সামগ্রিক অর্থনীতিতে ঈদের প্রভাব

ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দের সঙ্গে থাকে অর্থযোগও। ঈদের মধ্য দিয়ে শুধু যে একটি পবিত্র মাসের অবসান হয় তা নয়। আনন্দ, ভ্রাতৃত্ব ও উদারতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে ঈদ। এটি দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তিও বটে।
বেসরকারি হিসাবে, 'ফিতরা' দেওয়া হয় প্রায় ৪৯৫ কোটি টাকা। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য এই দান বাধ্যতামূলক। সাধারণত ঈদ উদযাপনে মানুষ যখন শহর থেকে গ্রামে আসেন তখন তারা তুলনামূলক দরিদ্রদের 'ফিতরা' দেন।
ঈদের সময় দেশে রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যায়। প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠান যাতে তাদের পরিবারের সদস্যরা স্বচ্ছন্দে ঈদ উদযাপন করতে পারেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে—চলতি মার্চের প্রথম ২৬ দিনে রেকর্ড দুই দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৮২ শতাংশ বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন মনে করেন, এর মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টন হয়।
এর ফলে গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বাজারগুলোয় ঈদের কেনাকাটার ধুম পড়ে। সব পেশার মানুষ উৎসবের কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। দোকানিরাও ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে নানান পণ্যের পসরা সাজান।
ঈদে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগও হয়। ক্রেতা-গ্রাহকের ভিড় সামলাতে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী নেয়।
দোকান মালিক সমিতির হিসাবে, রোজার ঈদে দেশে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ মনে করেন, অর্থনীতিতে ঈদের অবদান যতটা ধারণা করা হয় এর চেয়ে অনেক বেশি।
তার ভাষ্য, সারা বছর যে পরিমাণ খাবার ও অন্যান্য পণ্যের বেচাকেনা হয় এর প্রায় ৪০ শতাংশ হয় ঈদের সময়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বার্ষিক আয়ের ৪০ শতাংশ আসে ঈদ উৎসবে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ঈদকে কেন্দ্র করে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ যাতায়াত করেন। এ সময় পরিবহন খাত চাঙ্গা হয়।
দোকান মালিক সমিতি জানিয়েছে, রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে গয়নার চাহিদা বেড়ে যায়। একটি দোকানের প্রতিদিনের গড় বিক্রি ৮০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে প্রায় তিন লাখ টাকা হয়।
সমিতির ভাষ্য—ঈদ কাপড়চোপড় বিক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হয়ে আসে। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে পোশাক খাতে ব্যবসা হয় প্রায় ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
ঈদ যতই এগিয়ে আসে কেনাকাটা ততই বাড়ে। ঢাকায় ঈদের কেনাকাটার জন্য বসুন্ধরা সিটি শপিং সেন্টার, যমুনা ফিউচার পার্ক, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি, খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটসহ অভিজাত শপিংমলগুলোয় মানুষের ঢল নামে।
ঈদের আগে ঢাকার নিউমার্কেটের নাজিশ ফ্যাশনের কর্মী আনিসুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিদিনই ক্রেতা বাড়ে। বিক্রি বাড়ে। অনেকেই ভালোমানের পোশাক কিনছেন।'
মধ্যবয়সী ক্রেতা মরিয়ম জান্নাত পাকিস্তানি পোশাকের রঙ ও ফিটিংসের প্রশংসা করে বলেন, 'নিখুঁত ডিজাইন। কাপড়ও ভালো। পোশাকগুলো হালফ্যাশনের। ঈদে পরে আনন্দ পাওয়া যাবে।'
পুরান ঢাকার ইসলামপুর পাইকারি বাজার ও পল্টনের পলওয়েল সুপার মার্কেটের মতো পাইকারি বাজারেও ভিড়। ইসলামপুরের লায়ন টাওয়ারের টপ এইট কালেকশনের মোহাম্মদ আল আমিন ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের পণ্য চোখের নিমিষেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
'আমরা এই বছর ১,১০০ নতুন ক্যাটালগ পেয়েছি। আমাদের বুটিক পণ্যগুলো জনপ্রিয়। পার্টি ড্রেস, লেহেঙ্গা ও শাড়িসহ বুটিক পণ্য বিক্রি করি। ব্যবসায়ী ও অনলাইন বিক্রেতারা এগুলো কেনেন।'
ইসলামপুরের অপর পাইকারি বিক্রেতা নুরুজ্জামান রকি বলেন, 'খিলগাঁওয়ে নতুন কারখানা খুলেছি। সেখানে শার্ট-পাঞ্জাবি বানাই। সেগুলো বুম, ক্লাসিক, রিচম্যান, ফ্রিডমসহ অন্যান্য দেশি ব্র্যান্ডগুলোকে দিই।'
'এসবের দাম এক হাজার ২৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৩৫০ টাকার মধ্যে। রোজায় বিক্রি ভালো ছিল।'
সারা লাইফস্টাইল লিমিটেডের মতো খুচরা বিক্রেতারা গত বছরের ঈদ বাণিজ্যের তুলনায় ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করছে।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মতিউর রহমান জানান, তারা পারস্যের রাজকীয় মোটিফের নকশায় 'পার্সিয়ান টেল' কালেকশনে ক্রেতাদের আগ্রহ দেখতে পাচ্ছেন।
তাদের সংগ্রহে আছে শাড়ি, থ্রি-পিস ও ডেনিম প্যান্টস। দাম ২৫০ টাকা থেকে নয় হাজার ৯৯০ টাকা।
আছে নিখুঁত হাতের কাজের পাশাপাশি স্ক্রিন প্রিন্টের নকশার পোশাক।
কে ক্রাফটের মতো জনপ্রিয় ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলোরও ঈদ পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা খালিদ মাহমুদ খান জানান, রোজার শুরুর দিকে বিক্রি কিছুটা কম হলেও পরে বেড়েছে। তবে ঈদ যত এগিয়ে আসে ক্রেতাদের ভিড় তত বাড়ে।
ঈদে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ইয়েলো-র বিক্রি ভালো। দেশজুড়ে এর ১৭ স্টোরের পাশাপাশি আছে অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা। এবার প্রতিষ্ঠানটি ১,৫০০-র বেশি নতুন পণ্য এনেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইয়েলোর এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিক্রি ভালো। আশা করছি, চাঁদ রাতে আমাদের বিক্রি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।'
বিক্রি বাড়লেও, সংশ্লিষ্টদের অনেকে এই বছর ক্রেতাদের আচরণে সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন।
ইজি ফ্যাশন লিমিটেডের পরিচালক তৌহিদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসা ভালো হলেও গরমের কারণে এ বছর ক্রেতারা হালকা রঙ ও কাপড়ের দিকে ঝুঁকছেন।'
'আমাদের সুতির কাপড় জনপ্রিয় হয়েছে। সেগুলো পরতে আরাম হবে।'
রমজানে আরও বেশি গ্রাহক টানতে অন্যান্য ব্র্যান্ডের মতো সেইলরও নতুন নতুন পণ্য এনেছে। সেইলর'র খিলগাঁও শাখার ব্যবস্থাপক আভিয়াজ ইসলাম শুভ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের সুতি ও রেয়ন মেশানো কাপড়গুলো ইস্ত্রি না করেই পরা যাবে।'

ঈদের কেনাকাটা করতে বসুন্ধরা শপিং মলে এসেছিলেন পশ্চিম রাজাবাজারের আমিরা হক। ইয়েলো থেকে তিনি সাড়ে চার হাজার টাকায় একটি মেটালিক ব্ল্যাক টু-পিস কিনেছেন।
স্বামীর জন্য হালকা রঙের নিখুঁত কাজ করা পাঞ্জাবি ও ছেলের জন্য একই রকম জামাও কিনেছেন।
জুতার বাজারে এপেক্স ফুটওয়্যার অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ম্যানেজার ও ই-কমার্স লিড রায়হান কবির বলেন, 'বিক্রিতে কেউ আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না।'
তবে, তিনি কেনাকাটার ধরনে পরিবর্তনের কথা মেনে নিয়ে বলেন, এই বছর ঈদের কেনাকাটায় প্রাণচাঞ্চল্য নেই বলে মনে হচ্ছে। মানুষ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে কেনাকাটা করছে। উৎসব ভাবটা কম।'
জনপ্রিয় ফার্নিচার ব্র্যান্ড হাতিলের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোজার ঈদে আসবাবপত্রের বিক্রি ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়।'
ঈদ উৎসবের আরেকটি প্রধান উপাদান মিষ্টি ও অতিথি আপ্যায়ন। দোকান সমিতির তথ্য বলছে—ঈদে অতিথিদের আপ্যায়নে খরচ হয় প্রায় ২৭ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। রান্নার মসলা ও নিত্যপণ্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়।
মিরপুর-১১ কাঁচাবাজারের রাজা মোস্তা স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোজার ঈদকে সামনে রেখে মসলার দাম বাড়েনি। ভারতীয় জিরা ৬৪০ টাকা, এলাচ এক হাজার ৩৫০ টাকা ও দারুচিনি ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।'
'আমাদের দোকানের মসলা ভালোমানের। রোজার আগে দারুচিনি, এলাচ ও জিরার দাম যেমন ছিল এখন তেমনই আছে।'
একই মার্কেটের জামিল স্টোরের মালিক খন্দকার জামিল উদ্দিন বলেন, 'মান ভেদে ভিন্ন দামে একই পণ্য পাওয়া যায়।'
পল্লবীর পারুল পারভীন তার স্বামী দারুল হুদার সঙ্গে কেনাকাটায় বের হয়ে জানান, তারা সবসময় এই কাঁচাবাজার থেকে কেনাকাটা করেন। কারণ এখানে নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যও পাওয়া যায়।
'আজ সেমাই, চিনি, লবণ, কর্ন ফ্লাওয়ার, বেকিং পাউডার ইত্যাদি কিনেছি।' তবে রোজার আগের তুলনায় দাম কিছুটা বেশি বলে জানান তিনি।
'যেমন রোজার তিন-চার দিন আগে সাদা ও লাল চিনি কিনেছি যথাক্রমে ১৩০ ও ১৪০ টাকায়। কিন্তু এসব এখন ১৪০ টাকা ও ১৫৫ টাকায় কিনেছি।'
'ঈদে বিরিয়ানি খাব। তাই বেশি দামে মসলা কিনেছি। কর্ন ফ্লাওয়ার দিয়ে সবজি রান্না করব।'
ঈদের আগে বিউটি পার্লার ও কসমেটিকসের দোকানগুলোয় ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়।
মিরপুর-১১-র পোশাক শ্রমিক রেশমা খাতুন গ্রামে যাওয়ার আগে সহকর্মীদের নিয়ে মেকআপ পণ্য কিনতে দোকানে এসেছিলেন। তিনি বলেন, 'চুড়ি, কানের দুল, জরি, ক্লিপ, হেয়ারব্যান্ড ও মেকআপ বক্স কিনেছি।'
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সারওয়াত সিমিন দিনা জানান, তিনি হেরলান, ফ্লোরমার ও মুনস গ্যালারিতে গিয়েছিলেন। ঈদের পর পরীক্ষা থাকায় এবার গ্রামে যাচ্ছেন না। তাই মন খারাপ।
মুন'স গ্যালারির কর্মী জেসমিন আক্তার বলেন, 'ক্রেতা অনেক। আশা করছি, বিক্রি ভালো হবে।'
মিরপুর-১১-তে হকার জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি ইফতারে জিলিপি, ডিমের চপ, ছোলা, বেগুনি, আলুর চপ, মুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করেন। তিনি আরও জানান, শুক্র ও শনিবার তার আয় দুই হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়।
ভ্রমণও ঈদের অংশ। অনেকে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যান। ফলে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো এয়ারলাইনস, হোটেল-রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁর খোঁজ দিয়ে ঈদের সময় ভালো ব্যবসা করে।
গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা'র নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ সান্যাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সারা বছরের ব্যবসার বেশির ভাগ হয় ঈদের সময়। ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ কক্ষ বুকিং হয়ে যায়।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পণ্য ও সেবা বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ে।'
'ঈদে পায়জামা-পাঞ্জাবি, জুতা, ঘড়ি, টুপি, জায়নামাজ, আতর ও পোশাক বিক্রি বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেড়ে যায় বলে ব্যবসা বাড়ে।'
তিনি আরও বলেন, 'এসব পণ্য শহর থেকে গ্রামে যায়। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এরও প্রভাব পড়ে। পোশাকের পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়।'
রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'বিদেশ থেকে টাকা এলে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দেশে সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'চাহিদা মেটাতে পোশাক, জুতা, তেল, মসলা ও খেজুরের মতো পণ্য আমদানি হয়।'
তবে, তিনি মনে করেন যে ঈদকে ঘিরে সবাই সমানভাবে উপকৃত হন না। ছোট ব্যবসায়ীদের অনেকের ভালো মুনাফা হয় না। সাধারণ ক্রেতাদের অনেককে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের অভাবে অনেকে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন বলেই এমনটি হয়।
Comments