ফিরে দেখা জুলাই গণঅভ্যুত্থান

জুলাই ১৮: দেশব্যাপী প্রতিরোধ, নির্বিচার গুলি-সহিংসতায় নিভল শত প্রাণ

ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দিনভর পুলিশের সংঘর্ষ চলে। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত কমপ্লিট শাটডাউন অর্থাৎ সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিন ছিল ১৮ জুলাই; বৃহস্পতিবার।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, এদিন অবরোধ চলাকালে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘাত ও সহিংসতায় দেশজুড়ে ১০০ জনের বেশি নিহত হন। নিহতদের অনেকেই ছিলেন শিক্ষার্থী, অধিকাংশই ছিলেন ঢাকার। এছাড়া চট্টগ্রাম, নরসিংদী, মাদারীপুর, সিলেট, রংপুর ও সাভার থেকেও নিহত হওয়ার খবর আসে।

নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগের শরীরে গুলির অথবা মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া পাওয়া যায়।

একইসঙ্গে এই দিনেই পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের আক্রমন থেকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের রক্ষায় পথে নেমে আসেন অনেক অভিভাবক, এলাকাবাসী। কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করেন। কেউ নিয়ে আসেন পানি, খাবার। এর মাধ্যমে আন্দোলনে তৈরি হয় নতুন সংহতি।

ঢাকার মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, পরে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়। বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চলে।

দুপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাত ৯টা থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৮ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল। রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৫টির বেশি জেলায় দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে।

কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের, আবার কোথাও সরকার-সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়।

'কমপ্লিট শাটডাউনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে' ঢাকাসহ সারাদেশে মোতায়েন করা হয় ২২৯ প্লাটুন বিজিবি।

কাউকে ছাড় দেব না: ডিবির সাবেক প্রধান হারুন

ডিবি হারুন
ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। স্টার ফাইল ফটো

১৮ জুলাই বিকেলে সংঘর্ষ-সংঘাতে উত্তাল ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকা পরিদর্শনকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, 'যারা পুলিশের গায়ে হাত দিচ্ছে, রাস্তায় আগুন লাগাচ্ছে- আমরা তাদের কাউকে ছাড় দেবো না।'

পুলিশ ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তারা (আন্দোলনকারীরা) যদি মনে করে এটা দুর্বলতা, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে।'

সহিংসতাকারীরা কোটা আন্দোলনের কেউ না মন্তব্য করে হারুন আরও বলেন, 'তাদের আমরা চিনি, নাম-নাম্বার পেয়েছি। তারা দুর্বৃত্ত। তারা কোটা আন্দোলনের কেউ না। তারা জামায়াত-শিবির বা বিএনপির অপরাজনীতি করে।'

মতিঝিল, যাত্রাবাড়ি, শনির আখড়া, রণক্ষেত্র 

এদিন সকাল থেকেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকার মতিঝিল, যাত্রাবাড়ি ও শনির আখড়ায় অবস্থান নিলে পুলিশের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় ঘটনা ঘটে।

দুপুরে আন্দোলনকারীরা যাত্রাবাড়ী থানা ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শটগান থেকে গুলি ছোড়া হয়। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

সারাদিনের সংঘাতে এই তিন এলাকায় নিহত হন অন্তত ৯ জন।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দিনভর সংঘর্ষ হয় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্ত্বরেও।

উত্তরায় নির্বিচার গুলি

১৮ জুলাই উত্তরায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে অংশী হন।

এদিন ইউত্তরার আজমপুরে কপালে গুলি লেগে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ শহীদ হন। ওই দিন অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন মুগ্ধ। পানির কেস হাতে নিয়ে 'পানি লাগবে, পানি, পানি...' বলছিলেন মুগ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

রাত পর্যন্ত উত্তরা ও আশপাশের এলাকা থেকে অন্তত ১১ জন নিহত হওয়ার খবর আসে। আহত হন শত শত আন্দোলনকারী।

পুলিশের সঙ্গে অস্ত্র হাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা

১৮ জুলাই থেকে মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও রামপুরায় ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। একই চিত্র চোখে পড়ে অন্য বিভিন্ন পয়েন্টেও।

এদিন ধানমন্ডিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে নিহত হয় ফারহান ফাইয়াজ (রাতুল)। সে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মোহাম্মদপুর এলাকার সিটি হাসপাতালে ফারহানের মৃত্যু হয়। তার শরীরে রাবার বুলেটের ক্ষত ছিল।

এদিন নিহত মুগ্ধর পানি বিতরণের ভিডিও ও ফারহানের ছবি ছড়িয়ে পড়লে তা মানুষের ক্ষোভকে আরও উসকে দেয়।

বাড্ডায় পুলিশকে উদ্ধারে এল হেলিকপ্টার 

সকাল থেকে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় অবস্থান নেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কিছু পুলিশ সদস্য কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি ভবনের ভেতরে অবস্থান নেন।

পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল, ছররা গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়লে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। পরে শিক্ষার্থীরা ওই ভবনে পুলিশকে ৩ ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ করে রাখেন।

খবর পেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে হেলিকপ্টার নিয়ে এসে পুলিশকে উদ্ধার করে র‌্যাব।

কোটা সংস্কারের পক্ষে 'নীতিগত ঐকমত্যে' পৌঁছানোর কথা জানালেন আনিসুল হক

এদিন আন্দোলনের এ পর্যায়ে কোটা সংস্কারের পক্ষে সরকার নীতিগতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আজকেই আলোচনায় বসতে রাজি সরকার।

আনিসুল হক আরও বলেন, 'মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে আছে। যখন মামলার শুনানি শুরু হবে তখন সরকার পক্ষ প্রস্তাব দেবে। আমরা যেহেতু সংস্কারের পক্ষে এই প্রস্তাব দিব সেজন্য আপনারা বলতে পারেন আমরা কোটা সংস্কারের পক্ষে।'

পরে রাতে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদে বলেন, 'আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৮০ শতাংশ নিয়োগের সুপারিশ করা হবে। বাকি ২০ শতাংশ কোটায় রাখা হবে।'

শহীদের রক্তের ওপর কোনো সংলাপ হবে না: নাহিদ

কোটা সংস্কার নিয়ে আনিসুল হকের সংলাপের প্রস্তাব নাকচ করে দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম।

১৮ জুলাই বিকেলে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি জানান, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকার উদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর দায় সরকারেরই। সরকার আলোচনার কোনো পরিস্থিতি রাখেনি।

নাহিত লেখেন, শহীদের রক্তের উপর কোনো সংলাপ হবে না। সরকারকেই সমাধানের পথ বের করতে হবে। কেবল কোটা সংস্কার করলেই ফয়সালা হবে না। প্রথমে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সরকার দাবি কর্ণপাত করেনি৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার দিয়ে আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টা করছে। এখন সংলাপের নামে, দাবি আদায়ের নামে নতুন প্রহসন করছে।

ইন্টারনেট বন্ধ

১৮ জুলাই রাত সাড়ে আটটা থেকে ইন্টারনেটের গতি ধীর হওয়া শুরু করে। এরপর নয়টা থেকে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

এর কারণ জানতে চাইলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সব জায়গায় ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।

 

Comments