এরপর দেখা হবে নতুন কোনো শহরে, অন্য কোনো রেস্তোরাঁয়

শেষ বেলায় মন খারাপ হলেও প্রত্যেককেই হাসিমুখেই বিদায় দিয়ে বলা হলো, এরপর নিশ্চয়ই দেখা হবে নতুন আরেক শহরে, অন্য কোনো রেস্তোরাঁয়!
উড়িষ্যা কনফারেন্সে নাদিয়া রহমান।

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম 'বিদেশে' পড়তে যাব। সুন্দর গোছানো প্রকৃতির মাঝে ক্লাস শেষে হেঁটে ডর্মে ফিরব। দেশ-বিদেশের কনফারেন্স-সিম্পোজিয়ামে বসে বিভিন্ন অধ্যাপকদের আলোচনা শুনব! 

সময়টা তখন ২০০০ সালের দিকের। এখনকার আধুনিক যুগ তখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। তাই এসব পরিকল্পনা একটু বেশিই কাল্পনিক মনে হতো। পরিবার থেকেও বিধিনিষেধ কম ছিল না! যাক, সময়ের ফেরে আমার শিক্ষকতা পেশায় আসা (যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনাই ছিল না) এবং এই পেশার সুবাদেই খুব বেশি না হলেও কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে নিজের গবেষণা, কাজ উপস্থাপনের সুযোগ হয়েছে।  

ব্যাংককের সি'লম রাজপথে

আন্তর্জাতিক কোনো কনফারেন্সে এটাই আমার প্রথম গবেষণা উপস্থাপন। এর আগে দেশে কয়েকবার গবেষণাকাজ উপস্থাপন করলেও দেশের বাইরে এই ছিল প্রথম। একইসঙ্গে আমার প্রথম দেশের বাইরে একাকী ভ্রমণও। ভ্রমণ বা যাত্রাপথে সঙ্গী অনেক বড় বিষয়। প্রায় সব কটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে একা যাত্রা শুরু করলেও কোনো না কোনো ভ্রমণসঙ্গী পেয়েই গেছি যাদের সঙ্গে কর্মজীবনের ভারিক্কি ভাবটা দূরে রেখে, হিসেব-নিকেশ ছাড়াই আমুদে গল্প করা যায়। 

ব্যাংককের কোলাহলপূর্ণ সি'লমে শ্রীলঙ্কার এমন দু'জন সঙ্গী পেয়েছিলাম। দু'জনই ছিলেন শিক্ষক। আমরা প্রত্যেকেই একই কনফারেন্সে নিজেদের কাজ উপস্থাপন করেছিলাম। সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম কনফারন্সের একেক সেশনের উদ্দেশে। বিকেল নাগাদ ম্যাকডোনাল্ডসে লাঞ্চ সেরে গুগল ম্যাপ দেখে পরিকল্পনা করে নিতাম, কোথায় যাওয়া হবে। ব্যাংককে যে কদিনই ছিলাম, এই দুজনকে নিয়েই পুরোটা সময় ঘুরে বেড়িয়েছি। সি'লম বেশ বাণিজ্যিক একটা লোকালয় এবং ব্যাংককের একদম কেন্দ্রে। সকাল থেকেই সেখানে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় যা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। দুপুর থেকে বিকেল নাগাদ একই লোকালয়টি কেমন ঝিমিয়ে নেয়। এখনো মনে আছে, সেই শান্ত বিকেলগুলো। আমার সুবিশাল অট্টালিকার হোটেলে রোদ এসে পড়ত। সব থেকে মনে রাখার মতো হলো, সেখানকার নাইট লাইফ। প্রতিটি গলিতেই বিভিন্ন জ্যাজ মিউজিক, নানান রঙের মৃদু আলো, আর স্ট্রিট ফুড-পাব থেকে ভেসে আসা বন্ধুমহলের আনন্দ-উচ্ছ্বাস। বিভিন্ন গলির মোড়েই স্যুভেনিরের ছোট দোকান। আর বিভিন্ন সুগন্ধির সুবাস। আমরা দুএকটা দোকানও খুঁজে পেয়েছিলাম যেখানে অল্প দামে উপহার দেওয়ার বেশ ভালো জিনিস পাওয়া যাচ্ছিল। 

যে জিনিসটা সব থেকে ভালো লেগেছিল, সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। চলে আসবার আগের দিন এক পশলা বৃষ্টির পর প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন অলিতে-গলিতে ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়নি। আসবার দিন যারপরনাই মন খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এই কটা দিন ছিল 'এসক্যাপ' করবার উপায়। এরপর সামাজিকমাধ্যমে শ্রীলঙ্কার সেই বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। একজনের সঙ্গে যোগাযোগ এখনো আছে, কিন্তু গেল চার বছরে আমাদের কোথাও দেখা হয়নি। বিভিন্ন পরিকল্পনা করলেও কোভিডের সময়ই অনেক কিছু ভেস্তে গেছে যা আর বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এখনো এই মার্কিন মুল্লুকে দুপুরবেলা বসে সি'লমের সেই দিনগুলোর কথা মনে হয়। 

উড়িষ্যা এবং কলকাতার পথে 

একই বছরে আরেকটি কনফারেন্সে নিজের আর এক অধ্যাপকের গবেষণা উপস্থাপনের জন্য গিয়েছিলাম উড়িষ্যার কলিঙ্গ ইনস্টিটিউটে। বিশাল ক্যাম্পাস পুরোটাই নিজেদের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতরেই বিভিন্ন ডর্ম, কনফারেন্স, অডিটোরিয়ামের ব্যবস্থা। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের কনকনে শীত। মনে আছে, কলকাতায় তখন তাপমাত্রা ছিল তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এখানেও তাই। সারাদিন নাগাদ কনফারেন্স, আলোচনা আর বিকেল হলেই ঘুরে দেখা। মানুষ হিসেবে আমার মনে আসলে দাগ কাটে একেকটি জায়গার জীবন ব্যবস্থা, সেখানকার অলিগলি এবং মুহূর্তগুলো। শীতের কুয়াশাঘেরা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের গিটার, আড্ডা, স্ট্রিট ফুড ছিল বেশ আমুদে। 

তখন সবেমাত্র প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছি। তাই শিক্ষার্থীদের এমন আড্ডা-গল্প বারবার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। 

আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল কাঠের তৈরি গেস্ট হাউজে। সন্ধ্যা না হতেই কুয়াশায় হলদে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। বাইরে ঠান্ডা আর ভেতরে আগুণের তাপে আমরা কয়েকজন একসঙ্গে ডিনার সেরে মধ্যরাত নাগাদ গল্প করতাম। আমরা কয়েকজন মাত্র শিক্ষক আর বাদবাকি সবাই অধ্যাপক। এই আড্ডায় বসলে বোঝা যায়, বয়সে একেকজন একেক সময়ের হলেও সবার জীবনেই বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধুমহলের স্মৃতি থাকেই। ১২টার পর যখন গেস্ট হাউজের কফি হাউজ বন্ধ করে দেবে তখনো আমাদের পেয়ালার কফি, চা কিন্তু শেষ হয়নি। এভাবেই পরদিন সকালে ঘুমকাতুর হয়ে ফর্মাল পোশাকে কনফারেন্সে ভারিক্কি ভাব নিয়ে মনোযোগ দিতাম! 

ফেরার পথে একদিন মাত্র সময় পেয়েছিলাম কলকাতায় থাকার। হিসেব করে বললে কেবল এক বিকেল। নিজের শিক্ষকের সঙ্গে কলকাতার কফিহাউজ আর বইয়ের দোকান ঘুরে দেখবার যে আনন্দ, তা হয়তো আমার মতো 'পড়ুয়া' মানুষের সঙ্গেই শুধু যায়! সেই কুয়াশার আধো অন্ধকার, ট্রামের শহরে রবীন্দ্র সঙ্গীত আর অধ্যাপকের বিভিন্ন ইতিহাস বর্ণনার ভিন্ন এক মোহ ছিল। তাই এবারে ফেরার দিনও মন খারাপ হয়েছিল এবং কোভিডের দরুন সেই অধ্যাপকের সঙ্গে আর কোনো আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যাওয়া হয়নি। এরপর তো আমি নিজেই চলে আসলাম সমুদ্রের এপারে। কিন্তু ক্ষণিকের বিকেল আর ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে মুহূর্তগুলো রেখে দিলাম দীর্ঘ সময়ের জন্য। 

অতঃপর ওয়াশিংটন ডিসিতে 

এ বছর, যোগাযোগ এবং সাংবাদিকতার অন্যতম কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলাম গত অগাস্ট মাসে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসবার পর এই প্রথম ভিন দেশে নিজ বিভাগের পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হয়েছে এই কনফারেন্সে। পুরোটা সময়ই ছিল কেন্টাকির নিত্যদিনের জীবন থেকে একেবারে ভিন্ন। দেশি খাবার, একসঙ্গে বাজার করা, অফিসের বাইরে ভিন্ন পরিবেশে সবার সঙ্গে আলোচনা আর সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কত অধ্যাপক। শেষদিন ডিনারে বিশাল অট্টালিকার, এত রঙ্গিন আলোয় আমরা বলছিলাম, আমরা কেউ ভাবিনি নিজ দেশ ছেড়ে এভাবে আমাদের দেখা হবে। সবাই উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা করলেও একই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পড়তে আসা হবে, এটা নিশ্চয়ই আমরা কেউ ভাবিনি। 

শেষ বেলায় মন খারাপ হলেও প্রত্যেককেই হাসিমুখেই বিদায় দিয়ে বলা হলো, এরপর নিশ্চয়ই দেখা হবে নতুন আরেক শহরে, অন্য কোনো রেস্তোরাঁয়!

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

   

Comments