ভিনদেশে শীতকালীন ছুটি

যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিনের আয়োজন। ছবি: নাদিয়া রহমান

পুরো ক্যাম্পাসে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী ছাড়া এখন কারও দেখা মেলা ভার। ক্যাম্পাসের পরিচিত পথ এবং ডর্মগুলোয় যেখানে সবসময় শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা, কোলাহল চোখে পড়তো, এখন সে সবের কিছুই নেই। এমনটা হওয়া মানেই ছুটি। 

গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর বছরের শেষে এমন নীরবতা। শুধু চোখে পরবে শুনশান ক্যাম্পাসের দুই পাশে সারি সারি পাতাবিহীন গাছ আর বৃষ্টি, না-হয় শুভ্র তুষার। ক্যাম্পাস হাউজিংগুলোতে শুধু রয়ে গেছি আমরা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা। আমাদের ডর্মগুলোয় সন্ধ্যা না হতেই হলদে ল্যাম্পের আলোগুলো জ্বলে উঠে। এসময় সন্ধ্যাও হয় বেশ দ্রুত, ঠিক ৫টার দিকে। বিকেল নেই বললেই চলে। অথচ গ্রীষ্মের সময় রাত ৯টার দিকেও সহপাঠীরা মিলে হইচই করে একইপথে হেঁটে 'বাড়ি' ফিরেছি, সূর্য তখনো ডুবেনি। সেই পথই এখন একাকী, নিশ্চুপ। 

এই সময়গুলোতে বাড়ির কথা বেশ মনে পড়ে। বিশেষ করে আমরা যারা এখানে পরিবার-পরিজন ছাড়া থাকি। তা-ও ভালো, কয়েকজন বন্ধু পাওয়া গেছে এই ভিন দেশে। যাদের প্রত্যেকেরই মনের ভাষা এক, ভিন্ন মহাদেশ আর ভিন্ন সংস্কৃতি হলেও। আর দেশের যে কয়জন বন্ধু আছে, হাঁটতে বের হলেই আমাদের কথায় কথায় চলে আসে- দেশে এখন কোন পিঠা খাওয়া যেত, ঘরে মা কী বানিয়ে দিতেন, নয়তো ক্যাম্পাসে গিয়ে হিসেব ছাড়া আড্ডা দেওয়ার সন্ধ্যাগুলোর স্মৃতি।

এখন যেহেতু পরীক্ষা নেই, ব্যস্ততা সবারই অনেকখানি কম, তাই নিজেরাই উদ্যোগ নেই মিলেমিশে কিছু একটা রান্না করে ফেলার। যতই হোক বাঙালি কি না! রসনা-বিলাস সহজে বাদ দেওয়া যায় না। দেশে চড়ুইভাতি আর এখানে না হয় ওয়ান ডিশ। যে দেশের শব্দচয়নই হোক, কয়েকজন মিলে জোগাড়যন্ত্র করে মাঝরাত পর্যন্ত চলে আমাদের পিকনিক আর আড্ডা, যেখানে আসলে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ই থাকে না। তবে অন্যতম একটি আলোচনার বিষয় হলো, দেশে ফেলে আসা পরিবার। প্রত্যেকেরই মা-বাবা বা প্রিয়জন, বন্ধুর কথা আসবেই। একেক জনের গল্প একেক রকম, বাড়ি ছেড়ে থাকার নানা আক্ষেপ, খারাপ লাগার কথা আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে আসবেই। 

ওয়ান ডিশ ছাড়াও আমাদের ছুটি উপভোগ করার তালিকায় আছে রাজ্যের বই পড়া। অন্তত আমার। লাইব্রেরি এসময় বন্ধ হয়ে যায়, ক্যাম্পাসের বাসও চলে না। অনেকেই আবার দল বেঁধে ঘুরতে বের হয়। আমাদের যাদের এই সময়টায়ও গবেষণা বা শিক্ষকতার কিছু কাজ করতে হয়, তাদের জন্য অবসরে বই-ই আরামদায়ক। জানলার পর্দা তুলে দিয়ে একটানা বৃষ্টি বা তুষারপাত দেখতে দেখতে টেবিলে বসে বই পড়া। সঙ্গে হট চকোলেট বা চা। আমার বন্ধুরা অবশ্য প্রায়ই বলে, কীভাবে এত বই পড়ি। তাই তাদেরও মন রাখা চাই। এখানকার এই চেনা মানুষদের সঙ্গেই বেড়িয়ে আসা হয় ডাউন-টাউন বা শহরতলীর শোরগোলে। কখনো জাপানিজ সুশি, থাই বা চায়নিজ ডিশ, আবার কখনো কোরিয়ান তরকারির সঙে কিমচি। সঙে মেক্সিকান, মেডিটেরানিয়ান বিরিয়ানি, সালাদ ঘুরে নেপালি খাবারও বাদ যায় না। 

যেহেতু বড়দিন আর সামনেই নতুন বছর, তাই ছবির মত ছিমছাম সাজানো থাকে এই শহরতলী, আর দোকানপাটগুলো। বড়দিন উপলক্ষে ক্রিসমাস ট্রি, বিভিন্ন পুতুল, চকোলেট এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়, যে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। যখন জগতটা শুধুই গল্পের বইয়ের পাতায় অসীম ছিল। পূর্ব আর পশ্চিমের যাতায়াত এতটা সহজ ছিল না।

এখানকার শহরতলীতে যেনতেন-ভাবে বড় শপিংমল গড়ে উঠে না। সেগুলো আরেক প্রান্তে, যে জায়গা শুধুই বাণিজ্য আর পুঁজিবাদের এই দেশে শত-সহস্র পণ্যের। শহরতলী কিছুটা শান্তিপ্রিয়। সঙে থাকে পার্ক, যেগুলো এই সময়টায় বেশ চমৎকারভাবে আলোকসজ্জায় রঙ্গিন করে রাখা হয়। এই শহরতলীর রাস্তা-জুড়েই বড়দিনের প্যারেড হয়। বহু মানুষ এই প্যারেডে গান এবং সুরের তালে হেঁটে চলেন। আর বছরের শেষ দিনে হয় আতশবাজি, যা সবখানেই হয় আসলে। তবে মাঝরাতে এই জনসমাগমের উৎসব-মুখরতা দেশে চোখে পড়েনি। এখানে এই উৎসব-মুখরতা এই সময়ের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এখানে কেউ কারও শান্তি, নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে না। চারদিকেই যে একটা মুক্ত পরিবেশ, তা টের পাওয়া যায়। এ কারণেই অত চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই মাঝরাতে আমরা আনন্দ কোলাহল করে যে যার ডর্মে ফিরে যাই। 

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো চেষ্টা করি এই সময়টা উপভোগ করে নিতে। যখন অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন বছরের শুরুতে নানা আশা ও উৎসাহ নিয়ে হরেকরকম আয়োজন করেন, আমরাও তখন একই সুরে প্রার্থনা করি, দেশে থাকা আমাদের প্রিয়-মুখগুলো ভালো থাকুক। দ্রুতই সেমিস্টারের পাতা কেটে যাক, আর আমাদের আগামী ছুটির দিনগুলো কাটুক পরিচিত ঘরের কোণে। 

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

Comments

The Daily Star  | English
Prof Yunus in Time magazine's 100 list 2025

Time’s List: Yunus among 100 most influential people

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has been named among TIME magazine’s 100 Most Influential People of 2025.

5h ago