লবণ উৎপাদন: ঘাম ঝরানো কষ্টের দাম কোথায়?

লবণকে ঘিরে এক রাজা ও তার ছোট মেয়ের গল্প প্রচলিত আছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। সেই গল্প অনেকের জানা। তবুও বলতে ইচ্ছে করছে।
রাজা তার মেয়েদের জিজ্ঞাসা করেন যে তারা তাকে কতটা ভালবাসে। ছোট মেয়ের জবাব ছিল—'লবণের মতো'। রাজা এমন তুলনা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে নির্বাসনে পাঠান।
পরে যখন তিনি লবণ ছাড়া খাবার খেতে যান, তখন এর প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে পারেন। তার অনুশোচনা হয়। মেয়েকে বনবাস থেকে ফিরিয়ে আনেন। এমন সত্য বলার জন্য তাকে সম্মানিত করেন।
এই গল্পটি শুধুই গল্প নয়। এর চেয়েও বেশি। মানুষ তার প্রয়োজনীয় বস্তুকে গুরুত্ব দেয় না। উপলব্ধি করে তা হারানোর পর।
দেশের লবণ চাষিরা রাজার সেই ছোট মেয়ের যেন আধুনিক সংস্করণ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যারা সূর্যের প্রখর রোদে পুড়ে সাগর থেকে লবণ সংগ্রহ করেন তাদের সেই শ্রমের মূল্য লবণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
এই গল্প শুধু লবণ নিয়ে নয়। এটি সেসব অদৃশ্য হাতের গল্প যারা সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখেন এবং এমন এক অদৃশ্য ব্যবস্থা যা তাদের পরিশ্রম মূল্যায়নে ব্যর্থ।
দেখা হলো কক্সবাজারের চৌফলদন্ডী গ্রামের লবণ চাষি নুরুল আবসারের সঙ্গে। অন্য অসংখ্য মানুষের মতো তিনিও তার সময়, শ্রম ও টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
লবণের খেতে নিজের শ্রমের মূল্য নিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে।
'আমার পরিশ্রমের দাম কই?' জিজ্ঞেস করে তিনি বলেন, 'নিজের পরিশ্রমের দাম তো দূরের কথা—পলিথিন ও পানিসহ লবণ খেতে যে টাকা বিনিয়োগ করেছি তাই তো উঠে আসছে না।'
'জমির খাজনা, মাঠের প্রস্তুতি ও শ্রমিকসহ মোট বিনিয়োগ এক একরের জন্য তিন লাখ ২০ হাজার টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সর্বোচ্চ ৭৫০ মন লবণ পাবো।'
বর্তমান বাজার মূল্য হিসেবে প্রতি মন ২৫০ টাকা হলে নুরুল আবসারের হাতে আসবে প্রায় এক লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা। 'এই হিসাবে আমার লোকসান এক লাখ ৩২ হাজার টাকা,' যোগ করেন তিনি।
গত তিন বছরের ঘটনা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, 'যখন মনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা দাম ছিল তখন যা আয় হতো তা দিয়ে তিন বেলা খাবার ও পোশাক কেনা যেত। এর বেশি কিছু না। আমি কখনো বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। শুধু আমার পরিবারকে ভালো খাবার দেওয়ার মতো টাকা আয় করতে চাই।'
নিজেকে পুরোপুরি লবণ চাষে নিয়োজিত করে আবসার হতাশ কাহিনি শোনান। বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'বুঝতে পারছি না কেন লবণ চাষে দেহ-মন ঢেলে দিয়েছি।'
একটি শিল্পের জন্ম
দেশের চাহিদা মেটানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণ লবণ উৎপাদন করা হয়।
দেশের মোট লবণ উৎপাদনের ৮৭ শতাংশ আসে কক্সবাজার থেকে। বাকি ১৩ শতাংশ আসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে। বেশিরভাগ লবণ চাষি এই পেশায় আসেন উত্তরাধিকার সূত্রে। নির্ভর করেন প্রচলিত পদ্ধতির ওপর।
কক্সবাজার উপকূলে সূর্যের তাপ ও সাগরের পানি ব্যবহার করে লবণ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন করা হয়।
কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন অফিসের তথ্য বলছে—১৯৬০ সালে এ অঞ্চলে প্রথম লবণ চাষ শুরু হয়। তখন প্রায় ছয় হাজার ৭৭৪ একর জমি থেকে এক লাখ ২০ হাজার টন লবণ পাওয়া যেত। চাষিদের একরপ্রতি উৎপাদন ছিল ১৭ দশমিক ৫৪ টন।
প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ জাফর আহমেদ ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেসময় নাম ছিল ইপিএসআইসি। বর্তমানে বিসিক। তারা সৌর পদ্ধতিতে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ উৎপাদন শুরু করে।'
'১৯৮৬ সাল পর্যন্ত লবণ চাষিদের ঋণ দেওয়া হতো। ন্যায্য বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে লবণ কেনা হতো।'
২০০০ সালে লবণ উৎপাদনে পলিথিন পদ্ধতি আসায় এ শিল্পে বৈপ্লবিক সাফল্য আসে। এই উদ্ভাবনের ফলে ভালোমানের লবণ উৎপাদন বেড়ে যায়। চাষিরা এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেন।
গত অর্থবছরে বার্ষিক ২৫ লাখ ২৮ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে দেশে লবণ উৎপাদন হয়েছে ২৪ লাখ ৩৭ হাজার টন। ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ওই মৌসুমে ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ চাষ হয়। কাজ করছেন ৪০ হাজার ৬৯৫ চাষি।
মোহাম্মদ জাফর আহমেদ ভূঁইয়া আরও বলেন, 'বাজার দর কম ও জমি ইজারার খরচ বেশি হওয়ায় লবণ চাষিরা হতাশ। প্রতি মন লবণের বর্তমান বাজারমূল্য ২৪৭ টাকা। উৎপাদন খরচ প্রায় ৩২১ টাকা।'
তিনি মনে করেন, 'প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক কৃষক অনেক সময় ভালোমানের সাদা ও দানাদার লবণ উৎপাদন করতে পারেন না। অন্যদিকে লবণ খেতে ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।'
বিসিকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, চাষিরা স্থানীয়দের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ওপর নির্ভর করেন। ফলে তারা লবণের ন্যায্য দাম পান না। এ ছাড়াও, উপকূলীয় এলাকায় অনেকে সরকারি খাস জমি দখল করে চড়া দামে চাষিদের কাছে ইজারা দেয়। ফলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যায়।
ঘাম, ঋণ আর হতাশা
কক্সবাজারে চাষিদের উৎপাদিত অপরিশোধিত লবণ পরবর্তী পর্যায়ে পরিশোধনের জন্য পাঠানো হয়। এই শিল্পটি সাধারণত তিন ধরনের লবণ কারখানার ওপর নির্ভর করে।
কক্সবাজারের ইসলামপুরের ট্র্যাডিশনাল সল্ট মিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের মোট লবণ উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ ভ্যাকুয়াম মিল, প্রায় ২৫ শতাংশ যান্ত্রিক কারখানায় ও অবশিষ্ট ১০ শতাংশ প্রচলিত কারখানায় অপরিশোধিত লবণ প্রক্রিয়াজাত করা হয়।'
তার মতে, দেশে ১৫টি ভ্যাকুয়াম সল্ট কারখানা, ৪২টি যান্ত্রিক কারখানা ও ২০৫টি প্রচলিত কারখানা আছে।
'দেশে উৎপাদিত লবণের প্রায় ৬৫ শতাংশ শিল্পকাজে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চাহিদা কমে যাওয়ায় মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কমেছে।'
কাঁচা লবণ উৎপাদন, মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য ও জমির ইজারা খরচ বৃদ্ধিসহ লবণ শিল্পের মূল সংকটগুলোও তুলে ধরেন তিনি।
লবণ চাষিরাও জমির ক্রমবর্ধমান দাম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
চৌফলদন্ডী গ্রামের আবুল কাসিম আরও বলেন, 'এ বছর ৪০ শতক জমির ইজারা মূল্য প্রায় দ্বিগুণ। আগে ৩০ হাজার টাকায় ছয় মাসের জন্য জমি ইজারা পাওয়া গেলেও এখন তা ৫০ হাজার টাকা হয়েছে।'
বাংলাদেশ লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ লবণ উৎপাদনকারী এলাকা একটি ছোট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে।'
'তারা উপকূলীয় অঞ্চলে প্যারাবন পরিষ্কার করে লবণের খেত বানিয়েছে। তারা ছোট লবণ চাষিদের জমি ইজারা দিয়ে প্রচুর মুনাফা করছেন। লবণ চাষে জমির দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য এই সিন্ডিকেটই দায়ী।'
তার ভাষ্য, লবণ চাষিরা যদি সরকারের কাছ থেকে সরাসরি কম দামে জমি ইজারা পান তবে উপকৃত হবেন।
গুণমান বনাম পরিমাণ
সল্ট মিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুল আলম আরও বলেন, 'স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অপরিশোধিত লবণে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড (এনএসিএল) থাকে। ভারতে তা প্রায় ৯৯ শতাংশ।'
'ফলে আমাদের দেশে পরিশোধন খরচ বেশি।'
তিনি জানান, দেশের কৃষকরা প্রায়ই এক সপ্তাহের মধ্যে লবণ সংগ্রহ করেন। ভালোমানের লবণ উৎপাদনে ১২ থেকে ১৫ দিন দরকার। চাষিরা ভালোমানের তুলনায় পরিমাণকে অগ্রাধিকার দেন। ফলে লবণের মান খারাপ হয়।
কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামালের দাবি, দেশি লবণে এনএসিএলের পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ।
দেশের আবহাওয়ার কারণে সার্বিক মান কিছুটা কম বলে স্বীকার করেন তিনি।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার লবণ চাষি মোহাম্মদ ওয়াহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজারে নিম্নমানের লবণের চাহিদা কম থাকায় দামও কম।'
'ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির আগাম তথ্য পাওয়ার পর আমরা প্রায়ই খেত থেকে কাঁচা লবণ তুলতে বাধ্য হই।'
দাম নিয়ন্ত্রণ করেন কে?
ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হওয়ায় লবণ চাষিরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। বিনিময়ে বাজার দরের তুলনায় কম দামে তাদের কাছে লবণ বিক্রি করতে হয়।
শামসুল আলম আরও জানান, মিল গেটে প্রতি মন অপরিশোধিত লবণ ৩৫০ টাকায় কেনা হলেও চাষিরা পান ২৫০ টাকা।
'মধ্যস্বত্বভোগীরা লবণ চাষিদের মুনাফা খেয়ে ফেলছে' বলে মন্তব্য করেন তিনি। আরও বলেন, 'তাদের প্রভাবে বাজার দর ও মাঠের দামের পার্থক্য ২০ শতাংশ কমবেশি হয়।'
চৌফলদন্ডী গ্রামের লবণ চাষি আব্দুল কাদের ডেইলি স্টারকে জানান, প্রয়োজনের সময় তাদের কাছ থেকে টাকা ধার করায় অনেক সময় দালালদের কাছে কম দামে লবণ বিক্রি করতে হয়।
তবে মধ্যস্থতাকারীদের পক্ষে কথা বলেন কুতুবদিয়ার সারোয়ার কামাল। তার ভাষ্য, 'আমরা দুর্গম খেত থেকে লবণ সংগ্রহ করে কারখানায় বিক্রি করি। এতে প্রতি মন ১০ থেকে ২০ টাকা লাভ হয়।'
আমদানি ও বৈষম্য
লবণ চাষিদের সংগঠনগুলো প্রায়ই আমদানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে—বড় প্রতিষ্ঠানগুলো লবণ উত্পাদন ও চাহিদার তথ্য অতিরঞ্জিত করে সরকারের অনুমোদন নিয়ে বাজারে অপরিশোধিত লবণের দাম কমিয়ে দেয়।
চাষিদের সুরক্ষা দিতে লবণ আমদানি বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান সারোয়ার কামাল।
শামসুল আলম বলেন, 'যেহেতু দেশে উৎপাদিত লবণে এনএসিএলের পরিমাণ কম, তাই প্রকৃত পরিশোধিত লবণ উৎপাদন অপরিশোধিত লবণের মোট উৎপাদনের তুলনায় কম। ফলে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে লবণ আমদানি করতে হয়।'
গত অর্থবছরে লবণের চাহিদা ছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার টন। অপরিশোধিত লবণ উৎপাদন হয়েছে ২৪ লাখ ৩৭ হাজার টন। এ বছর দেশে চাহিদার পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার টন।
সারোয়ার কামাল আরও বলেন, 'শিল্পকারখানাগুলো সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে ভোজ্য লবণ আমদানি করছে। এটি অন্যান্য শিল্প সংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করা হয়।'
অনিশ্চিত জলবায়ু, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চানুয়া ইউনিয়নের কৃষক নবী হোসেন (৫২) প্রায় ২২ বছর ধরে লবণ চাষ করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তিনি এখন ক্রমবর্ধমান সংকটে পড়ছেন।
তিনি জানান, অনিয়মিত বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়সহ অনিশ্চিত আবহাওয়ার কারণে লবণ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
'অনিয়মিত বৃষ্টি আমাদের অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ফেলেছে। বেশিরভাগ সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি জমিতে লবণের ক্ষতি করে। জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে ফেলে।'
২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে অন্তত ১০টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এতে লবণ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ঝড়ে লবণ চাষের অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। লবণের প্যান ভেসে যায়।
২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৫২ হাজার টন লবণ ভেসে গিয়েছিল।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কৃষক আব্দুল হালিম ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বলেন, 'সেই দুর্যোগের ক্ষত আজো বয়ে বেড়াচ্ছি।'
Comments