যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা

প্রবাসের হল জীবন

প্রবাসের হল জীবন
ছবি: নাদিয়া রহমান

ঘর ছাড়ার সময় যারপরনাই মন খারাপ ছিল। এতদিনের সুন্দর গোছানো ঘর, পড়ার টেবিল, বুকশেলফ আর সেখানে রাখা বহুদিনের জমানো শত বই।

ভাবছিলাম ঘর ছেড়ে ভিনদেশে যেখানে এই কয়েক বছরের ঠিকানা হবে, সেই ঘর অনেক উন্নত হলেও অন্তত এমনটা হবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু মানুষ তো আসলে বীজের মতই, যেখানে তার জীবনধারণ সেখানেই তার শেকড় বিস্তৃত হয়। 

তবে এ ক্ষেত্রে অন্যতম যে বিষয়টি অল্প সময়ে একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করতে পারে তা হলো, এখানকার ডর্ম এবং গ্র্যাডহাউজিংয়ের পরিবেশ। বেশ নিরিবিলি এবং শান্ত তাই একাকীত্ব লাগলেও দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের দেখা মিলবে এই 'কলোনিতে'। তাই এই ডর্মকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আপন মনে হবে। মনে হবে নতুন এই পরিবেশে আমিই একা নই, আমার মতোই বহু শিক্ষার্থী আছে। নিজের অতিমাত্রায় এই 'হোমসিক' প্রবণতার অভিজ্ঞতা থেকেই বলা! 

প্রায়শই চিন্তা করি, দেশে আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে হল, খাবার ব্যবস্থা কিংবা লাইব্রেরি— সেসব থেকে কতটা ভিন্ন এবং পড়াশোনার উপযোগী এই ডর্ম আর এখানকার পরিবেশ। আসলে দুটোর মধ্যে তুলনাটা কোনভাবেই হয় না! এখানে সবকিছু তৈরি করা হয়েছে শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের অনুকূলে।

আমার বর্তমানের যে দ্বিতীয় ঠিকানা বা ডর্ম, সেখানকার প্রতিটি গ্র্যাডহাউজিংই দোতলা। তাই নির্বিঘ্নে এখানকার পরিষ্কার আকাশের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। শিক্ষার্থী ছাড়াও তাদের পরিবারের কথা ভেবে হাউজিংগুলো তৈরি করা হয়েছে। কেন না এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয় একজন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। কোনো শিক্ষার্থী যদি মনে করেন তার পরিবার তার সঙ্গেই থাকবে, সে ব্যবস্থাও রয়েছে এই হাউজিং গুলোয়। আর যেহেতু সময়টাও দীর্ঘ, তাই অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীই পরিবার নিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমান। 

ডর্মের প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই পাওয়া যাবে বিভিন্ন গাছ। গাছগুলোর নিচে বেঞ্চ দেওয়া থাকে। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি গাছের ছায়ায় এই বেঞ্চে বসে কিংবা শুয়ে বই পরছে। গ্রীষ্মের বিকেলে অনেকে আবার এই বৃক্ষের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে বা হ্যামকে শুয়েও বই পড়েন। কখনই দেখিনি কাউকে এই নীরবতার বা বই পড়বার বিঘ্ন ঘটাতে। 

যুক্তরাষ্ট্রে স্পোর্টসসহ বিভিন্ন আউটডোর অ্যাক্টিভিটিসকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেটা না বললেই নয়। এমনকি এসবের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্কলারশিপ বা বৃত্তিও দেওয়া হয়। বাস্কেটবল কোর্ট, ফুটবল ফিল্ড, টেনিস, টেবিল টেনিস, হকিসহ কত রকমের স্পোর্টসের যে ব্যবস্থা রয়েছে এখানে! শিক্ষার্থী ছাড়াও তাদের পরিবারের শিশুরা যাতে এসব অ্যাক্টিভিটিস এ বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্যও ডর্মের সামনে বিভিন্ন প্লেগ্রাউন্ড থাকে। এখানে আসার পর দেখেছি, বিকেলে সাইক্লিং, বাগানে হাঁটতে যাবার জন্য কতটা উৎসাহ দেওয়া হয়। আমরা যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় পার করে দেই, সেখানে এখানকার মানুষ দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করে বিভিন্ন স্পোর্টসে।

তা ছাড়া এখানকার অন্যতম একটি ভালো দিক হলো, শব্দদূষণবিহীন পরিবেশ। ডর্মের সামনে শিক্ষার্থীদের জন্য তুলনামূলক কম খরচে পার্কিং সুবিধা দেওয়া হয়। এবং হিসাব করে দেখলাম এই এক বছরের বেশি সময়ে আমেরিকার রাস্তায় বা পথে কখনো কোনো হর্ন শুনিনি। প্রতিটি হাউজিংয়ের সামনে এত গাড়ি পার্ক করা হচ্ছে, কিন্তু কখনো কোনো হর্ন বা হইচই কানে আসেনি! শুনেছি এখানে গাড়িচালকেরা হর্ন দেওয়াকে খারাপ অর্থেই দেখেন। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে হর্ন দেওয়ার প্রয়োজন নেই এখানে। 

গাড়ি ছাড়াও সাইকেল পার্কিংয়ের জন্যও প্রতিটি হাউজিংয়ের নিচে ব্যবস্থা রয়েছে। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী গ্রীষ্ম কিংবা শরতের সময়টাতে সাইকেল নিয়েই ক্লাসে যাতায়াত করে। গাছের ছায়া বিছানো আলাদা লন থাকে এই সাইক্লিং এর জন্য। এবং এই সাইকেলও দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যাদের নিজেদের সাইকেল নেই, তারা আবেদন করলে প্রতি সিমেস্টারে এই ব্যবস্থা করা হয়। যাতে পড়াশোনা ছাড়াও একজন শিক্ষার্থী মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার মধ্য দিয়ে যেতে পারে, তার প্রতিটি সুযোগ এই ডর্ম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে।   

আরেকটি বিষয় যেটা একজন শিক্ষার্থী বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থী সহজেই তুলনা করতে পারবেন, তা হলো এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কখনো সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর একঘেয়ে বোধ হলে, রাতে চাইলে ডর্মের রাস্তাটুকু, বাগানে অনায়াসে কিছুটা সময় ব্যয় করা যায়। এমনকি মাঝ রাতে যখন আমরা কজন নারী শিক্ষার্থী হাঁটতে বেরিয়েছি, তখনো এই পরিবেশ ছিল বেশ নিরাপদ। অনেক নারী শিক্ষার্থীই এই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেন। কিন্তু আসলে এই ভিনদেশের পরিবেশ অনেক নিরাপদ।  

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh, Japan for concluding EPA soon to boost economic, trade ties

Japanese PM Ishiba described Bangladesh as a long-standing friend and said that Japan would stand by Bangladesh in its endeavour for a democratic transition

1h ago