২৫০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমতি বাংলাদেশ ব্যাংকের, মেয়াদ সর্বোচ্চ ১৫ বছর

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে আসায় ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গতি আনতে দেশের বড় করপোরেট ঋণখেলাপিসহ প্রায় ২৫০টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পরিশোধের জন্য আরও পাঁচ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত সময় দেবে। এর জন্য ন্যূনতম এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট এবং সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হতে পারে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন এ বিষয়ে অবগত কর্মকর্তারা।
এই কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শর্তাবলী ভিন্ন হবে।
এই সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় রয়েছে আব্দুল মোনেম গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ ও তানাকা গ্রুপের মতো শিল্পগোষ্ঠী—একাধিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে যাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ শত শত কোটি টাকা।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্টিল ও টেক্সটাইল মিল থেকে শুরু করে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, 'প্রায় এক হাজার ২৫০টি প্রতিষ্ঠান বিশেষ নীতি সহায়তার জন্য আবেদন করেছিল। এর মধ্যে প্রায় ২৫০টি প্রতিষ্ঠানকে এই সুবিধা দেওয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছে।'
তিনি বলেন, মূলত বৈদেশিক মুদ্রা ক্ষয়, জ্বালানি ঘাটতি ও পূর্ববর্তী সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রতিশোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানিগুলোর সহায়তার জন্য এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
তার ভাষ্য, 'ইচ্ছাকৃতভাবে যারা ঋণখেলাপি হয়েছে, তাদের এই সুবিধা দেওয়া হবে না।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবেদন পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের আট মাস পর এই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৫ সালের মার্চের তথ্য অনুযায়ী, আব্দুল মোনেম লিমিটেডের অগ্রণী, আইএফআইসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ও ডাচ-বাংলা ব্যাংকসহ ২৪টি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৬৯৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।
আব্দুল মোনেমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মঈনুদ্দিন মোনেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনাসহ নানা কারণে আমাদের কাজ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আগে আমরা মাসে ৫০টি প্রজেক্ট পেতাম, এখন তা নেমে এসেছে দু-একটিতে।'
তিনি বলেন, '২০২১ সালে আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিলাম। তখন আমাদের ব্যাংক ঋণ ছিল দুই হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এরপর থেকে উচ্চ সুদের কারণে বকেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।'
তিনি প্রশ্ন তোলেন, '১৬ শতাংশ সুদের কারণে কিস্তি পরিশোধ করার পরও বকেয়া শুধু বেড়ে যাচ্ছে। এত বেশি সুদ দিয়ে আমরা কীভাবে ব্যবসা করব?'
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডলারের বিনিময় হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়াকেও দায়ী করে তিনি বলেন, 'আগে ডলারের দাম ছিল ৮০ থেকে ৮৬ টাকা। এখন সেটা ১২০ টাকা।'
ওরিয়ন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিংয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮২ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত তারা জনতা, রূপালী, এবি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সিভিসি ফাইন্যান্সে ঋণখেলাপি হয়েছে।
ওরিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন, তারা ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য বিশেষ নীতি সহায়তা পাবেন।
তিনি বলেন, 'বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতার কারণে ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেড খেলাপি হয়ে পড়েছে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কেবল অগ্রণী ব্যাংকেই ৯২৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে তানাকা গ্রুপের।
দেশবন্ধু গ্রুপও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এই নীতি সহায়তার অনুমতি পেয়েছে।
এই সুবিধা পেতে যাওয়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ড্যান্ডি ডাইং লিমিটেড, বেঙ্গল গ্রুপ, অ্যাম্বিয়েন্ট স্টিল বিডি, জিপিএইচ ইস্পাত, প্রাইম গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, সিল্কওয়ে গ্রুপ, সাদাব ফ্যাশন ও এপেক্স উইভিং।
এ ছাড়া, ডায়মন্ড স্পিনিং মিলস, মীম গ্রুপ (আলেমা টেক্সটাইল), এসএমএ গ্রুপ (এএ নিট স্পিন), বিইউসি অ্যাগ্রো, রাইজিং স্টিল, ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস, অঙ্কুর স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ, সোরভ অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস, ইনটেনসিটি লিমিটেড ও গ্লোবাল অ্যাসেট লিমিটেডও এই বিশেষ সুবিধা পেতে যাচ্ছে।
জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আমরা ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহক। তবে, উৎপাদন সম্পূর্ণ সচল রাখতে এবং ব্যাংকের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টায় আমরা নীতিগত সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছি।'
গত জানুয়ারিতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকার কারণে ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়া করপোরেট ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরপর থেকে কমিটি ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছে এবং ন্যূনতম ডাউন পেমেন্ট থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পরিশোধের জন্য বিভিন্ন শর্ত দিয়ে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে।
কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই সহায়তা পাওয়ার জন্য আবেদন করার প্রাথমিক সময়সীমা ছিল ৩০ এপ্রিল। পরে তা বাড়িয়ে ৩১ মে করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একজন সদস্য বলেন, 'প্রতিষ্ঠান ভেদে সুনির্দিষ্ট চাহিদা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন নীতি সহায়তা দেওয়া হবে।'
'কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট কমানো হতে পারে, আবার কিছু কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদি সময় পেতে পারে। এসব সুবিধা দেওয়া হবে, যাতে তারা তাদের কার্যক্রমও চালিয়ে যেতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
তবে ব্যাংকাররা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই ধরনের সুবিধা দেওয়া হলে ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতে পারে এবং ব্যাংকিং শৃঙ্খলাকে দুর্বল করতে পারে।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ খেলাপি ঋণ বেড়ে গত মার্চের শেষে রেকর্ড চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
অনেক ঋণগ্রহীতা নীতি সহায়তা পাওয়ার আশায় কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এর ফলে ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া আরও কঠিন হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অগ্রণী ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, 'কিস্তির টাকা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নীতি সহায়তার জন্য আবেদন করার পর প্রায় সব ঋণগ্রহীতাই কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।'
Comments