জুলাই ১৭: ছুটির দিনেও সারাদেশে বিক্ষোভ-অবরোধ, ফেসবুক বন্ধ, কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা

বিগত শতকের ষাটের দশকের শেষে ফ্রান্সের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন বদলে দিয়েছিল দেশটির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার খোলনলচে। গণঅভ্যুত্থানে রূপ পাওয়া সেই আন্দোলনের অনেক বাঙ্ময় স্লোগানের ভেতর একটি ছিল এমন—'ব্যারিকেডে অবরোধ হয় রাস্তা, খুলে যায় পথ'।
নতুন শতাব্দীর ২৪ সালের জুলাইয়ে এসে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ঘিরে যে ছাত্র আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়, সেটাও অভ্যুত্থানের পথে যেতে শুরু করে মাসের মাঝামাঝি এসে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৪ জুলাইয়ের সেই আলোচিত সংবাদ সম্মেলনের পর ১৬ জুলাই মঙ্গলবার ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ সরকার সমর্থকদের হামলা-সংঘর্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ছয়জন নিহত হন।
পরদিন ১৭ জুলাই বুধবার ছিল পবিত্র আশুরার সরকারি ছুটির দিন। তা সত্ত্বেও এদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। চলতে থাকে বিক্ষোভ, ব্যারিকেডে ব্যারিকেডে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ।
১৭ জুলাই বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিন মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার, বগুড়া ও শেরপুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের সংঘর্ষে অনেকে আহত হন।
সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন হাসিনা; উচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
রাতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘাতের সূত্রপাত হয়, পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে; নিহত হন এক সাংবাদিকসহ কয়েকজন। যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ওই রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেসবুক।
নেতাকর্মীদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত থাকার আহ্বান ওবায়দুল কাদেরের
১৭ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকা জেলা ও মহানগর (উত্তর ও দক্ষিণ) আওয়ামী লীগ, দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর এবং ঢাকার দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।
সেখানে কাদের বলেন, 'আওয়ামী লীগের অস্তিত্বের প্রতি হামলা এসেছে, হুমকি এসেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা আমাদের করতেই হবে। কাজেই আপনারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত হয়ে যান। আমাদের সারা দেশের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে আমাদের নেত্রীর পক্ষ থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, সারাদেশে সতর্ক হয়ে শক্ত অবস্থান নিয়ে এ অশুভ অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। কোনো অপশক্তির সঙ্গে আপস করা যাবে না।'
একইদিনে জাতীয় প্রেসক্লাবে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন স্বাধীনতার বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। কাজেই আর বসে থাকার সময় নেই।'
এছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হচ্ছে, তার পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো গুজব দায়ী বলে মন্তব্য করেন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক। তিনি বলেন, 'ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, এক্সের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর অফিস ও ডেটা সেন্টার যদি ঢাকায় থাকত, তাহলে যেকোনো ধরনের কনটেন্ট ও গুজবকে প্রতিহত করা বা ফ্ল্যাগ দিয়ে দেওয়া অথবা ব্লক করে দেওয়া সহজ হতো।'
এদিন দুপুর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারে সমস্যায় পড়ে মানুষ। দুপুরের পর থেকে মোবাইলে ইন্টারনেটের গতি কমে যায়। ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার ব্যাহত হতে থাকে।
ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রতিরোধ
এদিন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা ও নারী শিক্ষার্থীদেরকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা মানেননি শিক্ষার্থীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য একটাই হল। কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের হল ছাড়ার কথা জানালে তারা দুপুর থেকে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন এবং একপর্যায়ে প্রাধ্যাক্ষসহ হাউজ টিউটরদের একটি রুমে রেখে বাইরে থেকে তালা আটকে দেন।
দুপুর ১টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান শিক্ষার্থীদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ছাড়ার ঘোষণা দিতে আসলে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রার ভবন ভাঙচুর করেন ও ভিসিকে ভেতরে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
দুপুরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা অনেকটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। গায়েবানা জানাজা শেষে আন্দোলনকারীরা কফিন মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এই সময় ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়।
পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়লে শিক্ষার্থীরা ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করে। এর আগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কক্ষসহ অনেকের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকাল ১০টার দিকে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। তারা শহীদ হাবিবুর রহমান হলে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্যকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে পুলিশ টিয়ারশেল ছুঁড়ে সেখান থেকে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বিএল কলেজ, খুলনা মেডিকেল এবং বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় মহাসড়ক অবরোধ করেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বুধবার বিকেল ৫টা এবং ছাত্রীদের বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে আবাসিক হল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা সে নির্দেশ মানেননি।
আবু সাঈদের দাফন
পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে ১৭ জুলাই পীরগঞ্জে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। তার প্রথম জানাজা হয় সকাল সোয়া ৯টায়; বাড়ির পাশের জাফরপাড়া কামিল মাদ্রাসা মাঠে।
এরপর প্রায় সাড়ে ৯টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কিছু শিক্ষক–শিক্ষার্থী এলে দ্বিতীয় জানাজা হয়। পরে সোয়া ১০টার দিকে আবু সাঈদের লাশ দাফন করা হয়। এছাড়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয় দুপুরে।
বিভাগীয় শহরগুলোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ
এদিন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের সিটি করপোরেশনের এলাকাভুক্ত সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো পরিচালিত লার্নিং সেন্টারগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কীভাবে তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ অনুসারে চালিত ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে—সমালোচনা ওঠে তা নিয়েও।
পল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া
ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আহত হন অনেকে। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সেখানে জড়ো হয়েছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা।
এদিন দুপুর দেড়টার দিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় গায়েবানা জানাজার পর দেওয়া বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপি সরাসরি জড়িত নয়। তবে এ আন্দোলনে বিএনপির নৈতিক সমর্থন রয়েছে।'
কমপ্লিট শাটডাউন, শিক্ষার্থীদের পাশের দাঁড়ানোর আকুতি
১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেজ ডুজারিক বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা মৌলিক মানবাধিকার। বাংলাদেশ সরকারের উচিত মানুষের এ অধিকার নিশ্চিত করা।'
এদিনই বিকেলে পরের দিন বৃহস্পতিবার সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
এক ফেসবুক পোস্টে এই কর্মসূচি প্রসঙ্গে আসিফ বলেন, 'শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, সোয়াটের ন্যাক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত ও এক দফা দাবিতে আগামীকাল ১৮ জুলাই সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করছি।'
এতে আরও বলা হয়, শুধুমাত্র হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ব্যতীত কোনো প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলবে না, অ্যাম্বুলেন্স ব্যতীত সড়কে কোনো গাড়িও চলবে না।
এছাড়া অভিভাবকদের উদ্দেশ্য করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ তখন বলেন, 'আমরা আপনাদেরই সন্তান। আমাদের পাশে দাঁড়ান, রক্ষা করুন। এই লড়াইটা শুধু ছাত্রদের না, দলমত নির্বিশেষে এ দেশের আপামর জনসাধারণের।'
Comments