ফাইভ-জি আমাদের কাছে কি অধরাই থাকছে?

বেশ কয়েক বছর আগেই চালু হওয়া সত্ত্বেও ফাইভ-জি নিয়ে এসব প্রশ্নের দৃঢ় সদুত্তর মেলেনি। তবে, যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকান তাহলে চমকে যাবেন।
ফাইভ-জি
অলঙ্করণ: স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

ফাইভ-জি কি হামবড়া শব্দ—যা এমন একটি প্রযুক্তিকে নির্দেশ করে যা আসলে বাস্তবে তেমন কোনো কাজে আসে না? যত গর্জে তত বর্ষে না হয়ে এটি থেকে যাবে? না কি এটি কম গতির ও বিলম্বিত সংযোগের সমস্যা সমাধান করে ডিজিটালজগৎকে বদলে দিতে মূল ভূমিকা রাখবে?

বেশ কয়েক বছর আগেই চালু হওয়া সত্ত্বেও ফাইভ-জি নিয়ে এসব প্রশ্নের দৃঢ় সদুত্তর মেলেনি। তবে, যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকান তাহলে চমকে যাবেন।

বিশ্বব্যাপী এই মুহূর্তে দেড় শ কোটির বেশি মানুষ, অর্থাৎ প্রতি চারজনের একজন এখন ফাইভ-জি নামে পরিচিত মোবাইল ফোনের পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।

প্রযুক্তিটি এর আগের প্রজন্মের প্রযুক্তির তুলনায় দ্রুত তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি অসংখ্য ডিভাইসকে এক সঙ্গে সংযোগ করাসহ আরও অনেক সুবিধা দেয়।

এর প্রভাব স্বাস্থ্যসেবা, স্বচালিত যান, ভার্চুয়াল বাস্তবতা ও অন্যান্য শিল্পে ব্যাপকভাবে পড়েছে।

ফাইভ-জির নানান সুবিধা সাধারণ গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদেরও আকৃষ্ট করে। বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে ফাইভ-জি কোনো হুজুগ না। এর চেয়েও বেশি কিছু।

প্রতিবেশী ভারতসহ বেশ কিছু দেশের গ্রাহকরা এটি সুবিধা ভোগ করলেও বাংলাদেশের মানুষ এখনো এই প্রযুক্তির সুফল পাচ্ছেন না।

২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ফাইভ-জি চালুর বিষয়টি থাকলেও এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে চলার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ।

২০১৯ সালের দিকে সারাবিশ্বে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক শুরু হয়। প্রথমে প্রধান শহরগুলোয় এই সেবা পাওয়া যায়। ২০২১-২০২২ সালের মধ্যে এর প্রসার ঘটে। গ্রাহকরা প্রযুক্তিটি সানন্দে গ্রহণ করায় ফাইভ-জির ব্যবহার এখন শীর্ষে।

জিএসএমএ বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে আসলে তা মোবাইল ফোন শিল্প ও গ্রাহকদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।

কিন্তু, বাংলাদেশে টেলিকম রেগুলেটরে নীতিমালা তৈরিতে ধীরগতি এবং অপারেটরদের অনীহা ও প্রস্তুতির অভাব দেশে ফাইভ-জি চালুর বিষয়টি এখনো দূরবর্তী বিষয় হয়ে থাকছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার 'কচ্ছপগতি'

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ফাইভ-জি চালুর কথা বলা হয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ফাইভ-জি চালুর আগে নীতিমালা জারির জন্য কমিটি ও একাধিক উপকমিটি গঠন করে বেশ কয়েক বছর আগে।

গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকসহ সব অংশীদারদের প্রতিনিধিত্বকারী এই কমিটিকে নীতিমালার খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাতে ২০২২ বা ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেশে ফাইভ-জি চালু করা যায়।

এটি করতে কমিটিকে পরিষেবার জন্য উপযুক্ত তরঙ্গ বেছে নিতে হয়েছিল। অন্যদের জন্য তরঙ্গের দাম নির্ধারণ করতে হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের গ্রাহকরা ফাইভ-জির জন্য প্রস্তুত নন। বিটিআরসি ও অপারেটরদের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, মোবাইল ফোন গ্রাহকদের মাত্র তিন থেকে চার শতাংশের কাছে ফাইভ-জি চালানোর ডিভাইস আছে।

পরে বিটিআরসি ফাইভ-জি প্রযুক্তির মোবাইল ফোন পরিষেবার জন্য দুই দশমিক তিন গিগাহার্জ, দুই দশমিক ছয় গিগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গ নির্ধারণ করে।

২০২২ সালের মার্চে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি নিলাম-২০২২ সালের জন্য নির্দেশিকা দেয়। তারা ঘোষণা করে, এটি ৩১ মার্চ দুই দশমিক তিন গিগাহার্টজ ও দুই দশমিক ছয় গিগাহার্টজ ব্যান্ডের জন্য তরঙ্গ নিলাম করবে। যাতে, সেই বছরের মধ্যে পরিষেবা চালু করা যায়।

বিটিআরসির নির্দেশিকায় তরঙ্গ নিলামের তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে অপারেটরদের ফাইভ-জি পরিষেবা চালু বাধ্যতামূলক করা হয়।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়, নিয়ন্ত্রক কমিশন শিগগির ফাইভ-জি ও মোবাইল ফোন পরিষেবার বাইরেও ফাইভ-জির নেটওয়ার্ক বাড়তে সেলুলার মোবাইল সার্ভিস অপারেটর লাইসেন্স (টু-জি, থ্রি-জি, ফোর-জি, ফাইভ-জি ও এর চেয়ে উন্নত প্রযুক্তি) জারি করবে।

'উল্লিখিত লাইসেন্সের শর্তাবলী ফাইভ-জি ও এর চেয়ে উন্নত প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য প্রযোজ্য হবে' বলেও সেই নির্দেশিকায় জানানো হয়।

২০২২ সালের ৩১ মার্চ দেশের চার মোবাইল ফোন অপারেটর এক দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারে ১৯০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনেছিল। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সে বছর নির্দেশিকা জারি করতে ব্যর্থ হয়।

অবশেষে, ফাইভ-জি তরঙ্গ নিলামের প্রায় দুই বছর পর ও নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরুর চার বছরের বেশি সময় পর ২০২৪ সালে লাইসেন্সের নীতিমালা জারি করে বিটিআরসি।

তবে, নির্দেশিকাটি ফাইভ-জি চালু বাধ্যবাধকতার স্পষ্ট রূপরেখা দিতে ব্যর্থ হয়। তাত্ক্ষণিক ফাইভ-জি চালুর বিরুদ্ধে সব অপারেটর শক্ত অবস্থানে প্রেক্ষাপটে নীতিমালার শিরোনাম থেকেও বাদ যায় 'ফাইভ-জি' শব্দটি।

যে কারণে অপারেটরদের অনীহা

২০২২ সালের মার্চে দুই দশমিক ছয় ব্যান্ডে ৬০ মেগাহার্টজ তিন হাজার ৩৬১ কোটি টাকায় কিনে নেয় গ্রামীণফোন। একই কাজ করেছে দ্বিতীয় বৃহত্তম অপারেটর রবি।

বাংলালিংক দুই দশমিক তিন ব্যান্ডে ৪০ মেগাহার্টজ দুই হাজার ২৪১ কোটি টাকায় ও রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটক ৩০ মেগাহার্টজ এক হাজার ৬৮১ কোটি টাকায় কেনে।

গত এক বছরে দ্য ডেইলি স্টার মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের প্রায় এক ডজন কর্মকর্তা ও তাদের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা সবাই বাংলাদেশে ফাইভ-জি চালু করতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন।

১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে টু-জি চালু করলেও থ্রি-জি আসে ২০১৩ সালে ও ফোর-জি আসে ২০১৮ সালে। অন্যদিকে অসংখ্য দেশে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশেরও এক দশক আগে চালু হয়।

তারা বলেছিলেন—উচ্চ অবকাঠামো খরচ, গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা ও বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় ফাইভ-জি চালু আর্থিকভাবে কার্যকর নয়।

ফোর-জি ও ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের মধ্যে পার্থক্য অনেক। ফাইভ-জি বেশ দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করে। ফোর-জির এক জিবিপিএসের তুলনায় ফাইভ-জি ১০ জিবিপিএস পর্যন্ত ডেটা দিতে পারে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ফোর-জির মাধ্যমেই গ্রাহকদের মানসম্পন্ন ইন্টারনেট, স্ট্রিমিং ও দ্রুত ডেটা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব।

বাংলালিংকের মূল প্রতিষ্ঠান ভিওন'র গ্রুপ প্রধান নির্বাহী কান তেরজিওগলু ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'ফাইভ-জি নয়, সবার জন্য ফোর-জি নিয়ে আসাই আমাদের অগ্রাধিকার।'

এর আগে তিনি ফাইভ-জির 'হুজুগে' আপ্লুত নন উল্লেখ করে ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'আমি দেখতে পাচ্ছি, দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। আমার বিশ্বাস সবার জন্য ফোর-জি'র যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমরা বাংলালিংক শুরু করেছিলাম, তা এখনো অনেক বাকি।'

বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশের বেশি মোবাইল গ্রাহক ফোর-জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন।

গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান টেলিনরের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী সিগভে ব্রেক্কে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'গ্রামীণফোন বাংলাদেশজুড়ে বিস্তৃত ফোর-জি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন এর লক্ষ্য ইনডোর কানেক্টিভিটি উন্নত করা।'

দেশে প্রতিষ্ঠানটির ফাইভ-জি চালুর পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ফোর-জির তুলনায় ফাইভ-জিতে সাধারণ গ্রাহকদের সুবিধা কম।

তার ভাষ্য, 'ফাইভ-জির আসল কাজ সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, হাসপাতাল ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিষেবা উন্নত করা।'

তিনি এটি চালুর প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের জন্য কারখানার অটোমেশনের মতো ফাইভ-জির নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনগুলোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন।

তিনি মনে করেন, কারা এটি ব্যবহার করবেন তা না ঠিক করে শুধুমাত্র ফাইভ-জি চালু করলে তা ব্যবসায়িকভাবে কার্যকর হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের গ্রাহকরা ফাইভ-জির জন্য প্রস্তুত নন। বিটিআরসি ও অপারেটরদের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, মোবাইল ফোন গ্রাহকদের মাত্র তিন থেকে চার শতাংশের কাছে ফাইভ-জি চালানোর ডিভাইস আছে।

রবি আজিয়াটার মূল প্রতিষ্ঠান আজিয়াটা গ্রুপের প্রধান নির্বাহী বিবেক সুদ ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সঠিক ডিভাইসও প্রয়োজন। জোরালো দৃষ্টিভঙ্গি দরকার।'

তবে অদূর ভবিষ্যতে ফাইভ-জি চালুতে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিচ্ছা থাকলেও এরই মধ্যে তারা প্রযুক্তিটির পরীক্ষামূলক ব্যবহার সফলভাবে শেষ করেছে।

১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে টু-জি চালু করলেও থ্রি-জি আসে ২০১৩ সালে ও ফোর-জি আসে ২০১৮ সালে। অন্যদিকে অসংখ্য দেশে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশেরও এক দশক আগে চালু হয়।

Comments