ডিমের বাজারে বাড়ছে করপোরেট বিনিয়োগ, শঙ্কায় ছোট খামারিরা

একটা সময় দেশের ডিমের বাজার ছিল মূলত কয়েক হাজার ছোট খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতে। তবে এই খাতে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বড় পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা আসায় গত কয়েক বছর ধরে বাজারের চিত্র বদলে যাচ্ছে। ডিমের বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ছোট খামারিদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ডিম উৎপাদনে বড় ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের কারণে ছোট খামারিদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই বিশ্লেষকরা বাজার ব্যবস্থাপনা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করা ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় খাদ্য ও প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কথাই ধরা যাক। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর সময় প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার পিস ডিম উত্পাদন করেছিল।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বর্তমানে তারা প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ পিস ডিম উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।

তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, নগরায়ণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় ডিমের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এ কারণেই আমরা এই খাতে বিনিয়োগ করেছি।'

একইভাবে, ২০১২ সালে লেয়ার পোল্ট্রি ফার্মিংয়ে আসা ডায়মন্ড এগ লিমিটেড এখন প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ডিম উত্পাদন করছে। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ৩ লাখ পিস ডিম উৎপাদন করতো।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ও ডায়মন্ড এগ লিমিটেডের পাশাপাশি পোল্ট্রি শিল্পের বড় প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস, প্যারাগন গ্রুপ ও ওষুধ প্রস্তুতকারক রেনাটার সহযোগী প্রতিষ্ঠান পূর্ণাভা লিমিটেডসহ প্রায় ২০টি বড় প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত ডিম বাজারে বিক্রি করছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিম বিক্রির কোনো হিসাব পাওয়া যায় না।

ডিম ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা ডেইলি স্টারকে জানান, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ডিমের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগই ছোট খামারিরা সরবরাহ করে থাকেন।

কিন্তু দিন দিন, বাজারে ব্র্যান্ডের ডিমের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

ঢাকার ৪টি সুপারমার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডের ডিম প্রতি ডজনে নন-ব্যান্ড ডিমের তুলনায় অন্তত ২৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

কাজী ফার্মস গ্রুপের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, ব্র্যান্ডের বাইরে বেশিরভাগ ডিম ছোট খামারিরা উৎপাদন করেন।

তিনি বলেন, 'কিছু ভোক্তা ব্র্যান্ডের ডিম কেনেন। কারণ, তারা চান নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কেনা পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করবে।'

ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে কাজী ফার্মস এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে বলে জানান তিনি।

ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেনাটার পশুস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক মো. সিরাজুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্রেতাদের চাহিদার কারণে আমরা ওমেগা-৩, ভিটামিন ই ও ভিটামিন বি৯ সমৃদ্ধ ডিম উৎপাদন করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় এ ধরনের ডিমের দাম স্বাভাবিক ডিমের তুলনায় বেশি।'

অন্যদিকে, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খন্দকার মো. মহসিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারায় গত ৩/৪ বছরে অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।'

'করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই শূন্যতা পূরণ করছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'গত দেড় দশকে পোল্ট্রি খাতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। এতে উৎপাদন বাড়লেও বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে।'

তিনি মনে করেন, করপোরেটরা যেভাবে ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করছে, তাতে এমন সময় আসবে যখন উত্পাদক ও ভোক্তার মধ্যে সরবরাহ শৃঙ্খলে কেউ থাকবে না। শুধু খুচরা বিক্রেতারা থাকবেন।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার এই খামারি ডেইলি স্টারকে জানান, স্থানীয় বড় পাইকাররা তার কাছ থেকে ডিম নেন। কিন্তু গত ২ বছরে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং মুনাফা কমে যাওয়ায় তিনি ডিম উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন।

ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের গ্রাহকদের একটি অংশ প্যাকেটজাত ডিমের দিকে ঝুঁকছেন। এটি তাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তিনি আরও জানান, এক দশক আগেও তেজগাঁওয়ের পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ ডিম কেনা-বেচা করতেন। এই সংখ্যা এখন প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজারে নেমে এসেছে। প্রায় ২ দশক আগে ডিম ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ১২০ জন। এখন তা কমে প্রায় ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে।

আমানত উল্লাহ বলেন, 'করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ডিম উত্পাদন করে এবং সুসংগঠিত উপায়ে সরবরাহ শৃঙ্খল পরিচালনা করে আমরা তা ধরে রাখতে পারিনি। এ জন্য বাজারের একটি অংশ হারিয়েছি।'

প্রাণ-আরএফএলের কামরুজ্জামান কামালের মতে, প্রান্তিক খামারিদের দাবি সঠিক নয়।

তিনি বলেন, 'চাহিদা অনুযায়ী ক্রেতাদের পণ্য দেওয়ার সক্ষমতা থাকায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মতো সংগঠিত সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া প্রান্তিক খামারিদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে খামারিদের মুনাফা কমে গেছে। অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না।'

রাহমানিয়া অর্গানিক এগ্রোর চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান যে, ২০১১ সালের দিকে তারা এই ব্যবসায় আসার পর বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠান দেশে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার বাক্স অর্গানিক ডিম বিক্রি করছে।

২০১১ সালে এর সংখ্যা ছিল ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার বাক্স।

তিনি বলেন, 'নন-ব্যান্ড ডিমের বেলায় ক্রেতারা জানেন না কখন ডিম উৎপাদিত হয় এবং তা কতদিন ঠিক থাকে। তবে প্যাকেটজাত অর্গানিক ডিমের ক্ষেত্রে এসব তথ্য বাক্সের গায়ে লিখে দেওয়া হয়।'

যা বলছেন বিশ্লেষকরা

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারুল হক বেগ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিমের বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি বিনিয়োগ করছে, এটা ভালো সংবাদ।'

তবে দিন দিন ছোট খামারির সংখ্যা কমে যাওয়ায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

তার মতে, সরকারের চুক্তিভিত্তিক চাষের জন্য নীতি প্রণয়ন করা উচিত। কারণ, কিছু কর্পোরেশন খামারিদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিচ্ছে।

তিনি বলেন, 'তা না হলে কিছুদিন পর দেখা যাবে, বাজারে কোনো ভারসাম্য থাকছে না।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।

তিনি বলেন, 'সরবরাহ শৃঙ্খলের দিকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি সংস্কারের মাধ্যমে ডিমের মতো পণ্যের দাম কেন প্রায়শই ওঠানামা করে তা গভীরভাবে পর্যালোচনার সুযোগ হতে পারে।'

'দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো নেই। বিপুল সংখ্যক উৎপাদক থাকলে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবে।'

তিনি আরও বলেন, 'বড় পোল্ট্রি ফার্মগুলো লেয়ার ফার্মিং ও ফিড উত্পাদন থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত পোল্ট্রি ভ্যালু চেইনের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে জড়িত আছে।'

'বাজার নিয়ন্ত্রণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখতে পারে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'বাজারে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।'

খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, 'বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগকারীদের সুযোগ ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে খাতভিত্তিক বিনিয়োগের জন্য একটি সীমা নির্ধারণের সময় এসেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

4h ago