চলতি বছর বাংলাদেশে অর্ধেক জাপানি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বাড়বে: জেট্রো জরিপ

একটি সংকটময় বছরের পর বাংলাদেশে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো আশা করছে যে চলতি বছরে তাদের ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মুনাফা হতে পারে।
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) জরিপ ২০২৪-এ বলা হয়েছে—রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অস্পষ্ট নিয়ন্ত্রক নীতি ও স্থানীয় বাজারে পণ্য কেনার অসুবিধাগুলো স্বাভাবিক ব্যবসায়ী কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এসব বাধা সত্ত্বেও প্রতিবেদনে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো আশা ও উদ্বেগ উভয়ই তুলে ধরেছে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩১৫ জাপানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। তাদের মোট বিনিয়োগ ৫০৮ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
জাপানি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ সত্ত্বেও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে মুনাফা প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠানের হার এশিয়া ও ওশেনিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। মাত্র ৩৭ দশমিক চার শতাংশ।
তবে, ২০২৫ সালে ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান পরিচালন মুনাফা বেড়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করছে। এটি সতর্ক আশাবাদের ইঙ্গিত দেয়।
জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ বিনিয়োগের অন্যতম। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৭ দশমিক সাত শতাংশ প্রতিষ্ঠান আগামী এক থেকে দুই বছরে ব্যবসা প্রসারের পরিকল্পনা করছে।
ঢাকায় জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউজি আন্দো দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় বাজারের চাহিদা ব্যবসা প্রসারের কারণ। তবে কাঠামোগত অদক্ষতা ও নীতিগত অনিশ্চয়তা সংকট তৈরি করেছে।'
জরিপে প্রধান উদ্বেগগুলোর মধ্যে আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা, অপ্রত্যাশিত নিয়ন্ত্রক নীতি ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ৯৪ দশমিক আট শতাংশ জাপানি প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে মূল ঝুঁকি হিসেবে মনে করছে এবং ৭৫ দশমিক তিন শতাংশ প্রতিষ্ঠান অস্পষ্ট সরকারি নীতির দিকে ইঙ্গিত করেছে।
অনুমতি পাওয়ায় দেরি ও কর সম্পর্কিত জটিলতাসহ বাংলাদেশের আইনি ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দক্ষ শ্রমিকের অভাব সংকট বাড়িয়েছে। এটি উত্পাদনশীলতা ও দক্ষতার ওপর প্রভাব ফেলেছে।
জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে যে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনশক্তি থাকলেও কারিগরি প্রশিক্ষণ ও পেশাদারি দক্ষতার অভাবে তাদের ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
ইউজি আন্দোর পরামর্শ—কর্মশক্তি উন্নয়ন বিনিয়োগের পরিবেশকে উন্নত করবে। স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা বাড়াবে।
আরেক মূল সংকট—বাংলাদেশে স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য কেনার পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবহৃত উপকরণ ও যন্ত্রাংশগুলোর ২৩ দশমিক তিন শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়।
ইউজি আন্দোর মতে—বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও প্রযুক্তিগত মান মেনে চলা নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অভাব আরেকটি বড় বাধা।
জরিপে দেখা গেছে—বাংলাদেশে ৭৯ দশমিক তিন শতাংশ জাপানি প্রতিষ্ঠান গুণমান পূরণ করা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পেতে সমস্যায় পড়ে। এ ছাড়াও, ৫৫ দশমিক দুই শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পাওয়ায় সংকটের কথা জানিয়েছে।
এ অবস্থা প্রশমিত করতে জাপানের ব্যবসায়ীরা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে আরও বিনিয়োগ ও স্থানীয় সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
'আমদানি নির্ভরতা ও উত্পাদনে খরচ কমানো নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরবরাহকারীদের উন্নতি গুরুত্বপূর্ণ' বলে মনে করে ইউজি আন্দো।
এ ছাড়াও, বন্দরে পণ্য উঠানামায় দেরি ও পরিবহন খরচ বেশি হওয়ার মতো সংকটগুলো সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের আরও নির্বিঘ্ন সরবরাহ নিশ্চিতে সুবিন্যস্ত শুল্ক পদ্ধতি ও উন্নত পরিবহন অবকাঠামোর আহ্বান জানিয়ে বলেছে এটি খরচ কমাবে ও মুনাফা বাড়াবে।
এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ক্রেতার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান থাকায় ও কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থানের কারণে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা দেখছে।
জেট্রোর জরিপে বলা হয়েছে—বাংলাদেশে ব্যবসা প্রসারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে, বেশি দামের পণ্য উৎপাদন, ভোগ্যপণ্য ও প্রযুক্তি খাতে।
ইউজি আন্দো মনে করেন—যদিও বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ অনেক, তবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বচ্ছতা ও নীতির ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, 'আরও জাপানি বিনিয়োগ আনতে স্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ।'
জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়তে থাকা একটি আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন।
জাপানের সহায়তায় বড় অবকাঠামো প্রকল্প—যেমন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও সড়ক-জ্বালানি প্রকল্প, বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে জাপানের প্রতিশ্রুতির দৃষ্টান্ত।
জাপান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে অব্যাহত সহযোগিতা এসব সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—সরকারের নীতি সংস্কার, অবকাঠামোগত অগ্রগতি ও দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নের সমন্বয় বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিশ্চিতের মূল চাবিকাঠি।
নিয়ন্ত্রক ও অবকাঠামোগত ত্রুটিগুলো সফলভাবে সমাধান করা গেলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানি বিনিয়োগের প্রধান কেন্দ্র হতে পারে।
Comments