সরাসরি গুলির নির্দেশ হাসিনার
২০২৪ সালের ২৭ জুলাই বিকেলে পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত ঢাকার জাতীয় ট্রমাটোলজি ও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন ইনস্টিটিউটের (নিটোর) একটি পডিয়ামের সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন শেখ হাসিনা। আট মিনিটের আবেগঘন বক্তব্যের মধ্যে প্রায় ১৪ সেকেন্ড তিনি কিছুই বলেননি।
তার মুখে বিষণ্নতার ছাপ—যেন ১৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া রক্তপাতের ভার তাকে চেপে ধরেছে। সেদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ, রংপুরের আবু সাঈদসহ প্রাণ হারান ছয়জন।
হাসিনা যখন নিটোরের এই মঞ্চে, তার আগের দুই সপ্তাহে সারা দেশে অন্তত ১৬২ জন নিহত হয়েছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে। দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তাদের অনেকেই নিহত হয়েছেন সামরিক প্রাণঘাতী অস্ত্রের গুলিতে।
হাসপাতালটিতে আহতদের দেখতে গিয়ে ৭৭ বছর বয়সী হাসিনা বলে ওঠেন, দেশবাসীর কাছে বিচার চাই। আমি কী অপরাধ করেছি যে এই শাস্তি পাচ্ছি?
তিনি বলেন, আমি চাই না কোনো মা এভাবে তার সন্তান হারাক। আমি আমার মা-বাবাকে হারিয়েছি, স্বজন হারানোর ব্যথা আমি জানি। এতো মানুষ প্রাণ হারাল, এতো পরিবার ধ্বংস হলো। এর দায় কার? আমি শুধু দেখি আর...।
কথা অসমাপ্ত রেখেই কাঁদতে কাঁদতে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে যান।
অথচ, হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়া সেই আবেগঘন বক্তব্যের আড়ালে যা হচ্ছিল, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরইমধ্যেই রাষ্ট্রীয় হত্যাযন্ত্র চালু হয়ে গিয়েছিল বলে উঠে এসেছে দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে।
এই ঘটনার মাত্র নয়দিন আগে—২০২৪ সালের ১৮ জুলাই রাতে—প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে একটি ফোনকল আসে। রিসিভ করেন হাসিনা। অপর প্রান্তে ছিলেন তৎকালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সেই আলাপন ছিল এক ভয়ানক পরিকল্পনার ইঙ্গিত।
ভাতিজা তাপসকে হাসিনা বলেন, 'এখন তো আমরা অন্যভাবে করছি। ড্রোন দিয়ে ছবি নিচ্ছি, হেলিকপ্টার কয়েক জায়গায়…।'
তাপস বারবার গণগ্রেপ্তারের ওপর জোর দিতে থাকলে হাসিনা বলেন, 'সবগুলোকে অ্যারেস্ট করতে বলেছি রাত্রে। ওটা বলা হয়ে গেছে।'
'যেখানেই গ্যাদারিং দেখবে, সেখানেই উপর থেকে… এখন উপর থেকে করাচ্ছি। শুরু হয়েছে কয়েকটা জায়গায়,' বলেন হাসিনা।
মোহাম্মদপুর এলাকার দিকে আন্দোলনকারীদের বিষয়ে উল্লেখ করে তাপস হাসিনার নির্দেশ চাইলে তিনি বলেন, 'আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি এখন। এখন লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। সেখানেই পাবে সোজা গুলি করবে। এটা বলা আছে।'
জবাবে তাপস 'জ্বী, জ্বী' বলতে থাকেন।
পরদিন—১৯ জুলাই—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একই ঘোষণা দেন। যদিও তিনি হাসিনার নাম নেননি। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কাদের বলেন, সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। কারফিউ ও দেখামাত্র গুলির আদেশ দেওয়া হয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারের কাছে হাসিনা ও তাপসের মধ্যকার একটি কল রেকর্ডিং রয়েছে। মার্চ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডগুলোর একটি এটি। হাসিনার বেশকিছু কল রেকর্ড করেছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। এই অডিওর কিছু অংশ এর আগে বিবিসি যাচাই করে প্রকাশ করে।
কল রেকর্ড যাচাই
দ্য ডেইলি স্টার নিজস্ব যাচাইয়ের পাশাপাশি কল রেকর্ডটি প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটকে (টিজিআই) দেয়। প্রতিষ্ঠানটির ফরেনসিক বিভাগ জুলাই আন্দোলনের ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহে কাজ করছে।
টিজিআই একাধিক স্তরে ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করেছে যে, অডিওটি বানানো হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। শব্দের উচ্চতা, স্বর, তাল, টান ও নিঃশ্বাস বিশ্লেষণে কোনো ধরনের কৃত্রিমতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা ভয়েসের বায়োমেট্রিক পরীক্ষা করে প্রত্যেক স্পিকারের ভয়েসপ্রিন্ট মেলায়, যা প্রকাশ্যে আসা অন্যান্য অডিওর সঙ্গেও মিলিয়ে দেখেছে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, কথোপকথনটি শেখ হাসিনা ও শেখ ফজলে নূর তাপসের বলেই প্রতীয়মাণ হয়।

দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব যাচাই
দ্য ডেইলি স্টার এমন কিছু নথি সংগ্রহ করেছে যেখান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, কলটি ১৮ জুলাই করা হয়েছিল এবং যে নম্বরে কলটি গিয়েছিল সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিবন্ধিত। ২০১৯ সাল থেকে হাসিনা নম্বরটি ব্যবহার করেছেন, এমনকি বিদেশ সফরের সময়ও।
তাপসের নম্বরও সরকারি নথিপত্র—যেমন: পিআইডি টেলিফোন গাইড ২০২১, বাংলাদেশ সচিবালয় টেলিফোন গাইড ২০২৩, ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, টেলিফোন গাইড ২০২৫—থেকে যাচাই করা হয়েছে। আরও কিছু গোপন নথি থেকেও এটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
যাচাইকালে উভয় নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।

আন্দোলন দমনে নির্মম দমন-পীড়ন চালানোয় হাসিনা সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি ফাঁস হওয়া এই কল রেকর্ডের মাধ্যমে নতুন করে আলামত হিসেবে উঠে এসেছে। এখানে তিনি স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে বিরোধী মত দমন করতে হবে, এমনকি এর জন্য যদি নিরপরাধ মানুষকেও হত্যা করতেও হয়, তা হলেও।
মাসব্যাপী অনুসন্ধানে দ্য ডেইলি স্টার এমন কিছু প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে, যা আর কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলির সরকারি হিসাব, যাচাইকৃত ছবি ও ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, পত্রিকার প্রতিবেদন এবং বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে যে, হাসিনার নির্দেশই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব হিসাবে দেখা যায়, আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই থেকে ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ থেকে ৬৬ হয়ে যায়। হাসিনার নির্দেশের তাৎক্ষণিক প্রভাব এই সংখ্যা থেকেও স্পষ্ট হয়।
অনেকে একটি গুলিতেই প্রাণ হারান, এমনকি উঁচু ভবনের ছাদ বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে নিহত হন—যা ধারণা দেয় যে, তারা অল্প উচ্চতা দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া প্রাণঘাতী বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছেন।
আমাদের অনুসন্ধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ প্রকাশিত তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের, যেখানে আওয়ামী লীগ সরকার, দলটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ উঠে এসেছে।

এই কল রেকর্ডিং বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার জানতে চাইলে হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বলেন, 'বিষয়টি বিচারাধীন। এখন এটা নিয়ে মন্তব্য করার উপযুক্ত সময় না।'
টেলিফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, 'এটা এখন আদালতের বিষয়। যদি এমন কোনো নথি আদালতে উপস্থাপন করা হয়, তখন দেখব। এই মুহূর্তে আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।'
হাসিনা ও তাপসের কল রেকর্ডিংটির বিষয়ে জানতে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে টেলিফোনে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও তাপস স্বীকার না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অডিও অথেনটিক বলে প্রমাণ হয় না। এটা বানোয়াট, অত্যাধুনিক এআই-নির্ভর ও ফরমায়েশি।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিচারের আগেই রায় ঘোষণার দুরভিসন্ধি থেকে এটা করা হয়েছে।'
তাপসের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন।

ভয়ংকর আকাশ
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা কিছু সরকারি নথি থেকে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই দুপুর ২টা ১০ মিনিটে প্রথম কয়েকটি হেলিকপ্টার ওড়ে। এ সময়কাল থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তাপসের সঙ্গে ফোনকলের আগে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে এই নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হয় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করতে—যারা ওই দিন ঢাকার বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আটকে পড়েন।
নথি বলছে, মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য হেলিকপ্টারগুলো ১৮ জুলাই রাত ১১টা পর্যন্ত প্রায় সাত ঘণ্টা বিভিন্ন এলাকার ওপর চক্কর দিতে থাকে।
পরবর্তী চারদিন, অর্থাৎ ২২ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হেলিকপ্টার গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকার আকাশে ওড়ে। এসব হেলিকপ্টারে থাকা র্যাবসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গ্যাসগান, স্টান গ্রেনেড ছাড়াও ব্যবহার করেন প্রাণঘাতী অস্ত্র—যার মধ্যে ছিল শটগান ও এসএমজি। অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো ছিল ৭.৬২ মিমি টাইপ ৫৬ এসএমজি।
পুরো রাজধানী থেকে আসতে শুরু করে ভয়ংকর সব খবর। নিজ ঘরের ভেতরেই মারা যাচ্ছিল মানুষ।
দ্য ডেইলি স্টার তিনটি ঘটনার তদন্ত করেছে—যেখানে রাজধানীর ধানমন্ডি ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ১৯ ও ২০ জুলাইয়ের সহিংসতার মধ্যে মোট তিনজন নিহত ও দুজন আহত হন। এর একটি ঘটনায় এক নারী তার ছয়তলার বারান্দায়, আরেকটিতে দুজন চতুর্থতলার বারান্দায় এবং তৃতীয় ঘটনায় দুজন দশতলা ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা ৭.৬২ মিমি গুলিতে আহত হন, যেগুলো টাইপ ৫৬ ধাঁচের সেমি-অটোমেটিক রাইফেল অথবা স্বয়ংক্রিয় এসএমজি থেকে ছোঁড়া হয়। বুলেটগুলোর ছবি দেখে বিশেষজ্ঞরা এমনটাই জানিয়েছেন।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেঁচে ফেরা ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় তাদের ভবনের আশেপাশে অনেক নিচু দিয়ে তারা হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন এবং ওই সময় আশপাশের এলাকায় কোনো সংঘর্ষ হয়নি। এর থেকে বোঝা যায়, গুলিগুলো ভূমি থেকে কেউ চালায়নি।
'আমি ভয়ে দৌড় দেই'

ঘটনার এক বছর পরও ভয়াবহ ট্রমা বয়ে বেড়াচ্ছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আইমান উদ্দিন।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই বিকেলে তিনি ছিলেন তাদের দশতলা ভবনের ছাদে। তখনই একটি 'সাদা ড্রোন' ও একটি হেলিকপ্টার নিচু দিয়ে তাদের ভবন ও মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের আশেপাশে উড়ছিল।
জুলাইয়ের শুরুর দিকে দ্য ডেইলি স্টারকে আইমান বলেন, 'হঠাৎ একটা গুলি আমার বুকের ডান দিকে ঢুকে পিঠের দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি ভয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দেই। দৌড়াতে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি, আমার খালা মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন।'
তার খালা নাসিমা আক্তারের চোখের নিচে গুলি লাগে। গুলি গিয়ে ঢুকে পড়ে গলায়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গুলি বের করা হলেও পরদিনই তিনি মারা যান।
আইমান ও নাসিমা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই জায়গা দুটি মেপেছে দ্য ডেইলি স্টার। দুজনের দূরত্ব ছিল ১৮ ফুট এবং দুজনই একটি বুলেটের নিশানার মধ্যেই ছিলেন।
কোন তলার কোন অবস্থানে ছিলেন, গুলির দিক ও প্রকৃতি, অন্তত ১৫ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান এবং বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পরিচালিত আমাদের অনুসন্ধান প্রমাণ করে যে, এই গুলিগুলোর কোনোটিই ভূমি থেকে চালানো হয়নি।

যদিও হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতেই তারা আহত হয়েছেন, সরাসরি এমন কোনো প্রমাণ দ্য ডেইলি স্টার পায়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরাও এর সঙ্গে একমত যে, গুলির মুহূর্তগুলোতে কাছাকাছি নিচু দিয়ে উড়ছিল হেলিকপ্টার।
দ্য ডেইলি স্টার এই তিনটি ঘটনার বুলেটের ছবি, ঘটনাস্থল ও তার আশেপাশের ভিডিও ও ছবি সংগ্রহ করেছে গুলির গতিপথ ও আঘাতের কোণ বুঝতে। এ ছাড়া, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে হেলিকপ্টারের ভিডিও ও ছবিও সংগ্রহ করা হয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টার এসব অডিও-ভিডিও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটকে দেয় এবং তাদের ফরেনসিক বিশ্লেষণ নিশ্চিত করে, হেলিকপ্টারগুলো যেসব এলাকায় ঘুরছিল সেগুলোর অবস্থান নারায়ণগঞ্জের সানজিদা আক্তারের ভবনের আশেপাশেও ছিল। যদিও তারাও এটা নিশ্চিত করতে পারেনি যে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল কি না।
আমরা এই গুলির ছবি ও ঘটনাস্থলের ভিডিও একজন অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাকে দেখাই। তিনি একজন অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ।
সেগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ৭.৬২ মিমি বুলেট। এগুলো সাধারণত ৭.৬২ মিমি সেমি-অটোমেটিক চায়নিজ রাইফেল বা ৭.৬২ মিমি স্বয়ংক্রিয় এসএমজি (একে ভ্যারিয়েন্ট) থেকে ছোড়া হয়।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'এই তিনটি ঘটনায় গুলির গতিপথ ও আঘাতের স্থান দেখে বোঝা যায়, সেগুলো নিচ থেকে ছোড়া হয়নি। এগুলো আশেপাশের অন্য কোনো ভবন বা সমান উচ্চতার অন্য কোনো তলা থেকেও ছোড়া হতে পারে। কিংবা, ৩০০-৪০০ মিটার দূরে নিচু দিয়ে উড়তে থাকা হেলিকপ্টার থেকেও ছোড়া হয়ে থাকতে পারে।'
'এসএমজি বা ৭.৬২ মিমি একে-ধাঁচের চায়নিজ রাইফেল থেকে ছোড়া গুলি যদি কোনো বাধা না পায়, তাহলে প্রায় দেড় হাজার মিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। মানুষের শরীরে এই বুলেটের আঘাত মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।'

দ্য ডেইলি স্টারের যাচাইকৃত নথি থেকে দেখা যায়, ১৯ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিদিন র্যাবের হেলিকপ্টারগুলো এসএমজিসহ অন্যান্য অস্ত্র বহন করেছে—১৯ জুলাই চারটি এবং পরবর্তী দুদিনে প্রতিদিন একটি করে। প্রতিদিন তারা এসএমজির জন্য ৬০ রাউন্ড গুলি বহন করেছে।
আন্দোলনের সময় এবং দ্য ডেইলি স্টার যেসব সরকারি নথি পেয়েছে, সেখানে র্যাব দাবি করেছে যে তারা হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালায়নি। তবে তারা এটা স্বীকার করেছে, ১৯ থেকে ২১ জুলাই তারা হেলিকপ্টার থেকে ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড ও ৯৮৫টি টিয়ার শেল ছুঁড়েছে।
এর আগে নেত্র নিউজের একটি অনুসন্ধানে উঠে আসে, ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে স্টান গ্রেনেডের কারণে। অভিযোগ রয়েছে, সেটি ফেলা হয়েছিল হেলিকপ্টার থেকেই।
মানুষ হত্যার যত আয়োজন
আন্দোলনের দমনে রাজপথে মোতায়েন করা হয় হাজারো প্রাণঘাতী অস্ত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধানত স্টান গ্রেনেড ও গ্যাসগানের মতো প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার করত। কিন্তু, ১৯ জুলাই থেকে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। হাসিনার সেই কল রেকর্ডে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে যা মিলে যায়।

ওই ফোনালাপের পরপর যেসব ঘটনা ঘটে, তা ইঙ্গিত দেয়, আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্রয়োজনীয় অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
দ্য ডেইলি স্টারের ফটোসাংবাদিক এবং টিভি ফুটেজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া ১৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের ২০টি যাচাইকৃত ছবি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সামরিক মানের অস্ত্রে সজ্জিত ছিল।
দুজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করেছেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে থাকা এমন অস্ত্রের মধ্যে ছিল স্বয়ংক্রিয় ও আধা-স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, লাইট মেশিনগান, মেশিনগান, বাংলাদেশে নির্মিত বিডি-০৮ টাইপ ৮১ অ্যাসল্ট রাইফেল, চীনে তৈরি আধা-স্বয়ংক্রিয় ৭.৬২ মিমি টাইপ ৫৬ অ্যাসল্ট রাইফেল ও হ্যান্ডগান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আন্তর্জাতিক সামরিক বিশেষজ্ঞ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই অস্ত্রগুলো সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের ওপর এগুলোর ব্যবহার একেবারেই অযৌক্তিক।'

১০ জনেরও বেশি নিহত মানুষের আঘাতের ধরন ও মৃত্যুর কারণ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, তারা প্রাণঘাতী ভারী অস্ত্রের গুলির আঘাতে মারা গেছেন। এসব অস্ত্র জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, বরং হত্যার জন্য তৈরি।
প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সঙ্গে নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টারের তদন্তে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ছিল ওই মাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন। মাত্র একদিনেই অন্তত ৬৬ জন নিহত হন। এর পরের দিন হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাণহানি। এ দিন অন্তত ৩০ জন গুলিতে নিহত হন। (এই পরিসংখ্যান দ্য ডেইলি স্টারের রিয়েল-টাইম টালির ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রতিবেদন ও প্রাক্কলনের সঙ্গে এটি না-ও মিলতে পারে।)
১৯ ও ২০ জুলাই, এই দুইদিনে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক ও ফটোসাংবাদিকরা এসব এলাকায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তার ছবি তুলেছেন।

এক গুলি, এক মৃত্যু
১৮ জুলাই রাতে হাসিনা তার ভাতিজা তাপসকে জানালেন, তিনি দেখামাত্র গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। পরদিন, ১৯ জুলাই সকালে রামপুরা ওয়াপদা রোডের মুখে বিক্ষোভকারীদের একটি ছোট্ট দলে ছিলেন রমজান হোসেন। তিনি কোনো ধরনের দৃশ্যমান হুমকি তৈরি করেননি। তার হাতে কোনো লাঠি ছিল না, কিংবা তিনি ইট-পাটকেলও ছুড়ছিলেন না।
সেদিন সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে একটি গুলির শব্দ শোনা যায়। এরপরই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ২৪ বছর বয়সী রমজান। তার গলায় ঢুকে যায় একটি গুলি।
এই ঘটনাটি ধরা পড়ে স্থান ও সময় নির্ভর জিও-ক্রোনোলজিক্যাল ভিডিও ফুটেজে। দ্য ডেইলি স্টার ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট যৌথভাবে এর ফরেনসিক বিশ্লেষণ করেছে।
ভিডিওতে রমজানের মৃত্যুর আগে ও পরের দৃশ্য দেখা যায়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিছিলে তার সঙ্গে থাকা বাকিরা রমজানের দেহ দ্রুত টেনে সরিয়ে নেন। রাস্তায় পড়ে থাকে রক্তের দাগ।
সেইসঙ্গে ভিডিওতে এক নারীর উদ্বেগজড়িত কণ্ঠ শোনা যায়, 'আল্লাহ, ইশ্, মারা গেছে। এটা কেন করলো? কেমনে এইম কইরা ছেলেটারে মারলো!'
দ্য ডেইলি স্টার ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের যৌথ তদন্তে দেখা যায়, রমজানকে গুলি করা হয়েছিল তার সামনের দিক থেকে, যেখানে বিজিবির ২৭ সদস্যের একটি দল অবস্থান করছিল।
এই বাহিনীর অন্তত ১৮ জন সদস্য চীনে নির্মিত টাইপ ৫৬ ও টাইপ ৫৬-১ অ্যাসল্ট রাইফেল বহন করছিলেন। বাংলাদেশে এসব অস্ত্রে অপ্রাণঘাতী কার্তুজের ব্যবহার হয় না। অর্থাৎ, এগুলো সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র।
ভিডিও বিশ্লেষণ ও রমজানের গলায় গুলির ক্ষত বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, গুলিটি উচ্চগতির রাইফেল থেকেই ছোড়া হয়েছিল, যেমন অস্ত্র ওই বিজিবি সদস্যদের কাছে ছিল।

ভিডিও ফুটেজের আরও নিবিড় বিশ্লেষণ এবং একজন আন্তর্জাতিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞের মতামত থেকে বোঝা যায়, এই অস্ত্র ব্যবহারকারীরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন।
রমজান হত্যার ফুটেজ দেখে একজন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এই গুলির ঘটনা মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন। এই আন্দোলনের সময় এমন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কোনো ন্যায্য যুক্তি নেই।'
কিন্তু, রমজানের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। তার মতোই মারণাস্ত্রের শিকার হয়েছেন আরও বহু মানুষ।
গুলিবিদ্ধ ২০৪ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পায়, এর মধ্যে ১৯৫ জন বা ৯৫ শতাংশই মারণাস্ত্র থেকে ছোঁড়া গুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এই ১৯৫ জনের মধ্যে ১১৩ জন প্রাণঘাতী গুলির আঘাতে মারা যান এবং তাদের মাথা, বুক, পেট ও তলপেটে গুলি লাগে। এই অঙ্গগুলোতে একটি মাত্র গুলি লাগলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যু ঘটাতে পারে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান বলেন, 'এই আন্দোলনে যেসব মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো পরিচালনার জন্য দুই ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রথমত, কারিগরি দক্ষতা—অস্ত্র কীভাবে চালাতে হয়, তা শেখা। দ্বিতীয়ত, নৈতিক প্রশিক্ষণ—যার মাধ্যমে শেখানো হয় যে কখন, কোথায়, কীভাবে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'এসব অস্ত্র ব্যবহারে সবচেয়ে কঠিন প্রশিক্ষণ হলো, ট্রিগারে আঙুল কতটা চাপে রাখতে হবে, সেটা। একজন সেনার এমনভাবে প্রশিক্ষিত হতে হয়, যাতে ট্রিগারে অতিরিক্ত চাপ না পড়ে যায়।'
এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'পুলিশ ও আনসার বাহিনীর অনেক সদস্য হয়তো তাদের কর্মজীবনের শুরুতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কিন্তু তারা কখনো দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টা শেখেননি—যা এই মৃত্যুর সংখ্যা দেখলেই স্পষ্ট হচ্ছে।'
সংঘর্ষ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এর অর্থ হচ্ছে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি উচ্চপদস্থ কমান্ড থেকে এসেছে। এ ধরনের নির্দেশ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা সম্ভব হতো না।'
আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর বিষয়ে কোনও লিখিত আদেশ এখনো খুঁজে পায়নি দ্য ডেইলি স্টার। তবে, হাসিনা ও তাপসের ১৮ জুলাইয়ের এই ফোনালাপ একটি উদাহরণ যে, কীভাবে এবং কার কাছ থেকে আন্দোলন দমনে সরাসরি গুলির আদেশ এসেছে।
এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মাশফিক মিজান, কিরো আদনান আহমেদ, মাহমুদুল হাসান, সৌরভ হোসেন সিয়াম ও সহিদুল ইসলাম নিরব; ডেটা: মুহাম্মদ ইমরান; গ্রাফিক্স: আনোয়ার সোহেল
Comments