নির্মাণসামগ্রী শিল্পে সুদিন এনেছে মেগা প্রকল্প

মেগা প্রকল্পে বিশ্বমানের পণ্য নিশ্চিত করার সুযোগ পাওয়ায় সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের নির্মাণসামগ্রী খাত।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ছবি: স্টার

মেগা প্রকল্পে বিশ্বমানের পণ্য নিশ্চিত করার সুযোগ পাওয়ায় সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের নির্মাণসামগ্রী খাত।

এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসম্মত উপকরণ নিশ্চিতের পাশাপাশি পর্যাপ্ত উৎপাদন সক্ষমতা ও পরিচালন দক্ষতা বাড়াতে হবে।

বর্তমানে সরকার আমদানির পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে তৈরি নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে প্রায় ১ ডজন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

যেমন, ঢাকায় দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য কমপক্ষে ১০টি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিমেন্ট, ইস্পাত ও পেইন্টের মতো উপকরণ সরবরাহ করছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা উপকরণ যদি কোনোভাবে নিম্নমানের হয়, তাহলে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির পথ বেছে নেবে।

সেই হিসেবে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের একটি বড় অংশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রকল্পের কাজে অংশ নেওয়া ১০ দেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬টি সিমেন্ট, ২টি ইস্পাত ও বাকিগুলোরা পেইন্ট ও পিভিসি পণ্য তৈরি করে।

সিমেন্ট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—শাহ সিমেন্ট লিমিটেড, ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসি, বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, সেভেন সার্কেল (বাংলাদেশ) লিমিটেড ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড।

বিএসআরএম ও জিপিএইচ ইস্পাত এই প্রকল্পে ইস্পাত সরবরাহ করছে এবং আরএফএল গ্রুপের ২ প্রতিষ্ঠান—আরএফএল পাইপ অ্যান্ড ফিটিংস ও রেইনবো পেইন্টস প্রয়োজনীয় পাইপ ও রোড মার্কিং উপকরণ সরবরাহ করছে।

প্রিমিয়ার সিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আমিরুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'এটা গর্বের বিষয় যে আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে অংশ নিচ্ছি। আমরা এই প্রকল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সিমেন্ট সরবরাহ করেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'মেগা প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে তাদের পণ্যের দক্ষতা ও গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে।'

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, স্থানীয় সিমেন্ট নির্মাতারা তাদের উত্পাদন ক্ষমতা বছরে ৫৮ লাখ টনে উন্নীত করেছে। মাত্র ১০ বছর আগে এই খাতে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২০ লাখ টন।

'মোট ক্রেতার প্রায় ৪৫ শতাংশ সরকারি খাত থেকে আসে,' উল্লেখ করে মোহাম্মদ আমিরুল হক আরও বলেন, 'উন্নতমানের পণ্য নিশ্চিতের পাশাপাশি সরবরাহ বাড়ানোর জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন।'

যেমন, সরকারি মেগা প্রকল্প ও অন্যান্য উন্নয়ন কাজ সরাসরি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। তাদের ইউনিটগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সেগুলোকে পরিবেশবান্ধব করে তোলে।

প্রিমিয়ার সিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন, এছাড়াও, এটি রপ্তানির পথ খুলে দেয়। স্থানীয় সরবরাহকারী ও আন্তর্জাতিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ সহজতর করে।

আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ড্রেনেজ ব্যবস্থার জন্য মাটি, বর্জ্য ও বৃষ্টির পানি সরানোর পাইপ, ফিটিংস ও রোড মার্কিং উপকরণ সরবরাহ করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা পুরো প্রকল্পের জন্য ২টি উপকরণ সরবরাহ করছি। এই প্রকল্পের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।'

তার মতে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের প্রকল্পে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঙ্গে নেয় তাহলে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। তাদের দায়িত্ববোধ তৈরি হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেগা প্রকল্পে অংশ নিলে যতটা না ব্যবসা হয়, তার চেয়ে বেশি যেটা অর্জন করা যায় তা হলো মানসম্মত পণ্য উৎপাদন।'

আরএফএল কর্মকর্তার মতে, যদি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ না করে তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে পণ্য আমদানি করতে হবে।

'তাই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এই ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজেরা লাভবান হয়, অন্যদিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সহায়তা করে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে এখন পর্যন্ত মোট ৬৬ হাজার টন ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএসআরএম থেকে নেওয়া হয়েছে ৫২ হাজার টন ইস্পাত।

'বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহকারীদের দেওয়া পণ্যের গুণগত মান ও উৎপাদন ক্ষমতা বিবেচনায় নেয়,' উল্লেখ করে বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমে পণ্যের স্পেসিফিকেশন দেয়। সরবরাহকারী ঠিক করে নেওয়ার আগে তারা পণ্যের গুণমান পরীক্ষা করে।'

প্রয়োজনীয় পরিমাণের পাশাপাশি মানসম্মত পণ্য সরবরাহের ক্ষমতা তাদের আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান আমাদের পণ্য গ্রহণ করেছে। আমরা প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ইস্পাতের প্রায় ৮০ শতাংশ সরবরাহ করেছি।'

তিনি মনে করেন যে এই ধরনের বড় প্রকল্পে অংশ নেওয়া হলে তা স্থানীয় নির্মাণ সামগ্রী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে ও পণ্যের আন্তর্জাতিকমান অর্জনে সহায়তা করে।

তিনি আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করলে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, উপকরণ সরবরাহে দেরি হলে তা প্রকল্প বাস্তবায়নকে ধীর করে দেয় এবং এর খরচ বাড়ায়।'

সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্মাণ পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এবং বড় বড় প্রকল্পের কল্যাণে দেশের ইস্পাতশিল্প শক্তিশালী হচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট ইস্পাত ব্যবহারের ৪০ শতাংশ সরকারি প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়। ২০২২ সালে ইস্পাতের মোট ব্যবহার ছিল প্রায় ৮০ লাখ টন।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত এক দশকে দেশে ইস্পাত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে এখন প্রায় ৯০ লাখ মেট্রিক টন হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকারের বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পসহ উন্নয়ন কাজগুলো পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষমতা বাড়াতে উৎসাহিত করেছে।'

সরকার বৃহৎ প্রকল্প নিলে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় বলে মনে করেন তিনি।

'সরকার ভিশন-২০২১ ঘোষণার পর আমরা সক্ষমতা বাড়াতে শুরু করি' জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'দেশের বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো স্থানীয় ইস্পাত প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের পণ্যের মান বাড়াতে উত্সাহিত করছে।'

'কারণ, আন্তর্জাতিক দরপত্র জেতার জন্য আমাদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়।' তিনি মনে করেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্থিরতার মধ্যে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকে তবে দেশে ইস্পাত উত্পাদন ক্ষমতা ১ কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি জানান, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ডলার ঘাটতির পাশাপাশি নির্মাণ কাজে ধীরগতির কারণে এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে স্থানীয় নির্মাণ সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হচ্ছে।'

তিনি বাংলাদেশে এ খাতের বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন। তিনি আশা করেন যে, আগামীতে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।

তবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিকমানের পণ্য সরবরাহ করলেও জিটুজি (অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে নিজ দেশের সরকারের প্রকল্প) ভিত্তিতে বাস্তবায়িত কাজে তারা অংশ নিতে পারে না।

এই প্রেক্ষাপটে তিনি জিটুজি প্রকল্পেও স্থানীয় পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের জন্য চুক্তিতে বিধান রাখার দাবি জানান।

Comments