৬ ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ ও সহযোগীদের ঋণ ৯৫ হাজার কোটি টাকা

এই ঋণের পরিমাণ গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতের মোট বকেয়া ঋণের পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৭ সাল থেকে গত জুনের মধ্যে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার ৭৯ শতাংশই ইসলামী ব্যাংক থেকে।

এই ঋণের পরিমাণ গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতের মোট বকেয়া ঋণের পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, এই ছয়টি ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটির নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।

দ্য ডেইলি স্টার এসব ঋণের নথি বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে বেশিরভাগ ঋণ ব্যাংকিং নিয়ম উপেক্ষা করে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি দেশের ব্যাংকিংখাতে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল তার প্রমাণ এসব ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া।

আওয়ামী লীগের সাবেক রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আত্মীয় মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এস আলম গ্রুপ। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের চাক্তাই শাখায় অ্যাকাউন্ট খোলার এক মাসের মধ্যে ঢেউটিন বিক্রির প্রতিষ্ঠান মুরাদ এন্টারপ্রাইজকে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ দেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির কেন ঋণ প্রয়োজন এবং এত পরিমাণ ঋণের টাকা তারা ফেরত দিতে পারবে কি না—এর কোনো কিছুই যাচাই করা হয়নি।

এর এক বছর পর কোম্পানিটিকে আরও ১১০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, এই মুরাদ এন্টারপ্রাইজ এস আলম গ্রুপের একটি ছায়া কোম্পানি।

এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলামী ব্যাংক মুরাদ এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে খুবই কম পরিমাণ জামানত নিয়েছে।

গত বছরের জুন থেকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এস আলমের বড় ছেলে আহসানুল আলম। ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

এর মধ্যে ২৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে এস আলমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে এবং বাকি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে নাবিল গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, ইউনিটেক্স গ্রুপ, অ্যানানটেক্স গ্রুপসহ ২৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে।

এসব ঋণের জন্য চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নথি অনুযায়ী, ১০টি কোম্পানির মাধ্যমে এই শাখা থেকে ৩৫ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে।

এস আলম গ্রুপ এবং এর ছায়া কোম্পানিগুলো—নাবিল ফুডস, নাবিল অটো রাইস মিলস, এমএস এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল—ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে ২৯ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট এবং অন্যান্য শাখা থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে আরও ২৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যবসায়িক গ্রুপটি।

নিত্যপণ্য থেকে মাছ চাষ, নির্মাণ সামগ্রী থেকে রিয়েল এস্টেট, টেক্সটাইল থেকে মিডিয়া, আন্তঃনগর বাস থেকে শিপিং, বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে ব্যাংক-বীমাখাতের ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকও নিয়ম মেনে চলেনি।

এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ৪৪৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে এস আলমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে। আর এই ঋণের ৯০ শতাংশই দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা করপোরেট শাখা থেকে।

বাকি দুই হাজার ৯৫০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলমের সহযোগী কোম্পানিগুলো।

একটি গ্রাহককে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ ঋণ কোনো ব্যাংক দিতে পারে, এস আলমের ক্ষেত্রে সেই সীমা গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে জনতা ব্যাংক।

ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি একক গ্রাহককে দিতে পারে না। চলতি বছরের জুনের শেষে জনতা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এস আলম গ্রুপ। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলমের জামাতা বেলাল আহমেদ। এস আলমের আরও পাঁচ আত্মীয় এই ব্যাংকের বোর্ডে রয়েছেন।

ইউনিয়ন ব্যাংক থেকেও প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে আছেন এস আলমের বোন হালিমা বেগম, ভাই ওসমান গনি ও মো রাশেদুল আলম, রাশেদুলের স্ত্রী মারজিনা শারমিন, ভাগ্নে মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ আদিল।

এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী কোম্পানিগুলো গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫৭৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান এস আলমের মেয়ে মায়মুনা খানম। ১১ বছর বয়সী ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন এস আলমের ভাই শহিদুল আলম ও বোন রোকেয়া ইয়াসমিনসহ আরও সাতজন আত্মীয়।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ২৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ, যে ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলম নিজেই। তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং আরও চারজন আত্মীয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন।

ব্যাংকিংখাতের অভ্যন্তরীণরা জানিয়েছেন, এস আলমের সহযোগী কোম্পানিগুলোর ঋণ যোগ করলে স্যোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হবে।

ব্যাপক অনিয়মের কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শরিয়াহভিত্তিক ছয় ব্যাংকের ঋণ বিতরণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

ব্যাংকগুলো হলো—ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।

এই ছয়টি ব্যাংক নতুন কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারবে না এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোনো ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে না।

তবে ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ, আমানতের বিপরীতে এসএমই ঋণ ও পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণ করতে পারবে।

এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও মোহাম্মদ সাইফুল আলম, এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক, ছয়টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

Comments