ওষুধশিল্প

শূন্য থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ

ওষুধশিল্প
বর্তমানে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

ঘটনাটির শুরু ১৯৮২ সালে। এ বছরটি ছিল দেশের ওষুধশিল্পের ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণ। সে বছর তৎকালীন সরকার ওষুধশিল্পের বিকাশের ভিত্তি রচনা করে।

১৯৭০-র দশকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ছিল নগণ্য। তখন দেশের প্রয়োজনীয় ওষুধের ২০ শতাংশেরও কম উৎপাদন হতো। তাই অধিকাংশ ওষুধই আমদানি করতে হতো। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ ভিটামিন, মিক্সচার ও টনিক তৈরি করত।

সরকার ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যাক্ট নিয়ে আসার পর আসে পরিবর্তন। স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত হতে পারে এমন ওষুধ আমদানি নিষিদ্ধ হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তালিকাভুক্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।

এই আইনের ফলে ট্যাবলেট ও অ্যান্টি-বায়োটিকের মতো বেশ কয়েকটি পণ্যের দামে নিয়ন্ত্রণ আসে। ওষুধের দাম বাড়ানোর সুযোগ অনেকটা কমে যায়। ফলে, বেড়ে যায় সব ধরনের ওষুধের উত্পাদন।

জরুরি ওষুধ সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিম্নমানের ওষুধ তৈরির সুযোগ কমে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে এ শিল্পে স্থানীয় ফার্মাসিস্ট, রসায়নবিদ ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়।

আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশে ১৬৬ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ছিল। এর মধ্যে আটটি ছিল বিদেশি। এরা ৭০ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে। বাকি দুই শতাংশ ওষুধ আমদানি হয়। এটি ওষুধশিল্পকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে আসে। বছরের পর বছর ধরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমে যাওয়ায় তারা বাজার ছেড়ে দেয়।

এই সাফল্যের পেছনে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় ওষুধনীতির জনক হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এই নীতিটি অল্প সংখ্যক প্রয়োজনীয় জেনেরিক ওষুধের স্থানীয় উত্পাদনের ওপর ভিত্তি করে কম খরচে স্বাস্থ্যসেবার কৌশল তৈরি করেছিল।

ওষুধশিল্প
বাংলাদেশের হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি হচ্ছে। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

সবচেয়ে বড় কথা, ৪৮ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মধ্যে বাংলাদেশই ওষুধ উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক দেশের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশ দ্রুত ভালোমানের ও কম দামের জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনের বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।'

বাংলাদেশের নয়টি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে।

আবদুল মুক্তাদির আরও বলেন, 'খুব শিগগিরই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০টি হবে।'

বর্তমানে দেশে ২১৩ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে। এ শিল্পে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে ওষুধ খাতের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির আছে। এ খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় দুই লাখ ও পরোক্ষভাবে আরও তিন লাখ মানুষের কাজের সুযোগ হয়েছে।

গত এক দশকে স্থানীয় বাজার বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ২০১২ সালে এই বাজার ছিল নয় হাজার কোটি টাকার। এখন তা ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জেনেরিক ওষুধের বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের।

মুক্তাদিরের মতে, বিশ্ববাজারের এক শতাংশ বাংলাদেশের রপ্তানি ৪০০ কোটি ডলার বাড়িয়ে দিতে পারে।

তার মতে, 'চীন, ভারত ও পশ্চিমের কয়েকটি দেশ ছাড়া ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের সমকক্ষ কেউ নেই। ফলে বৈশ্বিক ওষুধের বাজারে আমাদের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির সুযোগ আছে।'

স্থানীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে বাংলাদেশ। তুলনামূলক সমৃদ্ধ এসব দেশ তাদের জাতীয় চাহিদার ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মেটাতে আমদানির ওপর নির্ভর করে।

বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে প্রায় ১৫০ দেশে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এ খাত থেকে গত অর্থবছরে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় হয়।

দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই খাতের বিকাশ আমাদের আনন্দ দেয়।'

'তবে এই খাতের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন 'তাই আমাদের অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) তৈরি করতে হবে।'

তিনি জানান, এই খাতের প্রবৃদ্ধির সব বাধা দূর করতে সরকারের সঙ্গে বিএপিআই কাজ করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান এস এম আব্দুর রহমান এই খাতের প্রবৃদ্ধির কৃতিত্ব দিয়েছেন ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ আন্তর্জাতিক মানের না হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি হতো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ঘুরে দেখেছি। গত ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতি দেখেছি।'

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো সন্দেহ নেই যে এ শিল্পের বিকাশ স্বাস্থ্যসেবা খাতকে সহায়তা করছে।'

'ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রায় ৪০ প্রতিষ্ঠান খুব ভালো করছে। তারা স্থানীয় বাজারে বিশ্বমানের ওষুধ সরবরাহ করছে,' যোগ করেন তিনি।

বিকন মেডিকেয়ার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই খাতটি বিকশিত না হলে আমদানি করা ওষুধের দাম বর্তমানের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি হতো।'

'তাই ওষুধ খাতকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago