‘সাপোর্টিভ যে টেকনোলজি ম্যানুভার এটা আমাদের এখানে নেই’

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া 'লিভার সিরোসিসে' আক্রান্ত হয়ে 'মৃত্যু ঝুঁকিতে' আছেন বলে জানিয়েছেন তার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মো. সিদ্দিকী (এ এফ এম সিদ্দিকী)।
রোববার রাতে খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক এ এফ এম সিদ্দিকী এসব কথা জানান।
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসা 'ফিরোজার' লনে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এ এফ এম সিদ্দিকী বলেন, 'ম্যাডামের সিরোসিস অব লিভার (লিভার সিরোসিস)। উনার ম্যাসিভ রক্তক্ষণ হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন ম্যাডামের লাস্ট টোয়েন্টিফোর আওয়ার্সের মধ্যে ব্লিডিংটা হয়নি। এখন স্টেবল আছে। কিন্তু আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি এই যে, স্টেবল আছে এটা কিন্তু বিশ্বের বেস্ট সেন্টারগুলোতে এই ধরনে রোগীর ওপর প্রচুর ডাটা আছে। এই ধরনের রোগীগুলোর ম্যানেজমেন্ট যদি ফেইলিওর হয় তাদের পরবর্তী স্টেপ কী হচ্ছে এবং তাদের কীভাবে লাইফ সেভিং করা যায়।'
এফ এম সিদ্দিকী বলেন, 'ম্যাডামের এখন যদি ট্রান্সজুগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টুসিস্টেমিক শান্ট 'টিপস' মেথড অ্যাপ্লাই করা না হয় তাহলে আগামীতে আবার রি-ব্লিডিং হওয়ার সম্ভবনা আছে। এটা নেক্সট উইকে ৫০ শতাংশ, নেক্সট ৬ সাপ্তাহে ৬০ শতাংশ এবং তার পরও যদি যায় আল্লাহ না করুক এটা অবভিয়াস ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে।'
'এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যা করছি, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টায়। এখন আমরা কিন্তু হেলপলেস ফিল করছি। এখন এরকম একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে উনি যাচ্ছেন।'
খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত সেন্টারে নিয়ে চিকিৎসার কথা আপনারা বলছেন। সেটা যদি না করা হয় তাহলে কী হতে পারে বলে আপনারা আশঙ্কা করছেন? এরকম প্রশ্নের জবাবে এভার কেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক বলেন, 'আশঙ্কা করছি আবার উনার যদি রি-ব্লিডিং হয় তাহলে রি-ব্লিডিংটাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেটাকে বন্ধ করার মতো উপায় বা সাপোর্টিভ যে টেকনোলজি ম্যানুভার সেটা আমাদের এখানে নেই।'
'সেক্ষেত্রে উনার ব্লিডিং (রক্তক্ষরণ) হয়ে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাবে', যোগ করেন তিনি।
'টিপস' পদ্ধতি কোন দেশের চিকিৎসা কেন্দ্রে হয় জানতে চাইলে মেডিকেল বোর্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, 'টিপস হাইলি টেকনিক্যাল কাজ। আমাদের দেশে টিপস করা রোগী আমি দেখিনি। যারা আমরা রোগী ডিল করি তাদের দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার রক্তক্ষরণ হলে তার সারভাইভ করা খুবই জটিল। সেজন্য এই সেন্টারগুলো আছে আমেরিকা ও ইউরোপে। ইউএসএ, ইউকে ও জার্মানিতে। সেখানে এসব রোগের চিকিৎসার জন্য অ্যাডভান্স সেন্টার আছে তারা এর চিকিৎসা করে। সেখানে দেশব্যাপী এই রোগের সেন্টার নেই, দুই-একটা আছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক এ এফ এম সিদ্দিকী বলেন, 'আমরা ম্যাডামের যারা ক্লোজড রিলেটিভ তাদেরকে জানিয়েছি, যারা উনার সঙ্গে আছে তাদের জানিয়েছি। আমরা উনাদের বলেছি, যত দ্রুত পারেন অ্যারেঞ্জ করেন বলেছি।'
তিনি বলেন, 'ম্যাডামের থার্ড টাইম ব্লিডিং হয়েছে। উনার মতো বয়সে হার্ট ফেইলিউর আছে, যার নাকি হিমোগ্লোবিন কমে যায়, যার ডায়াবেটিক আছে। এত জটিলতার মধ্যে কিডনির ডিজিজ আছে। এটা কীভাবে আমরা সাসটেইন করব যদি আমরা প্রেসারটা টিপস দিয়ে কমাতে না পারি। সেজন্য আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করেছি। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, উনার পরিবারকে জানিয়েছি এবং যত তাড়াতাড়ি পারেন আপনারা অ্যারেঞ্জ করেন। কারণ এখনো টাইম আছে। উনি স্টেবল আছেন।'
সেই সময়সীমাটা কত জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, 'এটা কেউ বলতে পারবে না পৃথিবীতে।'
বাইরে থেকে চিকিৎসক ও চিকিৎসা পদ্ধতি ঢাকায় এনে করা সম্ভব কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আপনি যদি বুঝে থাকেন যে, টিপস টেকনোলজিটা, আপনি ইমাজিন করেন এটা যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজে। অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের হাসপাতালে ওদের কোনো রোগীর এরকম হয়। ওরাই তাকে হেলিকপ্টারে হাসপাতালে পাঠায়। হাইলি সিলেকটিভ। এভাবে একজন রোগীর জন্য একটা হাসপাতালকে ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়।'
গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাড়া বাসা 'ফিরোজায়' গত ১৩ নভেম্বর থেকে খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় এভারকেয়ার হাসপাতাল ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন। হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের তত্ত্বাবধায়ন একটি মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন। এই বোর্ডে এভারকেয়ার হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রয়েছেন।
৭৬ বছর বয়েসী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস ও চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক এ কিউ এম মহসিন, অধ্যাপক শামসুল আরেফিন, অধ্যাপক মো. নুরউদ্দিন, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ডা. মো. আল মামুন উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৩ নভেম্বর বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তির পর রাতে ব্যাপক রক্তক্ষরণের পর খালেদা জিয়া সংকটজনক অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে এফ এম সিদ্দিকী বলেন, 'আমরা প্রথমে ১৪ তারিখ ৬টা ব্যান্ড করে একটার পর একটা ব্যান্ডিং করে উনার ইমিডিয়েন্ট ব্লিডিংটা (রক্তক্ষরণ) বন্ধ করতে সমর্থ হই। পরে ১৭ তারিখ আবার তার ব্লিডিং শুরু হয়। আমরা লাইফ সেভিং মেডিসিন দিয়ে তাকে কিছুটা স্টেবল করতে সমর্থ হই। ২১ তারিখে মনে হলো যে, উনার ব্লিডিংটা বন্ধ হয়েছে। পরে ২৪ তারিখ তাকে জেনারেল ওটিতে নিয়ে অ্যান্ডোস্কোপি করা হয়। এবার দেখা গেল যে, ম্যাসিভ ব্লিডিংটা আরেকটু নিচের থেকে হচ্ছে বলে মনে হলো। এটার সোর্স পর্যন্ত আমরা যেতে পারিনি। আমরা আবার তাকে লাইভ সেভিং মেডিসিন দিয়েছি, আবার ব্লাড ট্রাসমিশন করেছি।'
'বর্তমানে ম্যাডাম এমন এক অবস্থায় আছেন যে অবস্থাটা বলা হয়, ইফ ইউ সেন্ড লাইভ অব দ্য পেসেন্ট টু নিড টু ডু টিপস ট্রান্সজুগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টুসিস্টেমিক শান্ট (টিপস) অর্থাৎ যে প্রেসারে ব্লাডটা ভ্যাসেলকে হাইপ্রেসারে ছিঁড়ে ফেলেছে সেটাকে একটা বাইপাস চ্যানেল করে দেওয়া এবং এটা লাইফ সেভিংস।'
বর্তমানে খালেদা জিয়ার শরীরে হিমোগ্লোবিন লেভেন কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখন উনার হিমোগ্লোভিন লেভেলটা প্রথমে ৫ দশমিক ৫ এ নেমে গিয়েছিল। সেটা আমরা সেটাকে ৪ ব্যাগ রক্ত দিয়ে ৯-১০-এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার সেটা কমে গিয়েছিল ৭ দশমিক ৮ এ। এটা মনে রাখতে হবে যে, উনার যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এই রক্তক্ষরণের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে অনেক রক্ত দিয়ে আপনি হিমোগ্লোবিন বাড়াতে পারবেন না।'
'তাহলে সেটা আবার রিবিল্ড করবে। সে জন্য আইডিয়ালি হিমোগ্লোভিনকে একটা লেভেলের মধ্যে ধরে রাখতে হয়।'
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন দুই বছর। পরিবারের আবেদনে গত বছরের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে তার সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেওয়া হয়।
কারাগার থেকে অসুস্থতা নিয়ে মুক্তির পর এই পর্যন্ত খালেদা জিয়া ৩ বার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন।
Comments