কানের গল্প
বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মধ্যে সবার আগে যে নামটি আসে তা হল কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এর ব্যাপকতা, গুরুত্ব এবং গ্ল্যামার সবকিছু মিলিয়ে এর আকর্ষণ অনেক বেড়ে যায়। এর আগেও আমি আমার সিনেমা জয়যাত্রা, দারুচিনি দ্বীপ আর রূপকথার গল্প নিয়ে বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে গেছি। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছি, বালি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার সিনেমা পুরস্কার পেয়েছে। এই ফেস্টিভ্যাল আমার কাছে বাকি সবগুলো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে একেবারে ভিন্ন মনে হয়েছে। এটি সবগুলোর থেকে বড় এবং গ্লামারাস। এমন একটি প্লাটফর্মে গেলে অভিজ্ঞতা অর্জনেরও একটি ব্যাপার থাকে। ফিল্ম মেকার থেকে শুরু করে ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর, পরিচালক, অভিনয় শিল্পী, স্ক্রিপ্ট রাইটার, সাংবাদিক সবাই আসে এখানে। তারা মূলত নিজেদের সিনেমাকে প্রমোট করতে আসে। লক্ষাধিক লোক এখানে যে আসে তার আরেকটি কারণ নিজেদের অভিজ্ঞতা বাড়ানো। এখানে প্রতিযোগিতার যে বিভাগগুলো আছে সেখানে সুযোগ পাওয়া তো অবশ্যই অনেক সম্মানের বিষয়। ভালো পরিচালকদের ভালো সিনেমাই সেখানে যায়। মূল প্রতিযোগিতার পাশাপাশি ভিলেজ ইন্টারন্যাশনাল, মার্শে দু’ফিল্মস, মার্কেটসহ কয়েকটি শাখা আছে এই ফেস্টিভ্যালে। ভিলেজ ইন্টারন্যাশনালে বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়ন থাকে এবং তারা তাদের দেশের সিনেমাকে প্রমোট করে। সেখানে দেশ ভিত্তিক প্যাভিলিয়নে সেই দেশের সিনেমা বা সিনেমা সংশ্লিষ্ট সাম্প্রতিক কাজ প্রদর্শনী করা হয়। আমার মনে হয় এখানে বাংলাদেশের একটি প্যাভিলিয়ন থাকলে আমাদের সবারই ভালো লাগত। সেখানে আমি শ্রীলঙ্কা, নেপাল, তিউনিসিয়ার মতো ছোট ছোট দেশের প্যাভিলিয়ন দেখেছি। এমন একটি জায়গাতে বাংলাদেশের একটি প্যাভিলিয়ন থাকলে আমরা বাংলাদেশের সিনেমাকে বিশ্বের দরবারে আরো পরিচিত করে তুলতে পারতাম অনেক দ্রুত। এমন একটি প্যাভিলিয়ন করতে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। এই ফেস্টিভ্যালের মার্কেট যেটা সেখানে ডিস্ট্রিবিউটররা আসেন
এবং তাদের বুথ থাকে।
এখানে তাদের লিফলেট বা প্রেসকিটগুলো থাকে। তারা চেষ্টা করে এগুলোসহ আরো বিভিন্নভাবে তাদের সিনেমাকে সবার কাছে প্রমোট করতে। যাতে আরো বেশি দেশে তারা তাদের সিনেমা ডিস্ট্রিবিউট করতে পারে। কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দু’ফিল্ম। এখানে সিনেমা আসে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রিমিয়ারের জন্য। এখানে সিনেমা প্রিমিয়ারের লক্ষ্য অবশ্য ভিন্ন কিছু না, অন্যান্য জায়গার মতো এই জায়গাটিও সিনেমার প্রমোশনের জন্যই। সারা বিশ্ব থেকেই সিনেমা আসে এই মার্শে দো ফিল্মে। হলিউড, ইরানের সিনেমা থেকে শুরু করে অনেক কম পরিচিত দেশের সিনেমাও আসে এখানে। এ বছর বাংলাদেশ থেকেও দুটি সিনেমা ছিল কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের এই শাখায়। বিভিন্ন শাখা নিয়ে তারা যে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালটি সাজায় তা একটি বিরাট মেলার মতো। এই মেলাটি পুরো কান শহরজুড়েই বসে। এই ফেস্টিভ্যালে যে শুধুই সিনেমার সঙ্গে জড়িত মানুষেরাই আসে তা নয়। অনেক দেশের পর্যটকরাও এই সময়ে ঘুরতে চলে আসে। এই ফেস্টিভ্যালকে কেন্দ্র করে কান শহরটিতে একটি সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এই সময় সারা পৃথিবী থেকেই পর্যটকরা এসে ভিড় করে এখানে। ফিল্মে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকের চাপ বেড়ে যাওয়ায় আবাসিক হোটেলের ভাড়া বেড়ে যায়, ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়, রেস্টুরেন্টগুলোতে খাওয়ার জন্য গিয়ে টেবিল খালি হওয়ার অপেক্ষা করতে হয়। প্যালেস ডি ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে এই উৎসবের মূল কেন্দ্র। এখানেই মূল প্রতিযোগিতার সিনেমা দেখানো হয়। এই প্যালেস এবং এর পাশের সৈকতজুড়ে খুব সুন্দর একটি উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। সেটা এত ভালো যে, ওখান দিয়ে এমনিতেই হাঁটতেও ভালো লাগে। এই আনন্দ-উৎসব করার থেকে বড় যে বিষয়টি আমাদের মতো সিনেমার মানুষদের কাছে তা হল অনেকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। অনেক দেশের ডিস্ট্রিবিউটর এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। তাদের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে নিজের সিনেমা বিভিন্ন দেশে প্রচারের জন্য অনেক বড় সুযোগ তৈরি করা যায়। বিভিন্ন দেশের মেকার বা অভিনয় শিল্পীদের একটি মিলন মেলাও এটি। তাদের সবার দেখা হওয়ার আর আড্ডা দেয়ার একটি সুযোগ এটি। এসব দিক থেকে সিনেমা নিয়ে যারা কাজ করে তাদের নিজেদের কাজকে প্রমোট করার যেমন সুযোগ এখানে থাকে, তেমনি ব্যক্তি হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে। একজন মানুষের পরিচিতি বা তার ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক পরিম-লে হঠাৎ করে তৈরি হয় না, তৈরি করে নিতে হয় ধীরে ধীরে। এ কারণে এসব প্লাটফর্মগুলোতে আমাদের এক্সপোজার যদি থাকত তাহলে অনেক ভালো হতো। আমার মনে হচ্ছে আমার যেতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরো আগে যদি এখানে যাওয়া যেত তাহলে অনেক ভালো হতো। এখনকার তরুণ যারা আছে তাদের উচিত এমন প্লাটফর্মগুলোতে সুযোগ-সুবিধামতো সবারই চেষ্টা করা। আর সেই সঙ্গে মূল প্রতিযোগিতায় যেতে পারলে তো খুবই ভালো হয়। আমরা বাংলাদেশের নির্মাতারা খুবই খুশি হব যদি প্রতি বছরই আমাদের দেশের সিনেমা প্রতিযোগিতায় যেতে পারে। আমি নিজেও স্বপ্ন দেখি মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার। এটা যদিও সহজ কিছু না, তবে অসম্ভবও না। এটা
সত্য যে বিশ্ব চলচ্চিত্র থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা যে বাজেট আর আয়োজনে সিনেমা বানাই তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রতিযোগিতা করা সহজ না। সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যের কাজের প্রকাশ ভঙ্গি, কাজের ধারণা, শিল্পের ধারণা এবং আমাদের ধারণার মধ্যে অনেকটা পার্থক্য বিদ্যমান। চলচ্চিত্র একটি আন্তর্জাতিক মাধ্যম। এখানে টেকনোলজি থেকে শুরু করে ভাষা সবই আন্তর্জাতিক। আমরা এখানে প্রতিযোগিতা করতে গেলে সেই লেভেলে গিয়েই প্রতিযোগিতা করতে হবে। বাংলাদেশে আমরা যারা সিনেমা বানাই এগুলোর মধ্য থেকে হাতেগোনা কিছু সিনেমা কয়েকটি ফেস্টিভ্যালে যায়। সেখানেও যে আমাদের সিনেমা নিয়মিত যাচ্ছে তা না। আমরা অনেক জায়গায় আবেদন করি কিন্তু সব জায়গাতে সুযোগ পাই না, অনেক জায়গাতে পাই। তযে সুযোগ পাই আর না পাই সুযোগ পাওয়ার চেষ্টাটা আমাদের ভেতরে রাখতে হবে। আমাদের কাজের মান আরো বাড়িয়ে কীভাবে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন উৎসবে নিয়মিত হওয়া যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কাজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাজের প্রোমোশনের দিকটাও মাথায় রাখতে হবে। এর জন্য প্রোফেশনাল লোক তৈরি হতে হবে। একজন পরিচালক তার নিজের তৈরি করা সিনেমা নিয়ে প্রোমশন করে বেড়াতে পারবে না। এর জন্য আলাদা লোক তৈরিতে ডিস্ট্রিবিউটর বা প্রডিউসাররা যদি উদ্যোগী হন, তাহলে এটা খুব ভালো হবে। উন্নত দেশগুলোতে কাজের ধরন আলাদা করে দেয়, ফলে বিভিন্ন অংশের কাজ বিভিন্ন জন করছে। এর ফলে সুষ্ঠু ফলাফল বের করে আনতে পারছে।
আমরা এবার ছয় দিন ছিলাম কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। যতটুকু পেরেছি বিভিন্ন সিনেমা দেখা এবং বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটিয়েছি। এর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। অনেক বিষয় আবার হতাশও করেছে। হতাশ করেছে আমাদের সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা বা আমাদের ঘাটতির জায়গাটি। আশান্বিত করছে সম্ভাবনার জায়গাটি। আজকে আমরা পারছি না, কাল একজন তরুণ হয়তো আমাদের এই আশাটিকে বাস্তবে পরিণত করবে। এমন বড় আসরে বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে পুরস্কার অর্জন করে আনবে। আমাদের দেশের সিনেমা একসময় ইরানের সিনেমার মতো পরিচিত হয়ে উঠবে বিশ্বময়। ইরানের সিনেমা যে বিশ্বব্যাপী এত পরিচিত হয়েছে, তা তো আর একদিনে হয়নি। তাদের সময় দিতে হয়েছে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করতে হয়েছে এবং সেগুলোকে ছড়িয়ে দিতে হয়েছে। এসব মিলিয়ে তারা যা করেছে তা আমাদের জন্য একটি অনুকরণীয় উদাহরণ বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশ অনেক এন্টারপ্রাইজিং একটি দেশ। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা অনেক দিকেই অনেক উন্নয়ন সাধন করেছি। অনেক দিকেই যদি উন্নয়ন সাধন হয়ে থাকতে পারে তাহলে সিনেমার ক্ষেত্রে না কেন। আজ থেকে কিছু বছর পর হয়তো আমরা দেখতে পাব আমাদের দেশের সিনেমার বিশ্বব্যাপী জয়যাত্রা।
বিপাশা আর আমি দু’জনেই এই উৎসবটি অনেক উপভোগ করেছি। একজন অভিনেতা এবং অভিনেত্রী হিসেবে এই অভিজ্ঞতা আমাদের মনে রাখার মতো। রেড কার্পেটে হাঁটা, ড্রেস কোড মেইনটেইন করে সবার সঙ্গে চলা সবকিছু মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা। সার্বিকভাবে আমার মনে হয় একটি জিনিসকে কতটা সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায় তা দেখতে পারি আমরা এই উৎসবে। লক্ষ লোকের এই আয়োজনে সবই সুন্দরভাবে চলছে। কে কখন কোথায় যেতে পারবে তা আগে থেকেই ঠিক করা আছে। কেউ চাইলেই তার নিয়ম ভাঙতে পারবে না। কে কখন কোন সিনেমা দেখবে তা জানিয়ে দেয়া আছে। সবাই সেই পদ্ধতি মেনে সুন্দরভাবে শেষ করছে এই উৎসব। কখন একজন রেড কার্পেটে যাওয়ার সুযোগ পাবে তাও জানানো আছে। এই ইভেন্টকে যে এত সুন্দর করে সাজানো তা অনেক বড় একটি বিষয়। এই অবস্থানটিও কিন্তু একদিনে আসেনি। এটি কান ফেস্টিভ্যালের ৬৯তম আসর। সময়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে এর উৎকর্ষ সাধন হয়েছে এবং আজকের রূপ নিয়েছে। এই উৎসবটি যখন শুরু হয়েছিল, তখন এটি আর দশটি সাধারণ উৎসবের মতোই ছিল। আমাদের দেশেও ফেস্টিভ্যাল হয়। ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এরই মধ্যে অনেক বছর পার করে ফেলেছে। ধীরে ধীরে এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত হয়ে উঠছে। এই ফেস্টিভ্যালগুলো শুধুই যে সিনেমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা কিন্তু নয়, এর সঙ্গে পর্যটন শিল্পও জড়িত। কান চলচ্চিত্র উৎসবকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ মানুষ ফ্রান্সে ভ্রমণ করে। এই মানুষগুলো তো সেখানে গিয়ে খরচ করছে তার পকেটের টাকা। এর মাধ্যমে ওই দেশের অর্থনীতিতেও একটি পজিটিভ প্রভাব আসছে। আমি আশাবাদী, একসময় আমাদের ফেস্টিভ্যালও কানের মতো বড় আসরের তকমা পাবে। হয়তো সিলেটে বা কক্সবাজার সৈকতকে কেন্দ্র করে একটি ফেস্টিভ্যাল হবে কানের মতো।
অনুলিখন : আব্দুল্লাহ আল আমীন
ছবি : সংগ্রহ
Comments