেন, ভাড়াটা বাকি রয়েছে। আপনি এলে চেয়ে নিতে বললেন।' 

রাগে দুঃখে খুকু আর শান্তিনিকেতনে আর ফিরে যাননি। আজীবন খুকুকে 'তুই' সম্বোধন করা রবীন্দ্রনাথ তুমি সম্বোধন করে চিঠিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে খুকুকে লিখেছিলেন, 

'যখন এতটা অবনতি স্বীকার করতে সম্মত হোলে দেখা গেল তখন সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলুম। তোমার বন্ধুকে আশ্রমে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত করবার জন্যে তুমি আমাকে অনুরোধ করেছিলে। আমি তদনুসারে আশ্রমের কর্তৃপক্ষদের কাছে আমার প্রস্তাব জানিয়েছিলুম। কাজ খালি ছিল না তবু তারা সম্মত হয়েছিলেন। এটা নিয়ম, এতে মানী লোকের মানহানি হয় না। ভাইসরয়কে নিযুক্ত করবার সময়েও ক্যাবিনেটে আলোচনা হয়ে থাকে। ব্যাপারটাকে যদি অপরাধজনক মনে করে থাকো সে অপরাধ তোমার একলার।" রবীন্দ্রনাথ ও দেখতে ছাড়েননি। একসময় রবীন্দ্রনাথ খুকুকে দেয়া নিজের গান রেকর্ড করার অনুমতি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এমনকি খুকু ছয়টি গানের যে  রেকর্ড করেছিলেন তার প্রকাশ ও বিক্রি নিষিদ্ধ করতে প্রচণ্ড তৎপর হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

খুকুর মৃত্যুর সংবাদ ছাপা হয়েছিল মহিলা সংবাদে।

একপর্যায়ে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন খুকু। প্রথমদিকে চিকিৎসকেরা টিবি রোগের চিকিৎসা করলেও তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন ভিন্ন আরেক রোগে। ভীষণ আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও রোগাক্রান্ত খুকুর উপর একসময় দয়াপরবশ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন তাকে।

১৯৪০ সালের ২৮ জানুয়ারিতে  প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'খুকু আজ কারমাইকেল হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। তাকে আমি ক্ষমা করলুম। তার সেই ছয়টা রেকর্ড মুক্ত করে দিস।'

দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তার সম্পাদকের বৈঠকে অমিতা সেন খুকুকে নিয়ে লিখেছিলেন, 'অমিতা সেন, যাকে 'খুকু বলেই শান্তিনিকেতনের সবাই চিনত, তার ছিল ঈশ্বর-প্রদত্ত গাইবার ক্ষমতা। তার কণ্ঠস্বর ছিল যেমন সুরেলা ও মদির তেমনি ছিল উদাত্ত। ছেলেবেলা থেকে অদ্যাবধি রবীন্দ্রনাথের গান বহু মেয়ের কণ্ঠেই শুনেছি কিন্তু খুকুর মতো এমন সহজ সরল কণ্ঠের প্রাণঢালা গান আমি আর কোথাও শুনিনি। খুকু দেখতে ছিল কালো, কিন্তু যখন গান গাইত অপরূপ হয়ে উঠত সে নিজে, অপরূপ করে তুলত চারদিকের পরিবেশ। দীনদা তার এই প্রিয় শিষ্যাকে সব সময়ই আদর করে 'নাইটিঙ্গেল' বলে ডাকতেন এবং এই ডাক যে কতখানি সত্য তা খুকুর গাওয়া ফিরে ডাক দেখিরে পরাণ খুলে ডাক রেকর্ডটি যারা শুনেছেন তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন। খুকু অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে এবং ওর চলে যাবার সঙ্গে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল সেই কোকিল কণ্ঠীর গান।'

তথ্যসূত্র

সম্পাদকের বৈঠকে : সাগরময় ঘোষ

শতবর্ষের আলোতে 'খুকু-অমিতা' : যশোধরা বাগচী  

চিঠিপত্র : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Comments

The Daily Star  | English

Uncovering the silent deaths of migrant women

In the shadows of booming remittance flows and the quiet resilience of Bangladesh’s labour diaspora, a disturbing reality persists: numerous Bangladeshi female migrant workers, particularly those employed as domestic help in Gulf countries, are returning home in coffins.

18h ago