অভিবাসী জীবনে বাংলাদেশকে তুলে ধরার গল্প

একটি দেশ বা সংস্কৃতির মানুষ যখন ভিন্ন আরেকটি দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানে, স্বভাবতই তারা উপভোগ করেন, উচ্ছ্বাসিত হন। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশের গৌরবগাথা ইতিহাসের গল্প শুনে ইউরোপের শিক্ষার্থী ও নানা পেশার মানুষেরা উচ্ছ্বাসের চেয়ে অবাক হয়েছেন বেশি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে হয়েছেন আবেগ আপ্লুত।
পর্তুগালের লিসবনের প্রাচীন মুরারিয়া এলাকায় ইউরোপীয় শিক্ষার্থীদের কাছে পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের গল্প তুলে ধরছেন গাইড-লেখক। ছবি: রাসেল আহম্মেদ

একটি দেশ বা সংস্কৃতির মানুষ যখন ভিন্ন আরেকটি দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানে, স্বভাবতই তারা উপভোগ করেন, উচ্ছ্বাসিত হন। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশের গৌরবগাথা ইতিহাসের গল্প শুনে ইউরোপের শিক্ষার্থী ও নানা পেশার মানুষেরা উচ্ছ্বাসের চেয়ে অবাক হয়েছেন বেশি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে হয়েছেন আবেগ আপ্লুত।

অনেকে আরও বেশি জানতে চেয়েছেন। কেউ কেউ শহীদ মিনারের খোঁজ চেয়েছেন, আবার অনেকে বাংলাদেশ দেখার আগ্রহ দেখিয়েছেন।

লিসবনের প্রাচীন মুরারিয়া এলাকায় সুইজারল্যান্ডভিত্তিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গাইড-লেখক। ছবি: রাসেল আহম্মেদ

নিজের মাতৃভূমিকে তুলে ধরার এমন সুযোগটা আমার হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের 'মাইগ্রেন্ট ট্যুর'-এর কল্যাণে। একজন নির্বাচিত অভিবাসী গাইড হিসেবে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে এই বিশেষ ভ্রমণে আসা ইউরোপীয় প্রজন্ম ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক দেশের নাগরিকদের কাছে তুলে ধরতে পারছি বাংলাদেশকে।

আমার অভিবাসী জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া এই বিশেষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আদ্যপ্রান্ত তুলে ধরার ইচ্ছাটা চেপে রাখতে পারলাম না। তার আগে 'মাইগ্রেন্ট ট্যুর'-এর পেছনের গল্পটা বলাটা জরুরি।

মাল্টিকালচারাল একাডেমিতে পর্তুগিজের ভাষা-সংষ্কৃতি নিয়ে ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীদের কর্মশালা। ছবি: রাসেল আহম্মেদ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি উদ্যোগ 'মাইগ্রেন্ট ট্যুর', ২০১০ সালে শুরু হয়েছিল ইতালির তুরিন শহরে। এখন লিসবনসহ ইউরোপের ২৫টি শহরে এই উদ্যোগের মাধ্যমে নিয়মিত শিক্ষামূলক ভ্রমণ আয়োজন করা হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্দেশনায় শুধুমাত্র অভিবাসীদের দিয়ে পরিচালিত এই বিশেষ ভ্রমণে আঞ্চলিক বাস্তবতা বিশেষ করে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং অভিবাসন, ইনক্লুশন ও ইন্টেগ্রেশন সংক্রান্ত বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়।

ভ্রমণে অংশ নিয়ে থাকে মূলত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী এবং নানা সংগঠন, সংস্থা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী। শিক্ষা অথবা প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবেই তারা এই উদ্যোগে যুক্ত হন। এখান থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা কর্ম জীবন, গবেষণা, অভিবাসন সংক্রান্তসহ নানা পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে লাগাতে পারেন।

মাল্টিকালচারাল একাডেমিতে পর্তুগিজের ভাষা-সংষ্কৃতি নিয়ে ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীদের কর্মশালা। ছবি: রাসেল আহম্মেদ

একজন অভিবাসী থাকেন ভ্রমণের গাইড। যিনি তার বসতি এলাকায় পরিচালনা করেন পুরো ভ্রমণ। অংশ নেওয়া দলকে নিয়ে বিশেষ একটি রুটসহ ১০ থেকে ১২টি স্টেশন বা স্থান ভ্রমণ করেন। তুলে ধরেন ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা না জানা গল্প।

গাইড হিসেবে বাছাই করা হয় এমন কিছু অভিবাসীদের, যারা সেই নিদিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলে কমপক্ষে ৩ বছর ধরে থাকছেন। নিদিষ্ট প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে তৈরি করা হয়।

২০১৫ সালে ১৫ তম শহর হিসেবে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে এই উদ্যোগের ভ্রমণ আয়োজন শুরু হয়। শুরু থেকে যুক্ত আছে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা লিসবনের স্থানীয় সংগঠন রিনোভার মুরারিয়া।

লিসবনের অন্যতম প্রাচীন এলাকা হল মুরারিয়া অঞ্চল যার রয়েছে প্রায় ৯০০ বছরের ইতিহাস। লিসবনের ডাউনটাউনের খুব কাছেই এর অবস্থান। অনেক আগ থেকেই এলাকাটি স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমান সময়েও তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও এখনকার সময়ে বেশিরভাগ ব্যবসা উদ্যোগ অভিবাসীদের দখলে।

প্রথম ট্যুর দল জার্মানির বহুজাতিক কোম্পানির সদস্যদের সঙ্গে গাইড-লেখক। ছবি: রাসেল আহম্মেদ

লিসবনের অন্যতম বৈচিত্র্যময় এই এলাকায় আমি থাকছি ৬ বছরের কিছুটা বেশি। বলা চলে, পর্তুগালে অভিবাসী জীবনের পুরো সময়টায় এখানেই কেটে গেছে। পাশাপাশি যুক্ত আছি স্থানীয় বেশকিছু সংগঠনের সঙ্গে, গড়ে তুলেছি একটি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।

বছরের শুরুতে মাইগ্রেন্ট ট্যুরের নতুন গাইড নির্বাচনে আমিও আবেদন করি। সেই অনুযায়ী সিভি ও মোটিভেশনাল লেটার দিলেও নির্বাচিত হওয়ার আস্থা কম ছিল। কারণ আবেদন করেছিলেন ১ টি দেশের ৫০ জন।

বাছাই করে মাত্র ১০ জনকে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়, এর মধ্যে আমিও ছিলাম। পরে আমিসহ ৫ জন প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করে টেস্ট ভিজিটের জন্য মনোনীত হয়। ২টি টেস্ট ভিজিট করেই এপ্রিলে মাইগ্রেন্ট ট্যুরের একজন গাইড হিসেবে অফিসিয়াল স্বীকৃতি পেলাম।

মে মাসে আমার প্রথম মাইগ্রেন্ট ট্যুরের দলটি ছিল জার্মানির একটি বহুজাতিক কোম্পানির। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৭ জন সদস্য ছিলেন। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে তারা মাইগ্রেশন ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে বাস্তবিক অভিজ্ঞতা নিতে লিসবন এসেছিলেন।

লিসবনে ‘মাইগ্রেন্ট ট্যুর’ সহযোগী সংগঠন রিনোভার মুরারিয়ার সদস্যরা। ছবি: রাসেল আহম্মেদ

প্রথম ভিজিট তাই কিছুটা নার্ভাসও ছিলাম, কিন্তু ট্যুর শেষে যখন ৫০ ইউরো নগদ বকশিস উঠে এল, মনে হল এতটা খারাপ হয়নি। উৎসাহ বাড়ে।

সেই থেকে গত ৪ মাসে ১২টি ট্যুরের গাইড হওয়ার সৌভাগ্য হয়। এসব ভ্রমণে পেয়েছিলাম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং নানা সংগঠন, সংস্থা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য বা কর্মীদের। 

সবশেষ গত মাসের ২২ তারিখে মাইগ্রেন্ট ট্যুর সুইজারল্যান্ডের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভ্রমণের গাইড হয়েছিলাম। দলটিতে বিশ্বের ১১টি দেশের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ১৮ জন শিক্ষার্থী ও ৫ জন শিক্ষক ছিলেন। পরের ভ্রমণ, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ২৫ জন শিক্ষার্থীদের দলের সঙ্গে।

এই ভ্রমণের বিশেষ দিক হল, নির্দিষ্ট রুটের গন্তব্য বা স্থানগুলোর ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের গল্পও বলার সুযোগ। বিশেষ করে নিজের পরিবার, সমাজ, দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি এবং অভিবাসী হওয়ার পেছনের গল্প। অংশগ্রহণকারীরা খুব মনোযোগে শুনেন, উপভোগ করেন। আমি প্রতিটি ভ্রমণেই বাংলাদেশকে তুলে ধরতে ষোলআনা পূর্ণ করেছি।

ভ্রমণের সময়ে বিশেষ কিছু উপাদান থাকা জরুরি। যেমন বিশেষ কোন স্মৃতি জড়ানো ছোটবেলার কোন ছবি, দেশের মনুমেন্টের ছবি বা রেপ্লিকা, ঐতিহ্যে-সংস্কৃতি বা খাবারের বৈচিত্র্য তুলে ধরতে এমন কোন নিদর্শন। যাতে সবাইকে সহজে বুঝানো যায়, অনুভব জাগানো যায় ।

আমার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকাসহ একটি বাংলা বর্ণমালার বই, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং লিসবনের স্থায়ী শহীদ মিনারের একটি করে ছবি থাকে। পাশাপাশি একটি প্লাস্টিকের কোটায় দেশীয় প্রায় ২০ পদের বেশি দানা মসলা থাকে, যা সবাইকে দেখতে এবং স্বাদ-গন্ধ নিতে উৎসাহ দিয়ে থাকি।

শহীদ মিনারের ছবি দেখিয়ে আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পেছনের গল্প তুলে ধরি। পতাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জনের গল্প বলি। দানা মসলার স্বাদ-গন্ধে তারা জেনে যায় আমাদের খাবার ঐতিহ্যে, মাছে-ভাতে বাঙালির তত্ত্ব।  

ভাল লাগে যখন বলতে পারি, ভাষা শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা ভাষা, দেশ ও পতাকা পেয়েছি।

স্বাধীনতার জন্য নানা জাতির আত্মত্যাগের ইতিহাস তাদের কম-বেশি জানা আছে। কিন্তু যখন শুনেন শুধু ভাষার জন্য বাঙালি জাতি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, তারা অবাক হন। শিহরিত হন মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত হারানোর ইতিহাস জেনে।

ভ্রমণের শেষেও অনেক শিক্ষার্থী আলাদাভাবে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানতে চায়। অনেকে উৎসাহ দেখান, লিসবন কিংবা নিজ দেশে যদি কোন শহীদ মিনার থাকে, সেখানে তাদের সম্মান জানাবেন।

পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক বন্ধন এবং আতিথিয়েতার কথা শুনে অনেকে বাংলাদেশ ভ্রমণের ইচ্ছার কথা জানান।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার গল্প শুনে অভিবাদন জানতে কার্পণ্যে করেননি কেউ। বিদেশি প্রজন্মে এমন আবেগ আমাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়।

৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময়ের ভ্রমণের ১২টি গন্তব্য বা স্পটের মধ্যে আমাদের মাল্টিকালচার একাডেমিও রাখা হয়েছে। কেননা এটিকে লিসবনের প্রথম সারির একটি ভাষা শিক্ষা স্কুল হিসেবে বিবেচিত করা হয়। যেখানে অভিবাসীদের ভাষা ও বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়া হয় । 

একাডেমিতে প্রতিটি ভ্রমণ দলকে সংক্ষিপ্ত কর্মশালা মাধ্যমে আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি পর্তুগিজ ভাষা-সংস্কৃতি উপস্থাপন করে থাকি।

৪ মাসের অভিজ্ঞতায় ধারণা হল, ইউরোপীয় টিনএজ জেনারেশনের কাছে বাঙালি জাতির গৌরবময় ইতিহাস অনেকটা আড়ালেই পড়ে রয়েছে।

দায়টা আমাদেরই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা এখনও আমাদের দেশটাকে সেই অর্থে তুলে ধরতে পারেনি। যতটুকু এগিয়েছি ততটুকু পরিচিত করতে পারেনি। পুর্তগালসহ ইউরোপের সমৃদ্ধ ইতিহাসের দেশগুলো নিজেদের শৌর্য-বীর্য-ইতিহাস-সংস্কৃতি তুলে ধরতে এখনও যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার ধারে কাছেও বাংলাদেশ নেই।

এসব কারণেই বাংলাদেশকে তুলে ধরার আগ্রহটা আরও বেড়েছে, জেদ চেপেছে আরও বেশি করে দেশের গল্প বলার। চলমান এই কর্মসূচির সুযোগটা নিয়েই যতদিন সম্ভব তা করে যেতে চাই।

মো. রাসেল আহম্মেদ: পর্তুগাল প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও কমিউনিটি মিডিয়েটর

Comments