এবি ব্যাংকের আর্থিক সংকট কাটার লক্ষণ নেই

এবি ব্যাংক

এক সময়ের স্বনামধন্য বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এখন ক্রমেই খারাপ হচ্ছে অব্যবস্থাপনা, ঋণে অনিয়ম, স্পন্সরদের অবৈধ সুবিধা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে।

১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংকটি গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ হাজার ১১৫ কোটি টাকার মন্দ ঋণের চাপে আছে। তথ্য বলছে, এটি এবি ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ৩২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা ঋণের ৩১ শতাংশ।

এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ছিল পাঁচ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা।

মন্দ ঋণের বিপরীতে আট হাজার ৪১ কোটি টাকার প্রভিশন রাখতে এবি ব্যাংক এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিলম্বিত সুবিধা পাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এবি ব্যাংকের কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সুযোগ তুলে নেওয়ায় হয় এবং এবি ব্যাংক মন্দ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখে নিয়ম মাফিক, তাহলে এটি বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।

এ ছাড়াও সম্প্রতি আমানত কমে যাওয়ায় এবি ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে পড়েছে।

ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী অনুসারে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবি ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ৩২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা ছিল ৩৫ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা।

ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর এবি ব্যাংককে 'লাল' তালিকায় রাখে। পরে একে একটি ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ব্যাংকের গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

বিশ্লেষকদের মতে, গ্রাহকরা হঠাৎ টাকা তুলে নেওয়ায় সংকটে থাকা এবি ব্যাংক আরও সংকটে পড়ে।

এবি ব্যাংকের সমস্যাগুলো অন্তত আট বছর আগে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। ২০১৬ সালে অর্থপাচারের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদঘাটনের পর সমালোচনায় পড়ে এবি ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা দেখা গেছে, বিনিয়োগের নামে দুটি বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আরব আমিরাতে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা পাচার করেছে ব্যাংকটি।

বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী এম মোরশেদ খান ব্যাংকটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এবি ব্যাংকটি দীর্ঘদিন ধরে মোরশেদ খান ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

অর্থপাচারের সমালোচনার সময় এম ওয়াহিদুল হক এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।

২০১৭ সালে চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আহমেদ ও পরিচালক ফাহিমুল হক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন।

সে বছর ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি দেখভালের জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়কারী আছে এখনও।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, নিয়ম ভেঙে দেওয়া ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও, ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টা ও বর্তমান নেতৃত্বের অব্যবস্থাপনাও ব্যাংকটির সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে।

বেক্সিমকো গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, এশিয়ান সিটি, বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও মাহিন গ্রুপের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি।

এবি ব্যাংক মাহিন গ্রুপ ও বিল্ডট্রেডের পক্ষে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্সকে ১৭৯ কোটি টাকার গ্যারান্টি দিলেও এখন তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে এবি ব্যাংক।

এবি ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে বড় ঋণ আদায়কে অগ্রাধিকার দিলে ব্যাংকটিকে আর্থিক সংকট থেকে বাঁচানো যেত।

কিন্তু তা হয়নি, কারণ ভুল ব্যবস্থা খেলাপি পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল।

এবি ব্যাংকের নথি অনুসারে, প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) কাঠামোর প্যারামিটার পূরণের জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারকে নিয়োগ দেয়। যদিও তার ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা ছিল না।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্থিতিশীল করতে ও আর্থিক ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক চালু করে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকে যে অব্যবস্থাপনা হয়েছে এটি একটি উদাহরণ।

২০১৯ সালে তারেক আফজাল ব্যাংকটির প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এর আগে ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নতুন কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। তবে ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করিনি।'

বিদ্যমান খেলাপি ঋণের সঙ্গে সুদ যোগ হওয়ায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, 'এশিয়ান সিটি ও বিল্ডট্রেডের ঋণ সবই আগের।'

ফিনিক্স ফাইন্যান্সের গ্যারান্টির বিষয়ে তার ভাষ্য, তার মেয়াদের আগেই এই গ্যারান্টি ইস্যু করা হয়েছিল এবং ২০১০ সালে মাহিন গ্রুপ ও বিল্ডট্রেডকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল।

কবির বিন আনোয়ারের নিয়োগের বিষয়ে তিনি জানান, তার নিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু ব্যাংক তাকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়নি।

তিনি বলেন, 'ব্যাংকটি এখন আর্থিক সংকটে থাকলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের ব্যাংককে যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাল তালিকাভুক্ত করে তখন ব্যাপক হারে টাকা তোলার চাপে পড়ি। কিন্তু তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল।'

Comments

The Daily Star  | English

Drug smuggling via air, land routes on the rise

This grim picture emerges as Bangladesh, like other countries around the world, observes the International Day Against Drug Abuse and Illicit Trafficking today.

13h ago