রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় কমেছে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে গত ছয় মাসে দেশে বিলাসবহুল সেডান ও স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেলের (এসইউভি) বিক্রি অনেক কমেছে।
গত বছরের জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি প্রায় স্থবির। সরকার পরিবর্তনের পর মানুষ খরচের লাগাম টেনে ধরেছে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে—গত জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮৭১টি এসইউভি নিবন্ধিত হয়েছে।
এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ বিলাসবহুল গাড়ি।
অডি, বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজ-বেঞ্জের প্রায় সব মডেলকেই বিলাসবহুল গাড়ি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। টয়োটার ল্যান্ড ক্রুজার, হ্যারিয়ার ও প্রাডো এবং মিতসুবিশির পাজেরোকে প্রিমিয়াম গাড়ি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
'গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ১০টি গাড়ি বিক্রি করেছি,' উল্লেখ করে বাংলাদেশে বিএমডব্লিউ গাড়ির অনুমোদিত পরিবেশক এক্সিকিউটিভ মোটরস লিমিটেডের ডিরেক্টর অব অপারেশনস আশিক উন নবী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর এমন মাস গেছে যখন আমরা সর্বোচ্চ চারটি গাড়ি বিক্রি করেছি। কোনো মাসে একেবারেই বিক্রি হয়নি।'
তার মতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিলাসবহুল গাড়ির বিক্রি কমেছে ৬০ শতাংশের বেশি।
তিনি এই মন্দার জন্য রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়া ও বেশি আয়ের মানুষদের খরচ কমিয়ে ফেলাকে দায়ী করেছেন।
'কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, চিকিৎসক, আইনজীবী ও ব্যবসায়ী, যারা একসময় নিয়মিত বিলাসবহুল গাড়ি কিনতেন তারা এখন কিনছেন না।'
এক্সিকিউটিভ মোটরস লিমিটেড বর্তমানে বাংলাদেশে পেট্রোল, প্লাগ-ইন হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক গাড়িসহ নয় মডেলের বিএমডব্লিউ গাড়ি বিক্রি করে। দাম পড়ে এক কোটি তিন লাখ টাকা থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা।
বিআরটিএ'র বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, 'চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট পাঁচ হাজার ১১৯টি যাত্রীবাহী গাড়ি (১০ জনের কম যাত্রীবাহনকারী গাড়ি) নিবন্ধিত হয়েছে। গত বছর তা ছিল ১০ হাজার ৪৯৯টি।'
নথিভুক্ত এসইউভির সংখ্যা বাড়লেও বেশিরভাগই ১৫০০ সিসি বা এর নিচে। এগুলো বিলাসবহুল গাড়ি নয়।
বিএমডব্লিউ আইসেভেন ও এক্স ফাইভ মডেল ক্রেতাদের আকৃষ্ট করলেও বিক্রি কমে গেছে। 'মনে হচ্ছে, ক্রেতারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। বিলাসবহুল গাড়ির বাজার ফেরাতে ক্রেতাদের আস্থা দরকার।'
জার্মান বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা অডির একমাত্র পরিবেশক অডি বাংলাদেশ গত বছরের জুলাই থেকে কোনো গাড়ি বিক্রি করতে পারেনি।
প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি লিড অব সেলস সাফায়েত বিন তাইয়্যাব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিক্রি কমে যাওয়ায় পরিচালন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি।' গত কয়েক মাসে প্রতিষ্ঠানটির তেজগাঁও শোরুমে ক্রেতা দেখা যায়নি।
তিনি এই সংকটের জন্য চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন। ফলে ধনী ক্রেতারা বিলাসবহুল গাড়ি কেনা থেকে বিরত আছেন। এসব গাড়ির দাম এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি ৯৯ লাখ টাকার মধ্যে।
দেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি আরও কমেছে।
অর্ডার, আয় ও রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিআরটিএ সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) ওপরও কার্বন-কর আরোপ করেছে।
সাফায়েত বিন তাইয়্যাব আরও বলেন, 'আশাবাদী ছিলাম, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচের কারণে বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রবৃদ্ধির পথ দেখাবে। তবে এই নীতিগত সিদ্ধান্ত হতাশাজনক।'
মোটরস বে'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান বিপু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মন্দা শুধু বিলাসবহুল গাড়িতেই সীমাবদ্ধ নেই।'
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে আর্থিক লেনদেন কমে যাওয়ায় সামগ্রিক বিক্রি প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে বলে মনে করেন তিনি।
এইচএনএস অটোমোবাইলসের হেড অব অপারেশনস শফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজারের সার্বিক পরিবেশ এই মুহূর্তে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রির অনুকূল নয়।'
তার ভাষ্য, 'কম দাম থেকে শুরু করে বেশি দাম পর্যন্ত সব ধরনের গাড়ির বিক্রি গত এক বছর ধরে কম। ক্রেতারা বিলাসবহুল পণ্যে খরচ করতে চাচ্ছেন না। মনে হয়, সার্বিক পরিস্থিতির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।'
Comments