২৪ জুলাই: রাষ্ট্রের বুলেট ‘ছুটি দিলো’ ছোট্ট রিয়া গোপকে, সাংবাদিকদের ‘হাসিনা বন্দনা’

কিছুটা শিথিল হলেও কারফিউ বলবৎ ছিল প্রায় সারাদেশে। ২০২৪ সালের ২৪ জুলাই ছিল টানা কারফিউয়ের পঞ্চম দিন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় 'চিরুনি অভিযান' অব্যাহত রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘোষণা দেন, 'জনমনে স্বস্তি না ফেরা পর্যন্ত কারফিউ চলবে।'
সেইসঙ্গে চলতে থাকে গণগ্রেপ্তার। ২৪ জুলাই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় এক হাজার ৪০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা সাড়ে চার হাজার ছাড়িয়ে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, 'সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।'
পাঁচ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর চব্বিশের ২৪ জুলাই মারা যায় ছয় বছরের ছোট্ট মেয়ে রিয়া গোপ। নারায়ণগঞ্জে বাড়ির ছাদে ছোড়া গুলি শিশুটির মাথায় বিদ্ধ হয়েছিল। রিয়া গোপসহ হাসপাতালে আহত আরও অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয় এদিন।
২৪ জুলাই পর্যন্তও বন্ধ ছিল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ঘোষণা আসে, কারফিউ তুলে না নেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
হাসিনার পাশে থাকার ঘোষণা সাংবাদিকদের
এদিন এডিটরস গিল্ড আয়োজিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বার্তা প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেন, 'জনগণের কল্যাণ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য যে সকল স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে তারা তা ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা সব কাঠামোতে আঘাত করেছে।'
মতবিনিময় সভাটি সঞ্চালনা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন এডিটরস গিল্ডের তৎকালীন সভাপতি মোজাম্মেল হক বাবু। সাংবাদিক আবেদ খান, নঈম নিজাম, মনজুরুল ইসলাম, শ্যামল দত্ত, সাইফুল আলম, ফরিদা ইয়াসমিন, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, দীপ আজাদ, মাইনুল আলম, শাজাহান সরদার, জায়েদুল আহসান পিন্টু, আশীষ সৈকত, জুলফিকার রাসেল, শাকিল আহমেদ, মোল্লা আমজাদ, নাজমুল হক সৈকত, মামুনুর রহমান খানসহ অনেকেই সেখানে বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানটিতে আবেদ খান বলেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস থাকায় তার জন্য যা প্রয়োজন তা করতে পারেন। শ্যামল দত্ত বলেন, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং বিএনপি-জামায়াতের এই বিপর্যয় ও নৃশংসতায় দলের (আওয়ামী লীগ) দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। জায়েদুল আহসান পিন্টু প্রশ্ন রাখেন—গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অফিস রক্ষায় কেন সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজন পড়ল।
অনুষ্ঠানে যখন চলছে হাসিনা বন্দনা, তখন সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে হাজারো মানুষ। পুলিশ, বিজিবি ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের গুলিতে আহত মানুষের চাপ সামলাতে পারছিল না হাসপাতালগুলো। তাদের নির্বিচার গুলিতে আহত ও নিহত হন এমন মানুষও, যাদের সঙ্গে এই বিক্ষোভের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ চক্ষু চিকিৎসা দেওয়া হাসপাতালগুলোতে চোখে গুলি লাগা মানুষের উপচে পড়া ভিড় তৈরি হয়—তাদের বেশিরভাগই ছররা গুলিতে আহত হন। চিকিৎসকরা জানান, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি এক চোখ বা দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।
মোবাইল ইন্টারনেট তখনো বন্ধ
১৯ জুলাই সারা দেশে বন্ধ করে দেওয়া ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ এ দিন পুরোপুরি চালু করা হয়। তবে, বন্ধই থাকে মোবাইল ইন্টারনেট।
ঢাকাসহ তিন জেলায় বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। অন্যান্য জেলায়ও জেলা প্রশাসকদের নির্ধারিত কয়েক ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকে। এদিন সরকারি অফিস ও ব্যাংক চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি রাস্তায় সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও টহল অব্যাহত ছিল।
কারফিউ শিথিল হওয়ায় রাজধানী থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়, তবে যাত্রী ছিল কম। ঢাকা নদীবন্দর থেকে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়। কর্মচাঞ্চল্য ফেরে অফিস-আদালত ও কলকারখানায়। রাজধানীতে ফেরে চেনা যানজট।
ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা দেখানো হলো কূটনীতিকদের
ঢাকার যেসব স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়, তার কয়েকটিতে সরকারের উদ্যোগে বিদেশি কূটনীতিকদের নিয়ে যাওয়া হয়। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, 'মোট ৪৯টি মিশনের প্রতিনিধিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো কয়েকটি স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন। তাদের মধ্যে ২৩ জন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কূটনীতিকদের মেট্রোরেলের ধ্বংসযজ্ঞ, সড়ক ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিটিভি ভবন দেখিয়েছি।'
পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'দুষ্কৃতকারীরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।'
সরকার বিভিন্ন স্থাপনার বিষয়ে কথা বললেও শত শত প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলছে না বলে এদিন মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, 'এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।'
দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি চালানোর ঘোষণা বৈষম্যবিরোধীদের
এদিন, নরসিংদী কারাগার থেকে পালানো ইশরাত জাহান মৌসুমী ও খাদিজা পারভীন মেঘলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়া পালিয়ে যাওয়া কারাবন্দিদের মধ্যে ২১৬ জন আত্মসমর্পণ করেন।
২৪ জুলাই নিজেদের ৯ দফা দাবি আদায়ে ২৫ জুলাই দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি চালানোর ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
পেন্টাগনের প্রতিক্রিয়া, প্রবাসীদের সংহতি
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং তাদের ওপর হামলা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এদিন প্রতিক্রিয়া জানায় মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন। পেন্টাগনের মুখপাত্র মেজর জেনারেল প্যাট রাইডার বলেন, তারা বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নজরে রেখেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, 'দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সরকার যত দিন চাইবে, সেনাবাহিনী তত দিন বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতায় দায়িত্ব পালন করবে।'
স্থগিত থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন ভর্তি পরীক্ষাসহ বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সব পরীক্ষাও।
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। জাপানের টোকিওতে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্র সমাজের উদ্যোগে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বিক্ষোভ করার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫৭ বাংলাদেশিকে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেন দেশটির আদালত।
Comments