রাসমেলা: সুন্দরবনের গভীরের লোক উৎসব
মাঝরাতে ছোট্ট একটি নৌকা বোঝাই বাতাসা, মোমবাতি, ধূপকাঠি ও নারকেল নিয়ে সুন্দরবনের দ্বীপ দুবলার চরে পৌঁছান কয়রার জেলে অতুল সুর। প্রতিবেশী রফিকুল হককে নিয়ে সেখানে যেতে বনের ভেতরের ছোট ছোট নালাগুলো দিয়ে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে।
অতুল তার বিশ্বাস অনুযায়ী বনের রক্ষক দেবী বনবিবি ও শ্রী কৃষ্ণকে উৎসর্গ করার জন্য এই অর্ঘ্য এনেছিলেন। রাসমেলা সুন্দরবন ব-দ্বীপ এলাকার সবচেয়ে বড় উৎসব হওয়ায় তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠছিলো আনন্দ।
অতুলের মতই, বনের রক্ষক বনবিবি, গাজি কালু ও দক্ষিণ রায়কে উৎসর্গ করার জন্য মিষ্টি এনেছিলেন রফিক।
হিন্দু-মুসলমানের এই সম্মিলিত উৎসব সুন্দরবনের গহীনে ছাড়া আর কোথাও দেখা যায়না। রফিক বলেন, “বনের গভীরে গেলে মানুষ সব সময় বাঘের ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। কারণ সব সময় বাঘ আপনাকে আগে দেখে ফেলে। বনবিবি ছাড়া আর কোন দেবী বাঘের নজর থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না।”
সুন্দরবনের ভেতরে ঈশ্বর ও প্রকৃতি যেন এক হয়ে যায়। সে কারণে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য এখানে অনেকটাই ঘুচে গেছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই সমানভাবে প্রকৃতি ও প্রকৃতির দেবতাদের আরাধনা করেন সুন্দরবনে।
এখানকার ভক্তদের মধ্যে আলাদা একটা উত্তেজনা নিয়ে আসে ‘সুপার মুন’। নৌকা নিয়ে চরের সৈকতের দিকে যাওয়ার সময় প্রত্যেকের গলাতেই ছিল স্থানীয় জনপ্রিয় গান। তারা সবাই চান দেবতাদের মাধ্যমে নিজেদের মনের সাধ পূরণ করতে।
শ্রী কৃষ্ণের সম্মানে নভেম্বর মাসে রাসমেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এখানে শ্রী কৃষ্ণের পাশাপাশি সমান ভক্তি নিয়ে বনবিবি, গাজি কালু, দক্ষিণ রায়, গঙ্গা দেবীসহ প্রকৃতির অনেক দেব দেবতার পূজা করা হয়।
প্রশ্ন জাগতে পারে, এখানকার মানুষ কেন স্থানীয় দেব-দেবীদের এতোটা ভক্তি করে? এর একটা উত্তর হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি, যার ভয়ে সবসময় সন্ত্রস্ত থাকে স্থানীয় লোকজন। এর আরেকটা উত্তর হতে পারে, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এটা তাদের নিজস্ব উপায়।
বনবিবির কোলে থাকা শিশুটি হলো দক্ষিণ রায়, স্থানীয়রা যাকে বাঘ বলে মনে করে। এই একটি প্রতিমা থেকেই বোঝা যায় কিভাবে রাস মেলা বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্মিলন ঘটিয়েছে।
একই জায়গায় বনবিবি, শ্রীকৃষ্ণ থেকে শুরু করে গাজী কালু, গঙ্গা দেবী, শিবসহ অনেক দেব দেবীর প্রতিমা এই সম্প্রীতিকে প্রতিফলিত করে।
উৎসবে ‘নমিতা সম্প্রদায়’ নামের বাগেরহাটের লোক শিল্পীদের একটি দল রাস লীলা, পদাবলী ও বনবিবির জহুরানামা (দেব-দেবীর গল্প সম্বলিত গান) পরিবেশন করেন। দলের অভিনেতারা বনবিবির পৌরাণিক গল্পের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে দেখান কিভাবে বনবিবি ও তাঁর ভাইকে সুন্দরবনের মানুষ ও প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য মক্কা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
নমিতা সম্প্রদায়ের প্রধান নমিতা মিস্ত্রি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, দক্ষিণ রায় তখন জঙ্গলে শাসন করতেন। রায়ের মা নারায়ণীর সাথে যুদ্ধ করতে হয় বনবিবিকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে নারায়ণীর সাথে বনবিবির মিত্রতা গড়ে ওঠে। তখন থেকেই বনবিবি ও দক্ষিণ রায় সুন্দরবন শাসন করছেন।”
সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে প্রচলিত রয়েছে এই গুল্পগুলো। বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত গল্পে বড়খান গাজি, শাহ জাংলি, গঙ্গা দেবীর মতো চরিত্র রয়েছে। একই গল্পের যতই রকমফের হোক না কেন, এর সবগুলোই একটি জিনিসকেই প্রতিফলিত করে আর তা হলো প্রকৃতির বাস্তবতার মুখে ধর্মের ভেদাভেদ মুছে যায়।
এই এলাকায় ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে বনবিবি বনদুর্গা নামে পরিচিত ছিল (সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়দের মধ্যে এখনও এই নামটির প্রচলন রয়েছে)। মধ্যযুগে মুসলমান সেটেলাররা এই এলাকায় আসার পর বনবিবি ও দক্ষিণ রায়ের মধ্যে যুদ্ধের গল্প প্রচলিত হয়।
বঙ্গোপসাগরের সৈকত সুপার মুনের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। হাজারো ভক্তের সাথে সৈকতে দাঁড়িয়ে স্থানীয়দের সেই আধ্যাত্মিকতাকে আমরাও অনুভব করতে শুরু করি।
হাতের থালায় প্রদীপ, ফুল, মিষ্টিসহ অন্যান্য অর্ঘ্য নিয়ে বন্দনামূলক গান গাইতে গাইতে হাজারো ভক্ত সৈকতে বসে পড়েন। এদের মধ্যে কেউ কেউ বলি দেওয়া প্রাণী ও বনবিবিসহ অন্যান্য দেব-দেবীর মূর্তি এনেছিলেন। সৈকতে রাখা বাতিগুলো সাগরের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার পর নিজেদের আত্মাকে পরিশোধনের জন্য স্নান করেন ভক্তরা। এভাবেই শেষ হয় সুন্দরবনের রাস উৎসব।
Comments