জুলাই ১৯: নিপীড়ন আরও নির্মম, লাশের পাহাড়, কারফিউ

রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় বিজিবির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই তোলা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

আগের দিন ১৮ জুলাই দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ও গুলিতে শতাধিক প্রাণহানির পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন ১৯ জুলাই বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকার সমর্থকদের নিপীড়ন আরও নির্মম হয়ে ওঠে।

এদিন শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে করে মিনিটে মিনিটে সাইরেন বাজিয়ে আসতে থাকে গুলিবিদ্ধ মানুষ। অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াও রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে আনা হয় অনেক আহত-নিহত বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষকে।

গুলিবিদ্ধদের ভেতর নারী-শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীরাই ছিলেন। ঢাকার অনেক বেসরকারি হাসপাতালেও ছিল একই দৃশ্য। অনেক হাসপাতালে আবার আহতদের চিকিৎসার দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয় সরকার সমর্থকরা।

ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও রামপুরায় আগের দিন থেকেই ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা–কর্মী অস্ত্র হাতে মাঠে ছিলেন। ১৯ জুলাইয়েও তাদের গুলিতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হন। ঢাকার সংঘাতপ্রবণ এলাকাগুলোর আকাশে উড়তে থাকে র‌্যাবের হেলিকপ্টার। জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে উপর থেকে ছোড়া হয় সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল। কোথাও কোথাও হেলিকপ্টার থেকে গুলির অভিযোগও আসে।

বিশেষ করে এদিন মিরপুর এলাকার পরিস্থিতি এমন ছিল যে বাসাবাড়িও নিরাপদ ছিল না। এদিনই বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সাফকাত সামির নামে ১১ বছরের এক শিশু। তার মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত করতে বাধা দেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য মো. ইসমাইল হোসেন। পরে পরিবার বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করে।

১৯ জুলাই রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল, পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম ও বিআরটিএ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়। জেলায় জেলায় অসংখ্য সরকারি স্থাপনায় আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।।

বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের খবরও আসে এদিন।

এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বিক্ষোভে এদিনও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে অনেক স্থানীয় লোকজনকে অংশ নিতে দেখা যায়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তার হন এদিন। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় সর্বক্ষেত্রে দেখা যায় স্থবিরতা। রাত ১২টা থেকে শুরু হয় কারফিউ।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, কেবল ১৯ জুলাইয়েই ঢাকাসহ সারাদেশের সহিংসতায় নিহত হন প্রায় ৩০০ মানুষ।

ঢাকায় সব ধরনের সভাসমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ

১৯ জুলাই ঢাকা মহানগর এলাকায় সব ধরনের মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার শফিকুল ইসলাম জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে কিছু সংখ্যক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢুকে পড়ছে এবং জনগণের জান-মালের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। তাই জনগণের জান-মাল রক্ষার্থে ঢাকায় সব ধরনের মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে।

হামলায় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আহত, পিএস নিহত

রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে বিক্ষোভকারীদের হামলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আহত ও তার ব্যক্তিগত সহকারি আতিকুর রহমান নিহত হন।

বিকেলে টঙ্গী থেকে উত্তরার দিকে একটি বহরের সঙ্গে যাচ্ছিলেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর। হামলার পর জাহাঙ্গীরসহ তার ব্যক্তিগত সহকারি ও গানম্যানকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা।

পরে জাহাঙ্গীরকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

নরসিংদী কারাগারে হামলা

১৯ জুলাই বিকেলে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে দখলে নেয় বিক্ষোভকারীরা। এসময় কারাগারটি কারারক্ষীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অন্তত কয়েকশ কয়েদি কারাগার থেকে বের হয়ে যায়।

এর আগে বিক্ষোভকারীরা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও জেলা পরিষদসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায় হামলা চালায়।

মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা

পরদিন শনিবার থেকে মেট্রোরেল চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা আসে।

সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, জননিরাপত্তার স্বার্থে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের এই নির্দেশ বহাল থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুলিশের ওয়েবসাইট হ্যাকড

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং পুলিশের ওয়েবসাইট হ্যাক হয় এদিন। 'দ্য রেজিসটেন্স' নামে একটি গোষ্ঠী এই দুটি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে বলে দাবি করা হয়।

ওয়েবসাইট দুটিতে কালো ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে লেখা বার্তায় বলা হয়, 'শিক্ষার্থী হত্যা বন্ধ করুন'।

রামপুরা থানায় ঘেরাও, বিক্ষোভকারীদের হামলা

বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর রামপুরা থানা ঘেরাও করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংর্ঘষ হয়।

এর আগে দুপুর ২টার পর থেকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রামপুরা থানার সামনে এসে একটি মোটর সাইকেলে আগুন দেয়। ভাঙচুর করা হয় একটি পুলিশ ভ্যান। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ঘটে বিক্ষোভকারীদের। বিকেল চারটার দিকে রামপুরা থানার তিনদিক থেকে ঘেরাও করে আন্দোলনকারীরা। এসময় বেশ কিছু ভবন ভাঙচুর করা হয়।

সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত

টানা দ্বিতীয় দিনের মতো দেশজুড়ে সহিংসতার পর ১৯ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

১৯ জুলাই রাতে গণভবনে ১৪ দলের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত কার্যকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

শুক্রবার মধ্যরাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। বৈঠকে তারা আট দফা দাবি তুলে ধরেন।

ওই বৈঠকে সরকারের তরফে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত উপস্থিত ছিলেন।

পরে শেখ হাসিনার প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া, দুই মন্ত্রীর পদত্যাগসহ নয় দফা দাবি দিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বলা হয়, নয় দফা দাবি না মানা পর্যন্ত শাটডাউন চলবে।

ওই নয় দফা দাবির মধ্যে ছিল—

১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রিপরিষদ ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।

২. ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র শহীদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।

৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে।

৪. যে সকল পুলিশ সদস্য শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ যে সকল সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে এবং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকে আটক করে এবং হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার দেখাতে হবে।

৫. দেশব্যাপী যে সকল শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহীদ ও আহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।

৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগসহ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদকে কার্যকর করতে হবে।

৭. অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলসমূহ খুলে দিতে হবে।

৮. আর যে সকল ছাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের কোনো ধরনের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।

৯. শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Jamaat rally commences at Suhrawardy Udyan

Supporters continued to arrive at the venue in processions, chanting slogans and carrying banners in support of the demands

2h ago