২ ‘ভূঁইফোড়’ ব্যবসায়ী সরিয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের ২৩৪৩ কোটি টাকা

প্রতি বছর এসব শাখায় অডিট করা হলেও এসব ‘ভূঁইফোড়’ ঋণ গ্রহীতার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংকের কয়েকটি শাখা থেকে নামে-বেনামে বড় অংকের ঋণ নেওয়া অধিকাংশ গ্রাহকের অস্তিত্ব নেই।

প্রতি বছর এসব শাখায় অডিট করা হলেও এসব 'ভূঁইফোড়' ঋণ গ্রহীতার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০২২ ও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল অডিট করে প্রতিবেদন জমা দিলেও এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এসব ভূঁইফোড় ঋণ গ্রহীতার তালিকা তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

ভূঁইফোড় এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ পেল, তা ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিছু বলতে না পারলেও ধীরে ধীরে মুখ খুলছেন জুনিয়র কর্মকর্তারা।

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে এমন হাজার কোটি টাকা ঋণপ্রাপ্তির 'ভেতরের খবর'।

দুই আত্মীয় আনছারুল আলম চৌধুরী ও মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরী কাজ করেন এস আলম গ্রুপে।

নিজেদের ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিলেও তাদের মূল 'ব্যবসা' ব্যাংকের টাকা ঋণের মাধ্যমে লোপাট করা।

এই দুই 'ব্যবসায়ী' ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখা থেকে দুই হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।

ব্যাংকিং নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই 'অদৃশ্য ক্ষমতায়' এই বিশাল অঙ্কের টাকা তাদের ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে আনছারুল আলম চৌধুরী গড়ে তুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেড। মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরীর আছে মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ।

ব্যাংকের নথিপত্র অনুসারে এই দুটি প্রতিষ্ঠানই ভোজ্য তেল ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। নথিপত্রে উল্লেখিত ঠিকানায় সরেজমিন গিয়ে পাওয়া যায়নি এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাউকে। এলাকাবাসী ডেইলি স্টারকে জানান, এসব প্রতিষ্ঠান নামসর্বস্ব 'কাগুজে' প্রতিষ্ঠান।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক মঞ্জুর হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঋণ গ্রহীতাদের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। এগুলো আমাদের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিংবা ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের সদস্যরা বলতে পারবেন। আপনারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।'

জানা গেছে, ২০২০ সালে মাত্র আট লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেডের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী। ব্যাংকে জমা দেওয়া নথিপত্রে ভোজ্য তেল ও ঘি উৎপাদন এবং ট্রেডিং ব্যবসা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের (তেলের রিফাইনারি) ভিত্তি পাওয়া যায়নি। এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরুর দুই বছরের মধ্যেই ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখা থেকে এক হাজার ২৮৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ঋণ নেয়। ব্যাংক থেকে চার কিস্তিতে ছাড় করা হয় এসব ঋণ। ২০২১ সালের অক্টোবরে ছাড় হওয়া এই বিশাল অঙ্কের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকে জামানতের পরিমাণ খুবই সামান্য।

ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেডের ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জমা দেওয়া আয়করের নথিপত্রে ব্যাংক থেকে নেওয়া এক ২৮৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ঋণ কোথায় বিনিয়োগ করেছেন এর বর্ণনা নেই।

ঋণ নেওয়ার বিষয়ে ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেডের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরীকে একাধিকবার ফোনে কল করা হলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর 'রং নাম্বার' বলে লাইন কেটে দেন।

অল্প জামানতে এত বিশাল অঙ্কের টাকা কীভাবে ঋণ পেল?—এমন প্রশ্ন চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোচিত হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা কিছু বলছেন না।

ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেড নয় মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরীও পিছিয়ে নেই। মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ মূলত চিনি, সয়াবিন ও পামওয়েলের ট্রেডিং ব্যবসা করে বলে নথিপত্রে উল্লেখ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি মূলত এস আলম গ্রুপের হয়েই কাজ করার প্রমাণ মিলেছে।

মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখা থেকে ঋণ নিয়েছে এক হাজার ৫৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ঋণ নেওয়ার সময় প্রাথমিক জামানত হিসেবে বন্ধক রেখেছে বিনিয়োগ গ্রহীতা ও বন্ধকদাতার পার্সোনাল গ্যারান্টি, সাধারণ চার্জ ডকুমেন্টস, পোস্ট ডেডেট চেক। এছাড়াও সহায়ক জামানত হিসেবে জমা আছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ইস্যু করা ২৭০ কোটি টাকার ১২টি মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট (এমটিডিআর)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট বিভাগের তদন্তে ধরা পড়ে এসব অনিয়ম। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় সতর্ক নোটিশেই সীমাবদ্ধ থাকেন অডিট কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তিতে নানা অনিয়ম ধামাচাপা দিতে ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনছারুল আলম চৌধুরীর ও মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরীর নামে কেনা হচ্ছে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা।

ইতোমধ্যেই আনছারুল আলম চৌধুরী ও মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরীর নামে ওই পত্রিকার শেয়ার হস্তান্তর হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। পরে প্রতিবেদকের পরিচয় ও ফোন করার কারণ জানিয়ে এসএমএস দেওয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক মঞ্জুর হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঋণ গ্রহীতাদের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। এগুলো আমাদের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিংবা ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের সদস্যরা বলতে পারবেন। আপনারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।'

Comments