সার্ভিল্যান্স সত্ত্বেও শেয়ারবাজারে কারসাজি চলছেই
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে একটি সাধারণ দৃশ্য হলো বাজারের সূচক বাড়ুক বা কমুক স্বল্প মূলধনী ও নিম্ন মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারগুলো প্রায়ই শীর্ষ দরবৃদ্ধির তালিকায় উঠে আসে।
কিছু কোম্পানি যারা বছরের পর বছর ধরে লোকসানে রয়েছে এবং তাদের বিনিয়োগকারীদের এক পয়সাও লভ্যাংশ দিতে পারছে না, এসব কোম্পানির শেয়ারগুলোও গত ৩ মাসে ২ গুণ বা তার বেশি বেড়েছে। এমনকি এসময় বাজারের সূচক ছিল নিম্নমুখী।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো কোম্পানিগুলো বারবার জানিয়েছে যে তাদের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোনো কারণ নেই তবুও, তাদের স্টক আকাশচুম্বী হতে থাকে।
সাধারণত যখন কোনো শেয়ারের দামের কারসাজির হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয় তখন শেয়ারের মূল্য কমে যায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এর চূড়ান্ত শিকার হন। এরপরও, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা রাতারাতি লাভের জন্য কারসাজি হয় এমন শেয়ারের পেছনে ছুটে যান। তাদের যুক্তি হচ্ছে ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা করা যায় না।
এদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এই কারসাজির পেছনে ছোটার প্রবণতা কারসাজিকারীদের কাজ সহজ করে দেয় তাদের অতিমূল্যায়িত শেয়ারগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, বাজার বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ব্যবহৃত উচ্চ-মূল্যের সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যারটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
বিএসইসি- এর সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, সফটওয়্যারটি অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে আনা হয়েছিল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে স্টক ম্যানিপুলেশন বন্ধ করতে কার্যকর হবে বলেই আনা হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের উদ্যোগ খুব কমই দেখা গেছে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কারসাজির কারণে ছোট কোম্পানির স্টক বহুগুণ বাড়তে থাকলেও প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।
অনেক সময় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোর ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি যখন বিএসইসি কিছু ম্যানিপুলেটরদের ওপর জরিমানা আরোপ করেছে সেগুলো তাদের অপরাধ বিবেচনায় খুবই অপ্রতুল।
সম্প্রতি স্টক মার্কেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আবুল খায়ের হিরু এবং তার সহযোগীদের ৫ দশমিক ২৫ কোটি টাকা জরিমানা করেছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজি করে ৬৮ কোটি টাকারও বেশি টাকা কামানোর জন্য।
'যখন একজন অপরাধী পর্যাপ্ত শাস্তির সম্মুখীন না হন, তখন তারা আরও বেশি কারসাজি করতে উৎসাহিত বোধ করেন। সুতরাং তাদেরকে আরও কঠিন শাস্তির আওতায় আনা উচিত।'
গত জুনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা গেছে এটি স্টক ম্যানিপুলেশন স্কিমে অংশগ্রহণকারী প্রায় ১৬ জন লোককে যারা ৩৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি অবৈধ মুনাফা অর্জন করেছে তাদেরকে যৌথভাবে ৭৫ মিলিয়নের ডলারেরও বেশি জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ইমেজ ইতোমধ্যেই ম্যানিপুলেশন শব্দের সঙ্গে মিশে গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাজারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
'আর এটি রোড শো আয়োজন করেও ঠিক করা যাবে না,' তিনি বলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, বিএসইসির একজন সাবেক কমিশনার বলেন, বিএসইসি ক্রমাগত বাজারের সূচক বাড়ানোর চেষ্টা করছে সেটি প্রয়োজনে কারসাজিকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় হলেও। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সম্প্রতি একজন পরিচিত কারসাজিকারীকে বড় বিনিয়োগকারী হিসাবে ঘোষণা দিয়ে তার পক্ষে সাফাই গেয়েছে। অথচ বিএসইসি নিজেই তাকে জরিমানা করেছে কারসাজির জন্য।
'এটি বর্তমান বাজারের নিষ্ঠুর বাস্তবতা।'
যদিও ম্যানিপুলেটররা সাময়িকভাবে সূচক বাড়াতে পারে, তাদের কার্যক্রম সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসাবে এবং বাজারে আস্থা নষ্ট করবে, দীর্ঘমেয়াদে এটিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
'সুতরাং, বিএসইসির উচিত এদের সাহায্যে সূচক বাড়ানোর এই মানসিকতা ত্যাগ করা,' তিনি যোগ করেন।
এই সমস্ত উদ্বেগের জবাবে, বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, যখন একজন বিনিয়োগকারী বড় অংকের শেয়ার কিনবেন, তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারবেন না এটা কোনো কারসাজির চেষ্টা কিনা।
'সুতরাং, আমাদের অপেক্ষা করতে হয় এবং দেখতে হয় তারা কোনো অসৎ আচরণ বা আইনের লঙ্ঘন করছে কিনা,' তিনি যোগ করেন।
করিম আরও বলেন, সিরিয়াল ট্রেডিং এবং ইনসাইডার ট্রেডিং শনাক্ত করতে, বিএসইসিকে এমনকি কয়েক মাসও অপেক্ষা করতে হয় কারণ প্রক্রিয়াটি দ্রুত করতে গেলে সৎ বিনিয়োগকারীরাও হয়রানির শিকার হতে পারেন।
একটি প্রশ্নের উত্তরে, করিম বলেন, সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার থেকে প্রতিদিন শত শত সতর্কতা আসে। সার্ভিল্যান্স টিম যদি প্রতিটিকে যাচাই-বাছাই করে, তাহলে এখানে আরও অনেক বেশি লোকবল দরকার হবে।
এমনকি যদি বিএসইসি কোনো লেনদেনে ত্রুটির যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ খুঁজে পায়, তাহলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হয়, যাদেরকে কমপক্ষে ১৫ দিন সময় দিতে হয়।
তদন্ত দল তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে, নথিগুলো যাচাই করা প্রয়োজন হয় এবং শুনানি করতে হয় আরও অনেক পদ্ধতি শেষ করে তবেই উদ্যোগ নেওয়া যায়।
হালকা শাস্তি আরোপের বিষয়ে করিম বলেন, কমিশন অপরাধের ভিত্তিতে শাস্তি আরোপ করে। কেন কম শাস্তি দেওয়া হয়, সে বিষয়ে তিনি এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Comments