চাহিদা, জনপ্রিয়তা, মুনাফা—সবই বাড়তি কফি শপ ব্যবসায়

ছবি: প্রবীর দাশ

এ দেশে এক সময় কফি খেতে যাওয়া ছিল বিলাসিতা বা প্রাচুর্যের প্রতীক। চা ছিল মধ্যবিত্তের আওতার ভেতর। সময়ের আবর্তে কফি আসে সীমিত আয়ের মানুষের ঘরেও। তবে এখনো তা শহুরে জীবনযাত্রার প্রতীক।

শুধু তাই নয়, এই নগরে সব বয়সীদের আড্ডায় থাকছে কফির আয়োজন। সঙ্গে যোগ হয়েছে—সৃজনশীলতা ও ভিন সংস্কৃতির আত্তীকরণ।

এখন পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা কফির দোকানে মূলত শিক্ষার্থীদের ভিড় থাকে। সেখানে শুধু কফি খাওয়ার বিষয় না, থাকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার বিষয়ও। এসব দোকান হয়ে উঠে নতুন বন্ধু গড়ার ক্ষেত্র। স্বল্প পরিচিতদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে অনেকে বসেন কফি শপে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় দশকে নতুন প্রজন্মের মানুষদের পছন্দে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সমাজ মাধ্যমের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বাদ-পছন্দেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

আর্থিক সচ্ছলতাও কফি শপের সংখ্যা বাড়াতে বেশ অবদান রেখেছে। উন্নত দেশগুলোর অনুসরণে রাজধানীর আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে কফি শপ। ভালো কফির স্বাদ নিতে চর্চা হচ্ছে কফি কালচার।

এদিকে যতই দিন যাচ্ছে ঢাকায় বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য নিরাপদ জায়গার অভাব যেন ততই বাড়ছে। সেই অভাব পূরণে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কফি শপ। সংখ্যাধিক্যের কারণে দোকানগুলোয় আনতে হচ্ছে নতুনত্ব। দিতে হচ্ছে রুচির ছোঁয়া।

২০১০ সালের দিকে কফির দোকানগুলো চালুর ক্ষেত্রে নতুন গতি পায়। এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ অনেক শহরে গড়ে উঠে দামি দামি কফি শপ।

রাজধানীর ধানমন্ডি, বনানী, উত্তরা ও মিরপুরের মতো জনবহুল এলাকাগুলোয় এখন ট্রেন্ডি ক্যাফের ছড়াছড়ি।

২০০০ এর দশকের মাঝামাঝি ভালোমানের কফির যে কয়েকটি দোকান ছিল কফি ওয়ার্ল্ড তাদের অন্যতম। এরপরের দশকে কফি শপগুলো আরও সহজগম্য হয়ে ওঠে। অনেক চায়ের দোকানও বদলে যায় কফি শপে।

সেসময় অনেক কফি শপে তরুণ পেশাদার ও শিক্ষার্থীদের কফির মগ নিয়ে ল্যাপটপে কাজ করতে দেখা যায়।

এসব কফি শপ আড্ডা বা অলস সময় কাটানোর পাশাপাশি নীরবে নিজের কাজটুকু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে ওঠে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ফ্রি ওয়াই-ফাই ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সুবিধার পাশাপাশি দেওয়া হয় শান্ত মনোরম পরিবেশ।

২০১১ সালে ঢাকায় স্থানীয় প্রতিষ্ঠান নর্থ এন্ড কফি রোস্টারস যাত্রা শুরু করে। এদেশে ভালো কফির প্রসারে তাদের অগ্রগামী হিসেবে দেখা হয়। পরে গ্লোরিয়া জিনের কফিস ও আরও পরে ক্রিমসন কাপের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা শুরু করে।

২০১৪ সালে রাজধানীর উত্তরায় বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা কফির মতো দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে ঢাকায় তাদের তিনটি আউটলেট আছে। চতুর্থটি বর্তমানে নির্মাণাধীন।

বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা কফিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম জানান, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ছোট ছোট কফি শপের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তা তাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠেছিল।

কারণ, সেসব কফি শপের কল্যাণে ভালো কফি তৈরির কারিগরের সংখ্যা বাড়তে থাকে বলে মনে করেন তিনি।

এ ছাড়াও, সামাজিক মাধ্যমে ক্যাফেগুলোর আকর্ষণীয় বিপণনের কৌশলের কল্যাণে আরও বেশি সংখ্যক তরুণ কফি শপের প্রতি আকৃষ্ট হন।

তার মতে, কফি এখন আর সব পানীয়ের মতো নয়। এটি জীবনধারার অংশ। কফির প্রচারণাগুলো সাজানো হয় তরুণদের কথা মাথায় রেখে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তারা ফ্র্যাঞ্চাইজির ওপর নির্ভর না করে নিজেরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা নিজেদের পণ্য নিজেদের মতো গ্রাহকদের কাছে তুলে ধরছেন।

তবে, অত্যধিক শুল্কের কারণে ভালোমানের কফি বিনের আমদানি খরচ অনেক বেশি। ফলে দেশি ব্র্যান্ডের কফি শপগুলোর বিকাশে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, বলে মনে করেন তিনি।

অন্যান্য সংকটের মধ্যে আছে—দোকান ভাড়ার প্রচুর খরচ এবং প্রশিক্ষিত ও দক্ষ বারিস্তা বা কর্মীর অভাব।

সাধারণত ১৮-৪০ বছর বয়সীরা কফি শপে বেশি আসেন। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শহুরে জীবনধারায় অভ্যস্ত, সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় মানুষ ঘন ঘন ক্যাফেতে আসেন।

তার মতে, দীর্ঘদিন ধরে কফি পানের প্রবণতা মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও কক্সবাজারের মতো অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

তরুণদের চাহিদার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থাকা শহরগুলোয় কফি শপের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে দেখা যাচ্ছে, বলেন তিনি।

কফি ওয়ার্ল্ডের এরিয়া ম্যানেজার জুয়েল দাস ডেইলি স্টারকে জানান, ২০০৫ সালে বনানীতে আউটলেট খোলার মাধ্যমে তারাই প্রথম আন্তর্জাতিক কফি চেইন হিসেবে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে।

পরের তিন মাসে তারা আরও চারটি আউটলেট খোলেন। নতুন দুটি কফি শপের জায়গাও চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। শিগগিরই কাজ শুরু হবে। আগামী নভেম্বরের মধ্যে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ কফির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭০ শতাংশ।'

সরবরাহ ব্যবস্থাও কিছুটা উন্নত হয়েছে। আগে কফি বিন আমদানি করতে হতো। এখনো স্বল্প পরিমাণে হলেও বাংলাদেশে কফি উৎপাদন হচ্ছে।

অ্যাওয়েক ক্যাফে অ্যান্ড বিস্ট্রোর সহকারী ব্যবস্থাপক অমিত কস্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকার গ্রাহকদের ভালোমানের কফি ও আরামদায়ক পরিবেশ দিতে ২০২৩ সালে তারা এই ব্যবসায় আসি।'

'ভালোমানের কফি ও সুন্দর পরিবেশের কারণে কফি শপগুলোয় গ্রাহকদের সংখ্যা বাড়ছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রাহকের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। অনেকে নিয়মিত আসেন।'

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি দোকান দিয়ে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি এখন একই স্থানে আরেকটি দোকান চালুর কাজ করছে।

তারা দোকান, কর্মীদের প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম, বিপণন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রায় আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

তাদের গ্রাহকদের বেশিরভাগই তরুণ পেশাদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তা। ব্যবসায়ীরাও সুন্দর পরিবেশ ও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেটের কারণে ঘন ঘন ক্যাফেতে আসেন।

ম্যাকলারেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহনাফ সাঈদ ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৮ সালে এক কাপ কফির পেছনে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ করা বেশিরভাগ মানুষের কাছে খুবই ব্যয়বহুল বলে মনে হতো।'

তিনি আরও বলেন, 'এই টাকায় অনেক খাবার পাওয়া যায়। এখন এটা অনেকটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে কফি শপগুলো সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আমরা দেখছি যে কোনো বয়সের মানুষ কফি শপে আসছেন।'

গত বছরের জানুয়ারিতে ম্যাকলারেন্স চালু হয়। শুরুতে দৈনিক বিক্রি ছিল দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো। আগামী সেপ্টেম্বরে মতিঝিলে এর দ্বিতীয় শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে বলে জানান তিনি।

'এর পরে, আমরা ধীরে ধীরে এমন এলাকায় যেতে চাই যেখানে কফি শপের সংখ্যা কম।'

অনেক মহল্লায় এখন রাস্তার পাশের দোকানগুলোয় চায়ের পাশাপাশি কফি পরিবেশন করা হয়। ফলে যারা চা খান তাদের মধ্যেও কফি দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম জানান, ক্লাসের বিরতিতে বা পড়াশোনার পর ক্লান্তি কাটাতে তিনি প্রায় কফি শপে যান।

'বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করা বা কিছু সময় একা কাটাতে এটি আরামদায়ক জায়গা,' বলে মনে করেন তিনি।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী শারমিন আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাজের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে কফি শপে আসি। কফি শপে বসে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলি। নিরুদ্বেগ পরিবেশ আলোচনা করতে ভালো লাগে।'

ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ডিরেক্টর অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপস অ্যান্ড কমিউনিকেশনস শামীমা আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অফিস এখন আর চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়।'

শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়া নিয়ে আলোচনা করুক, তরুণ পেশাদারদের অনানুষ্ঠানিক সভা করুক বা শিল্পীরা তাদের পরবর্তী কাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করুক—কফি শপগুলো এখন শহুরে মানুষের অনানুষ্ঠানিক সামাজিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

এই পরিবর্তনটি বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা এখন নতুন আউটলেট খুলে স্থানীয় বাজার প্রসারিত করছে।

বাজার বড় হওয়ায় দেশে কফি কালচার দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। বিশ্ব-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশছে স্থানীয় সংস্কৃতি।

১৯৯৮ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নেসলে প্রথম কফি বাজারজাত করে।

নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেডের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দেশের বিকশিত কফি সংস্কৃতিতে তরুণদের আগ্রহ বেশি।

জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ৩০ বছরের কম হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী চায়ের দোকানগুলো আধুনিক ক্যাফেতে বদলে যাচ্ছে। ফলে শহুরে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসছে।

কফি সংস্কৃতি এখন ধীরে ধীরে ছোট শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে।

দেশে কফির বাজার বাড়ছে বছরে ৫৬ শতাংশ হারে

মাত্র এক দশক আগেও দেশের কফি বাজারে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উপস্থিতি ছিল নগণ্য। সে সময় বেশিরভাগ চাহিদা মেটাতে সুইস বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নেসলে এ খাতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।

এখন নেসলে ছাড়াও কয়েকটি ছোট প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে কফি আমদানি ও বাজারজাত করছে।

তবে, মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাজারে এসেছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে—গত ১০ বছরে দেশে চায়ের বাজার বার্ষিক পাঁচ শতাংশ হারে বাড়লেও কফির বাজার প্রতি বছর বাড়ছে ৫৬ শতাংশ হারে।

আমদানির তথ্য বলছে—২০১২ সালে বাংলাদেশ ২৬৪ টন কফি আমদানি করেছিল। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় এক হাজার ৭৪৫ টন। বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৫৬ শতাংশ।

অন্য কথায়, চায়ের তুলনায় কফির চাহিদা ১১ গুণ দ্রুত বাড়ছে। তবুও, চায়ের বাজার কফির তুলনায় ৫৩ গুণ বড়।

কফি বিপণনে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবারে কফি খাওয়া হয়। চা খাওয়া হয় ৯০ শতাংশেরও বেশি পরিবারে।

তবে দ্রুত বদলাচ্ছে দৃশ্যপট। ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে কফির সংস্কৃতি।

বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি কফি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে আটটিসহ প্রায় ৪০টি দেশ থেকে কফি আমদানি করে। এর ৮৮ শতাংশ আসে মাত্র ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল ও ভিয়েতনাম থেকে।

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

8h ago