বাংলাদেশের ক্রিকেট
গত বেশ কিছুদিন ধরেই ক্রিকেটের খেলোয়াড় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে ধারাবাহিক আলোচনা-সমালোচনা চলছিল, তার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়েছে সম্প্রতি। গত ১৯ জুন বিসিবির সভায় সেই পুরনো স্বতঃসিদ্ধ ধারায় খেলোয়াড় নির্বাচনের বদলে দ্বিস্তর বিশিষ্ট এক নির্বাচন পদ্ধতি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান অনুমোদিত এই পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে বহুধা বিতর্ক। অনেকেই মনে করছেন যে পদ্ধতি বিসিবির পরিচালনা পর্যদে অনুমোদিত হলো এতে করে আরো জটিলতাই তৈরি হলো। খেলোয়াড় নির্বাচনে এত জটিলতা বা এত বিজ্ঞজনের সম্পৃক্ততার দরকার ছিল না। ১৪ জনের দল গড়তে এত ধাপ, এত মানুষ অযৌক্তিক। অনেকেই তাই আড়ালে-আবডালে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সিলেকশন কমিটি থেকে কেউ কেউ পদত্যাগ করতে পারেন এ রকম আলামত বা গুঞ্জনের খবরও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই বলছেন নির্বাচন প্রক্রিয়া যেটা অনুমোদিত হলো সেটি স্মরণকালের সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্ত ক্রিকেটের জন্য কল্যাণের বদলে অকল্যাণই ডেকে আনতে পারে। তবে কতটা কল্যাণ আর অকল্যাণ বয়ে আনবে তা সময় বলে দেবে।
নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী নির্বাচকম-লীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোচ এবং ম্যানেজার। ম্যানেজারের সম্পৃক্ততা নিয়ে আগে থেকেই ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছিল সর্বত্র। বর্তমান পদ্ধতিতে সংক্ষেপে খেলোয়াড় বাছাই প্রক্রিয়াটি হলো এ রকমÑ প্রথমে সিলেকশন কমিটি কোচ এবং ম্যানেজারের সঙ্গে বসে তাদের চাহিদা নিরূপণ করবেন, এরপর তারা খেলোয়াড় নির্বাচন করবেন। আর সবশেষে বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে সভাপতি। বর্তমান প্রক্রিয়ায় অনেকেই মনে করছেন এখানে সিলেকশন কমিটির মতামত অনেকাংশেই খর্ব হবে। বাইরের বহুবিধ চাপও থাকবে। ফলে স্বচ্ছতার জায়গাও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়ার কোনো উপায় নেই। এদিকে ক্রিকেটে আরো কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। সিলেকশন কমিটি থেকে সরিয়ে হাবিবুল বাশারকে দেয়া হয়েছে মহিলা ক্রিকেট দল নির্বাচনের দায়িত্বে। এ বিষয়টি অনেকের কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়নি। অনেকেই মনে করছেন বাশারের মতো একটি মেধাবী মানুষকে কার্যত ক্ষুদ্র দায়িত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তার মেধাকে আটকে দেয়া হলো। বাশার অবশ্য এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। তবে বোঝা যায়, এটি তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি।
ক্রিকেট নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। ক্রিকেটই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের মর্যাদাকে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন্তর্জাতিক আসরে ক্রিকেটে সাফল্য পাওয়ার কারণে এই খেলাটির জনপ্রিয়তা এখনো সবচেয়ে বেশি। যে ক্রিকেট একদা ছিল শহুরেদের খেলা বলে পরিচিত, সেই ক্রিকেট এখন কতটা তৃণমূলে পৌঁছে গেছে তা কল্পনাও করা যায় না। গাঁওগেরামেও এখন ক্রিকেটের কদর সবচেয়ে বেশি। আর তাই পরিত্যক্ত ভূমি, চর, এমনকি খানাখন্দেও দেখা যায় আমাদের তরুণ, কিশোর এবং শিশুরা ক্রিকেট খেলছে। ক্রিকেট নিয়ে মহা উল্লাসে মেতে আছে।
ক্রিকেটই আমাদের সর্বশেষ উপহার দিয়েছে মুস্তাফিজের মতো একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারÑযে কিনা এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত এক বোলার। বোলিং সৌন্দর্য আর নিজের ক্যারিশমা দেখিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের মনোযোগ আকর্ষণই শুধু করেননি, তোলপাড়ও তৈরি করেছেন। মুস্তাফিজের আগে সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তামিম ক্রিকেটকে যে কতটা আলোকময় করেছেন তা বলাই বাহুল্য। সাকিব তো কয়েকবার আইসিসি র্যাংকিংয়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার নির্বাচিত হয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামটাকেই অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যান। বলতে দ্বিধা নেই ক্রিকেট নিয়ে আমাদের এখন সীমাহীন গর্ব করার আছে। ক্রিকেটের এই উত্থান খুব বেশিদিনের। তবে নব্বই দশকে এই উত্থানের সূচনা হয়েছিল মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আকরাম খান, হাবিবুল বাশারদের হাত ধরে। পরবর্তী প্রজন্ম তাদেরই স্পিরিট আর দেখানো পথের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গেছে। এরপর আশরাফুল, সাকিব, মাশরাফি, মুশফিকরা ক্রিকেটকে নিয়ে গেছে উচ্চতর সোপানে। বলতে দ্বিধা নেই এটি সম্ভব হয়েছে একদল মেধাবী ক্রিকেটার, দক্ষ সংগঠক সর্বোপরি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
ক্রিকেট আজ যে সাফল্য সেটা একদিনে আসেনি। অনেক পরিকল্পনা, পরিশ্রম, লগ্নির বিনিময়েই এসেছে। যেমন একজন সাবের হোসেন চৌধুরীÑ ক্রীড়ামোদীদের হৃদয়ে চিরকালই উজ্জ্বলতর হয়ে থাকবেন শুধু তার ক্যারিশম্যাটিক সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে। সবারই মনে থাকার কথা নব্বইয়ের দশকে বিসিবির সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশকে টেস্ট খেলার মর্যাদা এনে দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকায় ছিলেন তিনি। শুধু এই নয়, বিসিবির সভাপতির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিশ্ব ক্রিকেট-কূটনীতিতে তিনি অসাধারণ পারঙ্গমতা প্রদর্শন করে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ রচনা করে দিয়েছিলেন।
বর্তমান সময়ে ক্রিকেটে যে সাফল্য সেখানে ব্যর্থতাও কম নেই। সেই ব্যর্থতার যে দায় সেটা ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট কিন্তু এড়াতে পারেন না। ক্রিকেটে অনেক কিছুই হচ্ছে আবার অনেক কিছুই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশেষ করে সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা, নতুন খেলোয়াড় তৈরি এবং এর স্থিতিশীলতা বজায় রাখাটাই এখন যেন সংশয়ে ভরা। সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তামিম, মুস্তাফিজরা আমাদের গর্ব, কিন্তু এরপর পেছনে কে? প্রতিভাবান ক্রিকেটার খুব বেশি আসছে না। টুকটাক যারা আসছে তাদের রেকর্ড আশা জাগানো নয়। যারা আসছে তারা খুব বেশি সময় ক্রিজে দাঁড়াতে পারছে না। ক্ষণস্থায়ী পারফরম্যান্স তাদের। আর তাই অনেকেই দলে নিয়মিত হতে যেমন পারছেন না, তেমনি তাদের পারফরম্যান্সও উল্লেখ করার মতো নয়। এ কারণেই নির্বাচকরা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন প্রকাশ্যেই। মমিনুল, সৌম্য সরকার, লিটন দাস, তাইজুল খুব বেশি স্থায়ী হতে পারেনি। কখনো কখনো তারা ভীষণরকম ভালো খেললেও ধারাবাহিকতা নেই। ব্যাট-প্যাড নিয়ে তাই মাঠের বাইরে বসে থাকতে হচ্ছে তাদের। এ দৃশ্য আমাদের ক্রিকেটের জন্য খুব ভালো কিছু নয়। ক্রিকেটে এখনো নতুন ক্রিকেটারদের যে আগমন এবং নির্গমন সেটা অনেক ধরনের আশঙ্কাই তৈরি করছে। বিসিবিকে তাই নতুন নতুন ক্রিকেটার তৈরিতে আরো কর্মকৌশল প্রয়োগ করতে হবে।
খেলোয়াড় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে আপাতত এ বিতর্কের অবসান হবে না। পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আদান-প্রদান চলবে। আবার নাটকীয় সব ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে সময় বলে দেবে নতুন পদ্ধতি কতটা যৌক্তিক আর পদ্ধতিগতভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সামনের দিনগুলোতেই তা আরো স্পষ্ট হবে। কিন্তু একটা বিষয় না বললেই নয়, ক্রিকেটের জন্য যারা নিবেদিত, ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে যারা মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন, তাদের স্পিরিটটাকে আমাদের কোনোভাবেই অমূল্যায়িত করা উচিত নয়। হাবিবুল বাশারের মতো একজন মেধাবী ক্রিকেট-মানুষের মেধা প্রয়োগের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করে দেয়াটা তার প্রতি অবমূল্যায়নই বটে। এদিকে, নির্বাচকম-লী আর নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নাখোশ প্রধান নির্বাচক পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। বিসিবি স্বীকার করতে না চাইলেও তিনি যে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে তা বলতে গেলে সশ্লিষ্ট মহল অবগত। এই পরিস্থিতি নিসন্দেহে ক্রিকেটের সামনের দিনগুলোর জন্য অনেকগুলো ঝুঁকি বাড়িয়ে দিল ক্রিকেটের জন্য ভেতরে ভেতরে বহুধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝুঁকি তৈরি হওয়া মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। আমাদের সবারই লক্ষ্য হতে হবে ক্রিকেটকে এগিয়ে নেয়া। নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি আর তৃণমূলের ক্রিকেটকে উজ্জীবিত করতে আরো মনোযোগী হওয়া। আবার সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে ক্রিকেট আজ গৌরবময় স্থানে অধিষ্ঠিত, সবার মতামত ও অভিপ্রায়ের সঠিক মূল্যায়নটাও তাও সূচকে থাকতে হবে।
ছবি : সংগ্রহ
Comments