স্বার্থবিরোধী চুক্তিতে ১০ বছরে বিমানের লোকসান হবে ১০৫৯ কোটি টাকা

দরপত্র মূল্যায়নে নিয়ম ভঙ্গ ও তথ্য গোপন করে চুক্তি করায় এই লোকসান হবে বলে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক কার্যালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফাইল ছবি | বিমানের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

টিকিট বিক্রি ও বুকিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগে স্বার্থবিরোধী চুক্তি করায় ১০ বছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অন্তত ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা লোকসান হবে।

বাংলাদেশের মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক কার্যালয়ের সাম্প্রতিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। দরপত্র মূল্যায়নে নিয়ম ভঙ্গ ও তথ্য গোপন করে চুক্তি করায় এই লোকসান হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে ট্রাভেল এজেন্টদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি ও বুকিং সেবার জন্য সেবার জিএলবিএল ইনকরপরেটেডের সঙ্গে বিমান চুক্তিবদ্ধ। বিমান ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে এই সেবা নিচ্ছে।

এ সময়ে 'এসআইটিএ' নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিমানকে প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস) সেবা দিচ্ছিল—যা টিকিট বুকিংয়ের পর কতজন যাত্রী উড়োজাহাজে উঠছে, এর হিসাব রাখে। এ ছাড়া, তারা প্রি-ফ্লাইট অপারেশনের একটি টুল ডিপারচার কন্ট্রোল সিস্টেমও (ডিসিএস) দিয়ে আসছে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে এসআইটিএ বিমানকে জানায়, তারা আর পিএসএস ও ডিসিএস পরিষেবা দেবে না।

২০২০ সালের ৩ জুন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পিএসএস, ডিসিএস, ই-কমার্স, লয়্যালটি প্রোগ্রাম, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স, গ্রাহক পরিষেবার জন্য দরপত্র আহ্বান করে।

সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় সেবার জিএলবিএলের সঙ্গে চুক্তি করে বিমান।

অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিযোগিতায় টেক্সাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির এগিয়ে যাওয়ার কারণ হলো তাদের আর্থিক প্রস্তাবের বিস্তারিত তথ্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সামনে উপস্থাপনই করা হয়নি। বিমানের কর্মকর্তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই কাজটি করেছেন। এই চুক্তি হলে ১০ বছরে অন্তত ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার লোকসান হতে পারে, এই প্রাক্কলিত তথ্যও গোপন করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে পিএসএস ও ডিসিএস ব্যবহারের খরচ প্রতি বছর ২ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু, দরপত্র মূল্যায়নের সময় এই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। পরে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অসঙ্গতি ধরা পড়ে।

এ ছাড়া, সেবারের সঙ্গে বিমানের চুক্তিতে এমন আরও অনেক কিছু রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেবার তাদের কার্যক্রম শুরু করার পর যাত্রীদের বোর্ডিং বাবদ অন্তত ১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার ফি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বিমানের সঙ্গে চুক্তিতে বলা হয়েছে, ১ লাখ যাত্রীর বোর্ডিংয়ে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ফি ৫০ হাজার ডলার, বছরে যা প্রায় ৬ লাখ ডলার।

চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি মাসে ১ লাখ যাত্রীর বাইরে প্রত্যেক অতিরিক্ত যাত্রীর জন্য বিমান আরও দশমিক ৮৮ ডলার দেবে।

নিরীক্ষকদের অনুমান, বিমান বছরে প্রায় ১৮ লাখ ৩০ হাজার যাত্রী বহন করে এবং এর জন্য তাদের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।

'এসআইটিএ'র সিস্টেম থেকে 'সাবের'র সিস্টেমে ডেটা স্থানান্তরে ৫ দিন বেশি সময় লাগায় এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ও লয়্যালটি প্রোগ্রাম সম্পর্কিত কিছু কাজ বাকি থাকায় সেবার বিমানের কাছে ৪০ হাজার ডলার পাওনা দাবি করেছে।

চুক্তির যে ধারা অনুযায়ী সেবার এই অর্থ দাবি করার সুযোগ পেয়েছে, তা নিয়েও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মাত্র ৩টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে। অথচ, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, অন্তত ৪ জন দরদাতাকে অংশ নিতে হবে।

সেবার তাদের প্রাক্কলিত সব খরচের হিসাব দেখিয়েছে ন্যূনতম যাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি প্রতি যাত্রী বা মোট যাত্রীর শতকরা হিসাবে তাদের সেবার জন্য চার্জ নিচ্ছে, সেহেতু তাদের সিস্টেমটি চালু হওয়ার পর মোট খরচের হিসাব বদলে যায়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ন্যূনতম সংখ্যক যাত্রীর হিসাব করার পরিবর্তে প্রাক্কলিত মোট যাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।

২০২১ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ৩টি সভায় টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিও এ বিষয়টি উল্লেখ করেছে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ন্যূনতম যাত্রী বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সেখানেও আলোচনা হয়। তারপরও চুক্তিটি ন্যূনতম যাত্রীর হিসাব করেই করা হয়।

চুক্তিতে শুধুমাত্র প্রতি টিকিটের বুকিং চার্জ কত হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, চুক্তির ১০ বছরে কতগুলো টিকিট বিক্রি হবে এবং মোট খরচ কত হতে পারে, তা উল্লেখ করা হয়নি।

এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের সময় দরপত্র মূল্যায়নকারীরা ছিলেন অন্ধকারে। অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ বছরে এই খরচ আনুমানিক ১ হাজার ১৯ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে, যা মূল্যায়ণ কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়নি।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেন, 'আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে অডিট প্রতিবেদন পাইনি। এগুলো প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। এগুলো খুবই সরল অভিযোগ। তারা যে পরিসংখ্যান দিয়ে বলছে যে আমরা এর অপব্যবহার করেছি, তা বাস্তবসম্মত নয়।'

তিনি বলেন, 'আমরা এই অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করে উত্তর জানাব। তারপর আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করব। যদি তারা আমাদের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়, তাহলে তো বিষয়টি সেখানেই শেষ। আমরা পক্ষপাত করিনি।'

সেবার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও কান্ট্রি জেনারেল ম্যানেজার সাইফুল হক জানান, তার প্রতিষ্ঠানকে এই অডিট প্রতিবেদন সম্পর্কে এখনো কিছু জানানো হয়নি।

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন Lopsided deal to cost Biman over Tk 1,000cr

Comments