পুরুষের বেশে যুদ্ধ করা দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল

বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধ করেছেন নারী মুক্তিযোদ্ধারাও। নারী মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রসদ, গোলাবারুদ, অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। আবার অস্ত্র হাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছেন সম্মুখ সমরে। তেমনই এক দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল। যিনি একজন নারী হয়েও যুদ্ধ করেছিলেন পুরুষের বেশে।

শিরিন বানুর জন্ম ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাবনায়। তার মা সেলিনা বানু ছিলেন পাবনা জেলার ন্যাপের সভাপতি এবং পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ছিলেন পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। তার মামারা ছিলেন গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের কর্মী। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া শিরিন বানু মিতিলের রাজনীতিতে যোগদান ছোটবেলাতেই। তার মা তাঁকে নীহার কুমার সরকারের ‘ছোটদের রাজনীতি’ ও ‘ছোটদের অর্থনীতি’ পড়তে দিয়েছিলেন। যদিও তখন ওই বই পড়া নিষিদ্ধ ছিল।

১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন শিরিন বানু মিতিল। পাবনা এবং কুমিল্লা, দুই জায়গাতেই কাজ করতেন তিনি। পারিবারিক কারণেই তাকে এই দুই জায়গায় যাতায়াত করতে হতো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শিরিন বানু মিতিল ছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে ছিলেন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী।

২৫ মার্চ রাতে পাবনাতেও হামলা করেছিল পাকিস্তানী হানাদার। ২৭ মার্চ রাতে পাবনা পুলিশ লাইনের যুদ্ধ শুরু হয়৷ সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে৷ ঘরে ঘরে মেয়েরাও যুদ্ধে নামার কথা ভাবতে শুরু করে৷ তাদের অস্ত্র ছিল গরম পানি, অ্যাসিড বাল্ব, বটি আর দা৷ ২৮ মার্চ পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে হানাদারের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শিরিন বানু মিতিল। এই যুদ্ধে মিতিলই একমাত্র নারী ছিলেন। এই যুদ্ধে ৩৬ হানাদার সেনার সবাই নিহত হয়েছিল। শহীদ হয়েছিলেন দুই মুক্তিযোদ্ধা। শিরিন বানু মিতিলের মতো সংগ্রামী মেয়েদের মানসিকতা ছিল ‘মেরে মরবো’।

মিতিলের দুই চাচাতো ভাই জিন্দান ও জাহিদ হাসান জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয় তাদের মায়ের নির্দেশে৷ এই মা তার ছেলেদের বলতেন, ‘তোমাদের কী মানুষ করেছি ঘরে থেকে অসহায়ভাবে মরার জন্য? মরতে হলে যুদ্ধ করতে করতে মরো৷’

একদিন তার চাচাতো ভাই জিঞ্জির এসে বললেন, প্রীতিলতা তো প্যান্ট শার্ট পরতো তুই তো পরতে পারিস। তখন তিনি তার ভাইদের প্যান্ট, শার্ট ও জুতা নিলেন। তার চুল আগে থেকে ছাঁটা ছিল ছেলেদের মতো। সুতরাং তাকে দেখে অচেনা কেউ ছেলে হিসেবেই ভেবে নিত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শিরিন বানু মিতিল। ছবি: সংগৃহীত

চাচাতো ভাই জিঞ্জিরের কাছ থেকে মাত্র আধা ঘণ্টায় থ্রি নট থ্রি চালনা শিখে ফেললেন শিরিন বানু মিতিল। একজন নারী হয়ে সে সময়কার সমাজে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া ছিল ভীষণ দুঃসাহসিক কাজ। তাই শিরিন বানু মিতিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি পুরুষের পোশাক পরে পুরুষ বেশে যুদ্ধে যোগ দেবেন। যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে।

৩১ মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম বসানো হয়। ৯ এপ্রিল পাবনার নগরবাড়ি ঘাটের কাছে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয়   শিরিন বানু মিতিলকে। এছাড়া নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরের যুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে যুদ্ধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় আকাশপথে৷  পাবনার পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়া জেলায় তখন প্রতিরোধ প্রায় ভেঙে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন চুয়াডাঙ্গার দিকে চলে যাচ্ছেন।

পাবনার ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইকবালের দল একটি গাড়িতে করে কুষ্টিয়া হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হয়৷ গাড়িতে জায়গা না হওয়ায় মিতিল ও তার এক ভাই থেকে যান কুষ্টিয়ায়৷ পরে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার সময় ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাদের। কিছুদিন পর ভারতের দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ মিতিলের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছেপেছিলেন৷ ফলে পুরুষ সেজে আর যুদ্ধ করার আর সুযোগ পাননি মিতিল৷

একদিনের ঘটনা আজীবন নাড়া দিত মিতিলকে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যখন কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গার দিকে যাচ্ছিলাম৷ তখন একদিন গভীর রাতে আমাদের দলটিকে পথের মাঝে আটকানো হয়৷ মূলত ওই অঞ্চলে পাকস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতেই সতর্কতামূলক পাহারায় যারা ছিল তারা আমাদের পরিচয় জানতে চায়৷ আমরা পরিচয় দিলেও তারা প্রথমে সেটা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না৷ কারণ আমাদের সঙ্গে যিনি আরআই ছিলেন তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের৷ ফলে তার ভাষার টান ছিল বিহারিদের মতো৷ তাই আমরা যে সত্যি মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণ চাইল৷ তখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাদের একজন বলতে বাধ্য হলো যে, ‘আপনারা কি আকাশবাণীতে শিরিন বানুর কথা শুনেছেন?’ তারা বলল যে, ‘হ্যাঁ, আমরা তাঁর কথা শুনেছি৷’

‘তখন বলা হলো, আমাদের সঙ্গে সেই শিরিন বানু আছে৷ সেই সময় আমি খুব সন্দিহান ছিলাম যে, এতো বড় দলের ভেতরে ছদ্মবেশে একজন মেয়ে আছে, এটাকে তারা হয়তো অন্যভাবে দেখবে৷ কিন্তু, আমার পরিচয় জানার পরেই দেখা গেল, তারা সবাই আমাকে ঘিরে ধরল৷ তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধ পিতা আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা আমরা আর ভয় করি না৷ আমাদের মেয়েরা যখন আমাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে তখন বিজয় আমাদের হবেই৷’ তার কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম এবং তখন মনে হয়েছিল, সারাদেশের মানুষ কীভাবে স্বাধীনতার জন্য উদ্দীপনা ও উৎসাহ নিয়ে পরস্পরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে৷’

মানস ঘোষ এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘শিরিনকে আমার অসামান্য লেগেছিল। আমি যশোর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের খবর যোগাড় করতে গিয়ে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি। কিন্তু কোনো তরুণী আমার নজরে পড়েনি। আমি রোজ অফিসের গাড়ি করে দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা যেতাম। চুয়াডাঙ্গা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পশ্চিমাঞ্চলের সদর দপ্তর। কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী ছিলেন ওই অঞ্চলের প্রধান। একদিন সেখানে গিয়ে দেখা হলো পাবনার ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার নুরুল কাদের খানের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় তিনি অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ নিতে এসেছেন। কেন না পাকস্তানি বাহিনী পাল্টা আক্রমণের ছক কষে পাবনা পুনর্দখল করতে চাইছে।... অতঃপর একটা প্রায় অকেজো বাষ্পচালিত ইঞ্জিন যোগাড় করে তার সঙ্গে দুটি রেলের বগি জুড়ে স্তূপীকৃত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঈশ্বরদীর পথে পাড়ি জমালাম। সে ছিল রুদ্ধশ্বাস পরিক্রমা বা অভিজ্ঞতা। ভোর পাঁচটায় ঈশ্বরদী স্টেশনে পৌঁছে দেখি প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা। তখনই আমার চোখে পড়ে শিরিনের ওপর। শারীরিকভাবে রফিকুল ইসলাম বকুল বা ইকবালের মতো বলিষ্ঠ মুক্তি সে নয়। বরং সে খুব শীর্ণ ও লাজুক প্রকৃতির। আমার কাছে এসে বলল, ‘নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত।’ আমার হাত থেকে প্রায় জোর করে এয়ার ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘দামী কিছুই নেই তো?’ উত্তর দেয়ার আগেই সে বলে ওঠে, ‘যুদ্ধের খবর করতে এত ঝুঁকি নিয়ে আমাদের পাবনায় এসেছেন। আমাদের মেহমানদারি করতে দিন।’

এর কিছুদিনের মধ্যেই দীর্ঘ প্রশিক্ষণের জন্য ভারত চলে যান শিরিন বানু মিতিল। এসময়ে শিরিন বানু মিতিল নাচোল বিদ্রোহের জননী ইলা মিত্রের বাসায় ছিলেন কিছুদিন৷ প্রথমে কয়েকজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করেন৷ পরবর্তীতে  তাদের সঙ্গে যোগ দিলে মোট ৩৬ জন নারী নিয়ে ভারতের গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়৷ আস্তে আস্তে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়৷ এক পর্যায়ে সদস্য ছিল ২৪০ জনের বেশি।

অস্ত্রের অভাব থাকায় নারীদের গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না৷ তাই প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিকেল কোরের সদস্য হিসেবে৷ বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন৷ পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য, কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল।

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো- দেশ স্বাধীনের পর আমরা এই অসামান্য মুক্তিযোদ্ধাকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অজুহাতে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা হয়েছিল তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। জীবিত থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থগিত করে রাখা হয়েছিল তার নাম। যদিও তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কিংবা সম্মানের আশা কখনোই করেননি।

২০১৬ সালের ২১ জুলাই আজকের দিনে চলে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল। প্রয়াণ দিবসে নত চিত্তে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে।

আহমাদ ইশতিয়াক, [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

BTRC directs telcos to provide 1GB free internet on July 18

Mobile phone operators have been instructed to notify users in advance via SMS

1h ago