কেন ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকি?

এখানে আসার পর জানতে পারি, বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক। সবাইকে নিয়ে একটা স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনও আছে।
কেন ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকি?
ছবি: নাদিয়া রহমানের ফেসবুক থেকে

উচ্চশিক্ষার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে প্রাথমিকভাবে যে কাজগুলো করতে হয়—তার মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করা। এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই আছে কয়েক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ফলাফল, পেশাগত অভিজ্ঞতা কিংবা গবেষণা সব মিলিয়ে ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফান্ড পাওয়াটা অনেকগুলো হিসাবের ব্যাপার। 

নিজে যখন আবেদন করেছি, হিসাব রাখতে হয়েছে দেশের বেতনের কতখানি খরচা করা হলো, কেন না আমেরিকার প্রায় বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই আবেদনের সময় একটি ভালো পরিমাণের ফি জমা দিতে হয়। তাই চাইলেও এই আবেদনের তালিকাটা রাখতে হয়েছিল সীমিত। 

বহু হিসাব-নিকাশ করে আবেদন করেছিলাম লেক্সিংটন শহরের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকিতে। হিসাব-নিকাশের খাতায় কী ছিল? কেনই বা আগামীতে কোনো একজন শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসবেন? 

পছন্দের বিভাগ, সহপাঠী ও অধ্যাপক

ফান্ড, অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা পছন্দের কোর্স; এসবের হিসাব অনেক আগেই হয়ে যায়। এরপরও কিছু বিষয় থাকে, যার ওপর একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর মানসিক সুস্থতা নির্ভর করে।

ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির যোগাযোগ বিভাগে আমিই প্রথম বাংলাদেশ থেকে আসা কোনো গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। ভিন দেশে পড়তে আসবার পর দেখেছি, বেশিরভাগ বিভাগেই পরিচিত কেউ একজন আছেন। সেই হিসেবে আমিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বিভাগে বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম নাম লেখালাম।

শুরুর দিকে সারাদিন ক্লাস এবং আমেরিকান রুমমেটদের (আমেরিকায় অ্যাপার্টমেন্ট মেটকেই রুমমেট বলা হয়) সঙ্গে যোগাযোগের পর মনে হতো, নিজ ভাষায় দুটো কথা বলবার কেউ নেই! এমন পরিস্থিতিতে একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর কিছুটা খারাপ লাগা খুব স্বাভাবিক। আর যে কি না কোনো দিন নিজ পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে থাকেনি, তার জন্য একটু বেশিই হয়তো। 

তবে দুএক মাস পর খারাপ লাগাটা আর কাজ করেনি। এর অন্যতম কারণ এই বিভাগ। সহপাঠীরা সবাই অন্যান্য মহাদেশের হলেও (এশিয়া বাদ দিয়ে) প্রত্যেকেই বেশ সুহৃদ। শ্রেণিকক্ষে প্রচুর কাজ এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এখানে। শিক্ষক শুধু পড়িয়ে যাচ্ছেন আর আমি শুধু শুনে যাব এমনটি যুক্তরাষ্ট্রে হয় না। সব কিছু মিলিয়ে সহপাঠীরা যদি সমানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা না করতো, তাহলে এই বিভাগকে এতটা পছন্দ হয়তো করা হতো না। 

এরপরই বলতে হয়, এখানকার অধ্যাপকদের সম্পর্কে। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকদের 'প্রফেসর' বা অধ্যাপক হিসেবেই সম্বোধন করা হয়। তা প্রভাষকই হোক বা সহকারী অধ্যাপক। প্রথম যেদিন বিভাগে গিয়েছিলাম, অধ্যাপকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময়; সেদিন থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি অনেক। এই আচরণ আমাকে একজন শিক্ষক হিসেবে শিখিয়েছে—শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানই শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করতে পারে না। আমি ডরমিটরিতে থাকতে পারছি কি না, আমার ঘরে বাজার আছে কি না, এই প্রতিটি বিষয়ের খোঁজ নিয়েছেন আমার অধ্যাপক। সত্যি বলতে, এত হাজার মাইল দূরে যখন নিজের পরিচিত শহর, পরিবার ছেড়ে আসা হয় তখন এই বিষয়গুলো অনেক বড় হয়ে ওঠে। ভিন দেশেও মনে হয়, কেউ তো আছে আমার খোঁজ নেবার! 

আর 'কলেজ অব কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন'-এর অধীনে বিভিন্ন 'স্কুল' এবং বিভাগ রয়েছে যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে। এখানে মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম, কমিউনিকেশন, কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন কিংবা ইনফরমেশন অ্যান্ড লাইব্রেরি স্টাডিজসহ প্রতিটি 'স্কুল' বা বিভাগ ভিন্ন। যার জন্য অনেক শিক্ষক এবং অধ্যাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ, তাদের গবেষণা বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা যায় সহজেই। 

বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন
 
সত্যি বলতে প্রবাস নিয়ে অনেকের বেশ কিছু ভিন্ন ধারণা থাকে। অন্যতম একটি হলো, নতুন দেশ-মহাদেশের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। ছোটবেলায় যখন যুগ আজকের মতো এতটা আধুনিক হয়ে ওঠেনি, মুহূর্তের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ এতটা সহজতর ছিল না, তখন এই 'কলম-বন্ধু' বা 'পেন-ফ্রেন্ড' বিষয়টা খুব আগ্রহ যোগাত।
 
আর নিজের চেনা সংস্কৃতি বা জগতের বাইরেও যে আরেকটি বৈচিত্র্যময় জগত আছে, সেই সম্পর্কে জানতে চাওয়াই মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। অজানাকে জানবার, চেনার ইচ্ছার বাইরে যে বিষয়টি কেন্টাকির লেক্সিংটন শহরে এসে চোখে পড়েছে তা হলো, প্রত্যেক দেশের মানুষই দিন শেষে নিজ দেশের মানুষের সঙ্গে একটা বলয় তৈরি করে নেয়। কিছু বিষয় হিসাব করলে, স্বাভাবিকও বটে। নিজ সংস্কৃতি, রীতিনীতি; যা এত বছর ধরে আমার নিত্যদিনের অভ্যাস, আবহাওয়া বা জিনে চলে আসছে— তার বলয় থেকে হুট করেই কয়েক মাসে বেরিয়ে আসা নিজের জন্যই অস্বস্তিকর। এ জন্যই হয়তো ধর্ম এক হলেও দুদেশের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনটা ঠিক হয়ে ওঠে না। প্রমাণ তো অনেক আছেই ইতিহাসে।
 
তাই নিজে যখন এখানে এসেছি, কয়েক মাস পর জানতে পেরেছি এখানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক। প্রত্যেককে নিয়ে একটি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন আছে। যেখানে বিভিন্ন দেশীয় উৎসব ও খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। অনেক বয়স, মতের মানুষ থাকবার কারণে এত জনের মধ্য থেকে দুতিন জন সমমনা বন্ধু পেয়েছি। যাদের সঙ্গে আবার সেই আগেকার শিক্ষাজীবনের কিছু নির্ভার সময় উপভোগ করতে পেরেছি।

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

59m ago