স্টিভ জবসের সফলতার গল্প

স্টিভ জবস বাবার কাছ থেকে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেয়েছিলেন। আর তা হলো নিজের কাজে মনোযোগী হওয়া।
স্টিভ জবস, অ্যাপল, স্টিভ ওজনিয়াক,
স্টিভ জবস। রয়টার্স ফাইল ফটো

বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থা অ্যাপলের কিংবদন্তি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও স্টিভ জবস ছিলেন দূরদর্শী উদ্যোক্তা। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- অ্যাপল, নেক্সট কম্পিউটার ইনকরপোটেড। তিনি ডিজনির অ্যানিমেশন স্টুডিও পিক্সারের চেয়ারম্যান ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। স্টিভ জবস অনেকের কাছে টেক-টাইটান হিসেবে পরিচিত। আজ জেনে নিন স্টিভ জবসের সফলতার গল্প।

শুরুর গল্প

স্টিভ জবস ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাবা-মায়ের একজন ছিলেন সিরীয় বংশোদ্ভূত এবং অন্যজন সুইস-জার্মান বংশোদ্ভূত। জন্মের পরপরই তাকে দত্তক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। পল ও ক্লারা জবস তাকে দত্তক নেন। এই দম্পতি খুব বেশি শিক্ষিত ছিলেন না।

স্টিভ জবস ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউতে তার দত্তক বাবা-মায়ের কাছে বেড়ে ওঠেন। তার দত্তক বাবা গাড়ি মেরামতের কাজ করতেন। জবস বাবার মেকানিক্স ও কারুশিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে অনেক কিছু শিখছিলেন। তার বাবা নিজের ওয়ার্কশপে একটি বিশেষ বিভাগ যোগ করেন, উদ্দেশ্য ছিল ইলেকট্রনিক্সের প্রতি জবসের আগ্রহ বাড়ানো।

স্টিভ জবস বাবার কাছ থেকে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেয়েছিলেন। আর তা হলো নিজের কাজে মনোযোগী হওয়া।

কৌতূহলী ও উদ্যোগী

স্টিভ জবস ছোট থেকেই খুবই প্রতিভাবান ছিলেন। তিনি উদ্যোগী ও সাহসী ছিলেন। এসবের পেছনে মূল কারণ ছিলো তার কৌতূহল। তিনি যখন ছাত্র ছিলেন তখন থেকেই নানান উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কাজের প্রতি তার আগ্রহ ও সাহস ছিল ঈর্ষণীয়। তাই ছাত্র থাকাকালে হিউলেট-প্যাকার্ডের (এইচপি) সভাপতির কাছে পৌঁছে যান।

জবস স্কুল প্রকল্পের কিছু খুচরা যন্ত্রাংশের সংগ্রহে বিল হিউলেটের বাসভবনে যোগাযোগ করেন। জবসের এই আগ্রহ ও সাহসে মুগ্ধ হয়েছিলেন হিউলেট-প্যাকার্ডের সভাপতি। তিনি জবসকে তার প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন স্টিভ জবস।

ওই ইন্টার্নশিপ থেকে ইলেকট্রনিক্স ব্যবসা নিয়ে অনেক কিছু শিখেছিলেন স্টিভ জসব। কিন্তু, তার কৌতূহল থেমে যায়নি। কারণ ইলেকট্রনিক্সের বাইরে অনেক কিছুতে আগ্রহ ছিল। তিনি বিভিন্ন ধরণের সংগীত, সাহিত্য- এমনকি ওষুধ নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

ডায়নামিক জুটি

এক সহপাঠীর মাধ্যমে স্টিভ ওজনিয়াকের সঙ্গে পরিচয় হয় স্টিভ জবসের। স্টিভ তখনো স্কুলের পড়েন, ওজনিয়াক তখন কলেজ শিক্ষার্থী। তবে দুজনের ইলেকট্রনিক্স, প্রযুক্তি ও টিঙ্কারিংয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল। স্টিভ হাইস্কুল শেষ করে ওরেগনের কলেজে ভর্তি হন। তবে, তিনি সেখানে খুব দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা ছেড়ে দেন। জবস এই শিক্ষাকে অর্থহীন বলে মনে করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, সেখানে পড়া মানে অর্থের অপচয়। পরে তিনি বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসেন। সেখানে ভিডিওগেম নির্মাতা আটারিতে চাকরি নেন। তবে, সেই চাকরি বেশি স্থায়ী হলো না। এরপর জবস ভারত ভ্রমণ করেন।

সাত মাস বিদেশে থাকার পর জবস যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। সেখানে ফেরার পর তিনি আবার আটারিতে চাকরি নেন। এরপর জবস বাবার গ্যারেজ থেকে ওজনিয়াকের সঙ্গে প্রযুক্তি নিয়ে নতুন অ্যাডভেঞ্চার শুরু করেন।

শুরুতে তারা ভেবেছিলেন সার্কিট বোর্ড তৈরি করে প্রযুক্তি সংস্থা ও কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করবে। কিন্তু, পরে তারা ব্যক্তিগত কম্পিউটার তৈরির ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন। পুজি সংগ্রহে তারা কিছু সম্পত্তি বিক্রি করেন এবং নিজেদের কোম্পানি চালু করেন। তাদের প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল অ্যাপল, তাদের প্রথম পণ্য ছিল অ্যাপল আই।

সফল পথচলা শুরু

তাদের প্রথম পণ্যটি প্রাথমিকভাবে সাফল্য পেয়েছিল। কারণ উত্পাদিত ২০০ ইউনিটের প্রায় ৮৮ শতাংশ বিক্রি করতে পেরেছিলেন। তবে, আরও কয়েকজন বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়ার পর নতুন উন্নত কম্পিউটার তৈরি করেন তারা। যাকে তারা অ্যাপল ২ নাম দেন। এটি তৈরিতে সার্কিট বোর্ডের সঙ্গে মনিটর ও কীবোর্ড যোগ করার মতো কয়েকটি ছোট পরিবর্তন আনেন। তাতেই নতুন পণ্যটি দারুণ সাফল্য পেয়ে যায়। অ্যাপল ২ তাদের সবচেয়ে সফল, পাশাপাশি ব্যাপকভাবে উত্পাদিত হওয়া বিশ্বের প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটার হয়ে ওঠে।

এরপর স্টিভ জবস ও ওজনিয়াকের মূল ব্যবসা শুরু হয়। তারা অ্যাপল ২-এর পর একাধিক পণ্য তৈরি করেন। শুধু তাই নয় ব্যক্তিগত কম্পিউটার বাজারের আধিপত্য বিস্তারে আইবিএমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার চেষ্টা শুরু করেন।

সামনে এলো কঠিন সময়

বিস্ময়করভাবে অ্যাপলের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পাশাপাশি স্টিভ জবসের ভাগ্যও। ১৯৭৮ সালে জবসের সম্পদ ছিল এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কিন্তু, মাত্র দুই বছর পর তার মোট সম্পদ ২৫০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। কোম্পানিটির বাজার মূল্যও ছিল ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

দুর্ভাগ্যবশত, স্টিভ জবসের এই সুদিন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আইবিএম যখন তাদের ব্যক্তিগত কম্পিউটার চালু করেছিল, তখন তার প্রতিষ্ঠান বাজারে শেয়ার হারাতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালে স্টিভ জবস কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তৎকালীন সিইওর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। দুজনের মধ্যে মতবিরোধ এতটাই বেড়েছিল যে, জবসকে শেষ পর্যন্ত কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হয়।

নেক্সট অধ্যায়

অ্যাপল থেকে পদত্যাগ করেন জবস। তবে, তিনি ভেঙে পড়লেন না। তিনি যা করতে চেয়েছিলেন তাই করার চেষ্টা করলেন। জবস আরও একটি কম্পিউটার কোম্পানি গড়ে তুললেন। যার নাম দিয়েছিলেন নেক্সট ইনকরপোরেটেড।

জবসের জীবনের এই অধ্যায়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি হাল না ছেড়ে আরও শক্তভাবে ফিরতে চাইলেন। পাশাপাশি তখন অ্যানিমেশন স্টুডিওতেও প্রচুর বিনিয়োগ করেন স্টিভ জবস। যা পরে ডিজনির পিক্সার নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে, জবস তার মূল লক্ষ্যে অটল ছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল 'প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকে পরিবর্তন করা'।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নেক্সট এতটাই সফল হয়ে ওঠে যে, নেক্সট কেনার চেষ্টা শুরু করে অ্যাপল। ১৯৯৭ সালে এই অধিগ্রহণের পরে স্টিভ জবস পরামর্শদাতা হিসেবে অ্যাপলে ফিরে যান। ফেরার পরপরই পুনরায় সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে শীর্ষ নেতৃত্বের পদে ফেরেন।

আবার ঘুরে দাঁড়াল অ্যাপল

জবস অ্যাপলের চালকের আসনে ফেরার পরে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেন। আগের সিইওর অধীনে কোম্পানিটি বছরের পর বছর ধরে লোকসান করছিল। কিন্তু, জবস তার পুরোনো পদে ফেরার পর অকল্পনীয় কিছু করেন। প্রায় এককভাবে অ্যাপলের গতিপথ বদলে দেন।

স্টিভ জবসের কৌশল তার সমকক্ষদের থেকে একদমই আলাদা ছিল। জবস অ্যাপলে অনেক উদ্ভাবনী পণ্য যোগ করেন। যার মধ্যে ছিল আইম্যাক। এটি এমন একটি পণ্য ছিল যা এখন উইন্ডোজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে।

তারপর তিনি অ্যাপলের ব্র্যান্ডিংয়ে আধুনিক কিছু পরিবর্তন এনে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ান এবং অ্যাপলকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠন করেন। আইম্যাকের পর জবস অ্যাপলে আইপড, আইটিউনস, অ্যাপল টিভি ও আইফোনের মতো জনপ্রিয় পণ্য যোগ করেন। এভাবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অ্যাপল।

লক্ষ্যে অটুট থাকা

২০০৭ সালের শেষে স্টিভ জবস অ্যাপলকে ৩.৪৯ বিলিয়ন ডলারের নিট আয় এবং ১৭৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার মূল্য অর্জনে সহায়তা করেন। কিন্তু, ২০১১ সালের অক্টোবরে মৃত্যুর সময় অ্যাপলের বাজার মূল্য প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হন।

স্টিভ জবস যে লক্ষ্য নিয়ে অ্যাপল শুরু করেছিলেন তাতে তিনি অটল ছিলেন। অ্যাপল তৈরির সময় তার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল 'প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকে পরিবর্তন করা'। নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন করে তিনি ঠিক তাই করেছিলেন।

স্টিভ জবসের সফলতা থেকে বোঝা যায়, সফল হতে হলে লক্ষ্যে অটুট থাকতে হবে। কখনো সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। তিনি বলেছিলেন, 'কেউ যদি নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে ব্যর্থ হতে হয় না, তাই হাল ছেড়ে দিও না।'

Comments