জাহাজভাঙা শিল্পের পরিবেশবান্ধবে ধীরগতি: ঝুঁকিতে শ্রমিক ও অর্থনীতি

ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

জাহাজভাঙা শিল্পকে বিপজ্জনক ও দূষণ সৃষ্টিকারী হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই এই শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করা জরুরি। শুধু জরুরিই নয়, যেহেতু এই শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করার সময়সীমা ঘনিয়ে আসছে, তাই একে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার। কিন্তু, এই পরিবেশবিরোধী শিল্পখাতকে পরিবেশবান্ধব করার প্রক্রিয়া এতটাই ধীর—তা যেন শম্ভুকগতিকেও হার মানায়।

প্রণোদনার অভাব কেবল পরিবেশের ক্ষতিই করছে না, বরং গুরুতর ব্যবসায়িক সংকটও তৈরি করছে। বিশেষ করে, হংকং কনভেনশন অনুসারে বাংলাদেশকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে জাহাজভাঙা শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। তা না হলে অন্যরা এ দেশে ভাঙার জন্য জাহাজ পাঠাবে না।

২০১৭ সালে পিএইচপি শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ড দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক সনদ পায়।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্য বলছে, গত মার্চ পর্যন্ত দেশের মাত্র সাতটি জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছে।

ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দেশে ২৪৮টি জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫টি সচল আছে।

পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠান কেআর শিপ রিসাইক্লিং'র মালিক তসলিম উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূলত আর্থিক প্রণোদনার অভাবে এই পরিবর্তন ধীরগতিতে হচ্ছে।'

উদাহরণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, 'একটি ছোট প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশবান্ধব করতে হলে বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা প্রয়োজন। মুনাফার মাধ্যমে এই টাকা তুলতে ১০ থেকে ১২ বছর বা এরও বেশি সময় লাগতে পারে। এই খাতে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তাও আছে।'

তার মতে, এই খাতে বিনিয়োগের পর মুনাফায় ফিরতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। মুনাফা কম হওয়ায় ব্যাংক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এই শিল্পে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়।

আগামী জুনের পর হংকং কনভেনশন মেনে না চলা দেশগুলোয় ভাঙার জন্য জাহাজ পাঠানো হবে না।

বিএসবিআরএর আশঙ্কা, এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে কর্মরত আট হাজার থেকে নয় হাজার কর্মী ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীলরা বিপদে পড়বেন।

শ্রম অধিকার কর্মীরা বলছেন, প্রচলিত ব্যবস্থায় জাহাজভাঙা সস্তা হওয়ায় কম বিনিয়োগ দরকার হয়। এছাড়া, জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা তাদের শিপইয়ার্ডগুলো পরিবেশবান্ধব করতে খুব কম প্রণোদনা পান।

জাহাজভাঙা খাতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন শ্রম অধিকারকর্মী ফজলুল কবির মিন্টু। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রচলিত অবস্থার তুলনায় পরিবেশবান্ধব অবস্থায় জাহাজ ভাঙার খরচ অনেক বেশি।'

এর ফলে মুনাফা কমে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক এই নিয়ে দ্বিধায় আছেন বলেও জানান তিনি।

বিএসবিএর সভাপতি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিবেশ মন্ত্রণালয় আমাদের খাতকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে লাল তালিকায় রেখেছে। তাই আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নই।'

তিনি জানান, ব্যাংকগুলো শুধু জাহাজ কেনার জন্য স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেয়। তারা শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের উন্নয়নে ঋণ দিতে রাজি নয়। আর্থিক সহায়তার অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধব হতে পারছে না।

প্রচলিত পদ্ধতির কারণে সৃষ্ট গুরুতর পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে জরুরিভাবে উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রেখে জাহাজ ভাঙার দিকে যেতে হবে। যথাযথ সুরক্ষা বা পরিবেশগত মান বজায় রেখে জাহাজ ভাঙতে হবে।

ফলে মাটি, বাতাস ও সাগরের চারপাশের পরিবেশ যে তীব্র দূষণের শিকার হচ্ছে তা রোধ করতে হবে।

২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় সীতাকুণ্ড উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে সিসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, পারদ, অ্যাসবেস্টস ও ভারী ধাতুর মতো বিপজ্জনক পদার্থের উপস্থিতি দেখা গেছে।

গবেষণায় আশঙ্কা করা হয়, ২০১০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ৭৯ হাজার টন অ্যাসবেস্টস, দুই লাখ ৪০ হাজার টন পিসিবি, ১৯ লাখ ৭৮ হাজার টন জৈব তরল বর্জ্য, ৭৭৫ টন অজৈব বর্জ্য ও দুই লাখ ১০ হাজার টন ওজোনক্ষয়কারী পদার্থ ওই এলাকার মাটি-পানিতে জমা হবে।

জাহাজ ভাঙার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে কাজ করেন গবেষক প্রবাল বড়ুয়া। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের বর্জ্য প্রায়ই বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এটি সাগরের বাস্তুতন্ত্রকে দূষিত ও জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে।'

বিশেষ করে, মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানির দূষণের হার উদ্বেগজনক। তার, তেল ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান পোড়ানোয় আশপাশের অঞ্চলে বাতাসের গুণগত মান খারাপ হচ্ছে।

'তেল ও ক্ষতিকর রঙ বঙ্গোপসাগরে ছড়িয়ে পড়ায় সামুদ্রিক প্রাণী হুমকিতে পড়েছে। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় জেলেরা সংকটে পড়ছেন।'

আরেকটি বড় উদ্বেগ হলো—প্রচলিত পদ্ধতিতে জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত। শ্রমিকদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত ও অদক্ষ। তারা হেলমেট, গ্লাভস বা বুটের মতো মৌলিক সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করেন।

জাহাজ ভাঙার সময় বিস্ফোরণে অনেকের মৃত্যু হয়। আবার অনেক উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে ও বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণেও অনেকে মারা যান।

এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কমপক্ষে ২৩১ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন তিন শতাধিক শ্রমিক।

মারাত্মক দুর্ঘটনা ছাড়াও শ্রমিকরা নিয়মিত অ্যাসবেস্টস, সীসা ও বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে শ্বাসজনিত ও ত্বকের রোগ এবং ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।

জাহাজভাঙা শিল্পে পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের সার্বিক নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকি কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।

গত নয় মাস ধরে পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মোহাম্মদ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে কাজ করার সময় সুরক্ষা সরঞ্জাম পরা বাধ্যতামূলক। শ্রমিকদের জন্য আরও ভালো সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।'

অপর পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবুল কালাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের তুলনায় পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানে মজুরি শুধু বেশিই নয়, তা নিয়মিত দেওয়া হয়। এটি আর্থিক নিরাপত্তা দেয়।'

একটি পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক চান মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা উত্সব ভাতা পাই। এখানকার অধিকাংশ প্রচলিত প্রতিষ্ঠানে তা নেই। পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নিরাপদ।'

হংকং কনভেনশনের আওতায় চলতি বছরের জুনের পর বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের প্রচলিত জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পুরোনো জাহাজ সরবরাহ বন্ধ করে দিলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে বিএসবিআরএ সভাপতি জহিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশবান্ধব সনদ প্রক্রিয়াধীন। শিল্প মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি, তারা যাতে পরিবেশবান্ধব ও এই প্রক্রিয়ায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জাহাজ পাঠাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়।'

'তা না হলে এ শিল্প সংকটে পড়ে স্থবির হয়ে যেতে পারে।'

গত বছর জাহাজ ভাঙার জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী পছন্দের তালিকায় প্রথমে ছিল। এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী ভাঙা ৪০৯ জাহাজের মধ্যে ১৩০টি বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।

Comments

The Daily Star  | English

Power grid failure causes outage across 21 districts

According to the Power Grid Bangladesh PLC, the situation has since returned to normal

9h ago