যে প্রক্রিয়ায় পাচারকারীদের ‘স্বর্গ’ সিঙ্গাপুর
আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে সিঙ্গাপুরের কঠোর বিধান থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা এর মাধ্যমেই অর্থপাচার করে থাকেন—এমনটাই বলছেন আইনজীবী ও সম্পত্তিবিষয়ক পরামর্শকরা।
সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি স্থিতিশীল হওয়ায় অনেকের নজরই দেশটির সম্পদের দিকে। দেশটির আবাসনশিল্পে সম্পদের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এটি অনেকের কাছে আকর্ষণীয় ও নিরাপদ বলে মনে হতে পারে।
সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইটস টাইমসের প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের করপোরেট রিয়েল এস্টেট প্র্যাকটিসের অংশীদার রাজাহ অ্যান্ড টানের গ্যাজেল মোক সংবাদমাধ্যটিকে বলেন, অবৈধ অর্থকে এমন প্রক্রিয়ায় পাচারের চেষ্টা করা হয়, যাতে মনে হয় সেই অর্থ বৈধ উৎস থেকেই এসেছে।
তিনি আরও বলেন, 'প্রচলিত অর্থনীতিতে অবৈধ অর্থ ঢোকাতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পাসপোর্ট ব্যবহার করে লেনদেন করায় এ ধরনের অপরাধ শনাক্ত করা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।'
তার মতে, এসব ঘটনা যথাযথভাবে তদন্তের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব লেনদেন অবৈধ কি না, তা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে শনাক্ত করা খুবই কঠিন।
আন্তঃসীমান্তবিষয়ক অপরাধ নিয়ে কাজ করা নাইম্যান গিবসন মিরালিসের অস্ট্রেলীয় আইনজীবী ডেনিস মিরালিস মনে করেন, বিশ্বজুড়ে অর্থপাচারের একটি বহুল প্রচলিত মাধ্যম হলো আবাসন খাত।
আবাসন ছাড়াও অবৈধ অর্থ প্রায়শই বিলাসবহুল সম্পদ কিনতে ও ব্যবসায় বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়। গেমিং মেশিন ও ক্যাসিনো চিপ কিনতেও এই অর্থ ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তীতে নগদ অর্থে রূপান্তর করা যায়।
আইনজীবী, হিসাবরক্ষক ও রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের মতো পেশাজীবীরা 'জেনে বা না জেনে' দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্ট গঠন করে আবাসনশিল্পের মাধ্যমে অর্থপাচারে অপরাধীদের সহায়তা করে থাকতে পারেন।
এসব পেশাজীবীরা অপরাধীর পক্ষে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ গ্রহণ ও স্থানান্তর, জটিল প্রক্রিয়ায় ঋণ ও অন্যান্য ক্রেডিট ব্যবস্থা স্থাপন এবং তৃতীয় পক্ষের কাছে সম্পত্তি হস্তান্তর সহজতর করার মাধ্যমে লেনদেনকেও সহজ করে থাকতে পারেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রপার্টি কনসালটেন্ট স্ট্রেইটস টাইমসকে বলেন, 'এসব কাজের জন্য কেবল প্রয়োজন আইন ও অ্যাকাউন্টিং জানা একজন ব্যক্তি। সেই ব্যক্তিই ১০৫টি সম্পত্তির জন্য এ গুচ্ছ প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সহায়তা করবেন এবং পরে সেগুলোকে বিদেশি অ্যাকাউন্ট বা ট্যাক্স হেভেনের সঙ্গে যুক্ত করে দেবেন।'
উদাহরণ হিসেবে তিনি সম্প্রতি প্রায় ১০০ কোটি সিঙ্গাপুর ডলারের (৭৩ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার) সমমূল্যের অর্থ, সম্পত্তি, বিলাসবহুল গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ জব্দ এবং অর্থপাচার ও জালিয়াতির অভিযোগে ১০ বিদেশিকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটি উল্লেখ করেন।
গ্রেপ্তারকৃতরা কেউই সিঙ্গাপুরের নাগরিক বা দেশটির স্থায়ী বাসিন্দা নন।
এখন পর্যন্ত মোট ১০৫টি সম্পত্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সিঙ্গাপুর সরকার। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ৮৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জব্দ করা সম্পদের মধ্যে আছে ৩৫টিরও বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ২৫০টিরও বেশি বিলাসবহুল ব্যাগ ও ঘড়ি, ২৭০টিরও বেশি গয়না ও ভার্চুয়াল সম্পদের তথ্যসহ নথিপত্র।
আইনজীবী ডেনিস মিরালিস আরও বলেন, 'আবাসন খাতকে এই ধরনের অপরাধীদের হাত থেকে রক্ষা করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে জমিজমা খাতের সঙ্গে জড়িত হিসাবরক্ষক, রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ও আইনজীবীদের।'
'শুধু পুলিশের পক্ষে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য সত্যিকার অর্থে সমাজের সবার সতর্ক অবস্থান ও সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন,' যোগ করেন তিনি।
গত ২৮ জুন সিঙ্গাপুর বেশ কয়েকটি কঠোর বিধান চালু করে। এসব বিধানের মাধ্যমে ডেভেলপারদের ঝুঁকি বিশ্লেষণ, গ্রাহকের তথ্য যথাযথ যাচাই, সন্দেহজনক লেনদেনের প্রতিবেদন তৈরির কথা বলা হয়। নির্মাণাধীন সম্পত্তির মাধ্যমে অর্থপাচার ও সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন রোধে সরকারের কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের কথাও এসব বিধানে বলা আছে।
রাজাহ অ্যান্ড টানের গ্যাজেল মোক জানান, এসব বিধানে বলা আছে যে, কোনো আবাসনের নির্মাণকালে ওই সম্পদ যারা কিনবেন, সেই ক্রেতাদের পর্যবেক্ষণ করা। একটি নির্মাণকাজ শেষ হতে সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর লেগে যায়।
তিনি এও জানান যে, নন-প্রপার্টি ডেভেলপার বা ব্যক্তিরা হাউজিং ডেভেলপারস (নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্সিং) আইন বা বাণিজ্যিক সম্পত্তি বিক্রয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। এমনকি, ক্রেতাদের পর্যবেক্ষণ করার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ বা সক্ষমতা তাদের নাও থাকতে পারে।
তিনি মনে করেন, কিছু বিধিবিধান সব ধরনের ক্রেতাদের ওপরেই আরোপ করা উচিত।
মোক আরও বলেন, 'রিয়েল এস্টেট এজেন্টরাই তাদের গ্রাহকদের তথ্য-উপাত্ত যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারেন।'
তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব ডেভেলপার নতুন বিধান মেনে চলতে পারবেন না, তাদের দোষী সাব্যস্ত করা ও ১ লাখ মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানা করা যেতে পারে। অর্থপাচারের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের মাধ্যমে দেওয়া যেকোনো নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলও করা যেতে পারে।
প্রপার্টি মার্কেটের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচারের ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের কথা আইনজীবীরা সংবাদমাধ্যমটিকে জানিয়েছেন। এসব কৌশলের মধ্যে আছে—পুলিশের নজরদারিতে নেই এমন ব্যক্তিকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা।
তৃতীয় পক্ষের নাম ব্যবহার করে তার মাধ্যমে অপরাধীরা তাদের অবৈধ অর্থ দিয়ে সম্পত্তি কিনে থাকতে পারে। এ ছাড়াও, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সম্পত্তি 'ভাড়া' দিয়ে অপরাধীরা তাদের অবৈধ অর্থের তথ্য বা সেই সম্পত্তির মালিকানা আড়াল করে থাকতে পারেন।
সংস্কারের নামে অপরাধীরা তাদের অবৈধ অর্থ আবাসন খাতে খরচ করে থাকতে পারেন। পরে যেন তা বেশি দামে বিক্রির সুযোগ হয়।
অপরাধীরা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে প্রপার্টি এজেন্টকে দিয়ে তাদের অর্থের মিথ্যা বিবরণ দিয়ে থাকতে পারেন।
আইনি সংস্থার সন্দেহ এড়াতে অপরাধীদের অনেকে একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে থাকতে পারেন। তারা যাতে ধরা না পড়েন সে জন্য অনেক পেশাজীবীর নামও ব্যবহার করে থাকেন।
Comments